তার পুরনো আমলের ঢাউস ক্যামেরায় মল্লিকবাড়ির একটা গ্রুপ ফটো তুলতে হয়েছিল কালুরামকে। ফটো তোলায় তার নাম খুব। কালো কাপড়ে মাথা ঢেকে সে যখন তার তেপায়া ক্যামেরা অ্যাডজাস্ট করে তখন লোকে হাসে বটে, কিন্তু ফটো দেখলে সবাই অবাক মানে। কালুরাম এখন বুড়ো হয়েছে, কিন্তু এখনও সবাই তাকে ডাকাডাকি করে।
এই মল্লিকবাড়ির গ্রুপ ফটো তুলতে গিয়েই ঘটনাটা প্রথম ঘটল, যেমনটা কালুরামের ফটোগ্রাফির জীবনে আর কখনও ঘটেনি। নাদু মল্লিকের ছেলের পৈতে। সেই উপলক্ষে মেলা আত্মীয়-স্বজন এসেছিল। তার মধ্যে অনেক বুড়ো-বুড়ি ছিল, দূরের লোক ছিল। কে কবে মরে যায়, কার সঙ্গে আর দেখা হয় কি না হয়, তাই কালুরামকে ডাকিয়ে গ্রুপ ফটো তোলা হল। মোট একুশজন ছিল, কালুরামের মনে আছে। ছবিটা উঠলও সুন্দর, একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার ছবি।
কিন্তু ছবি ডেলিভারি নিয়ে নাদু মল্লিক হঠাৎ বলে উঠলেন, সবাইকে তো চিনতে পারছি, কিন্তু পিছনের সারিতে কোণের দিকে এই গোঁফওয়ালা লোকটা কে? একে তো সেদিন দেখা যায়নি?
কালুরাম অবাক হয়ে বলল, আপনাদেরই লোক, চিনতে না পারলে আমি কী করব?
নাদু মল্লিক মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের লোক হতেই পারে না। তবে উটকো কেউ ঢুকে পড়েছিল নিশ্চয়ই। আমরা মোট একুশজন ছিলাম মনে আছে। কিন্তু এই লোকটাকে নিয়ে বাইশজন হচ্ছে। গুনে দেখুন। কালুরাম গুনে তাজ্জব। সে পুরনো আমলের লোক। যা করে তা একেবারে পাকা কাজ। ক জনের ফটো তুলতে হবে এবং কীভাবে তার সাজিয়ে নিতে হবে এসব তার হিসেব করে নিতে হয়। যতদূর মনে পড়ছে, এ লোকটাকে সে সারিতে দেখেনি, আর লোকটা দাঁড়িয়েছে আরেক জনের কাঁধে হাত রেখে এবং একটু হেলে। ভঙ্গিটা মোটেই ভাল নয় ফটো তোলার পক্ষে। কালুরাম ফটাে তোলার সময় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি কেন সেইটেই তার মাথায় ঢুকছে না। এতকালের অভ্যাসে গণ্ডগোল হয়ে গেল! তার মানে কি সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে?
মল্লিকবাড়ির ব্যাপারে খটকাটা রয়ে গেল বটে, কিন্তু হাটখোলার ব্যানার্জিদের বাড়িতে বুড়ো সদাসিব বাঁড়ুজ্যে সাতানব্বই বছর বয়সে মারা যাওয়ায় ফটো তোলার জন্য কালুরামের ডাক পড়ল। এবং ফের ফটো নিয়ে গণ্ডগোল। এবারকার গণ্ডগোলটা কালুরামকে রীতিমতো উদ্বেগে ফেলে দিল। এ ফটোটাও ভাল উঠেছে। সামনে ফুলে সাজানো খাটিয়ায় সদাশিববাবু শুয়ে ; বুকের উপর ভাগবদগীতা। পিছনে ছয় ছেলে, তিন মেয়ে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনী ও তস্য পুত্রপৌত্ৰাদি। সব মিলিয়ে বেশ একখানা ভিড়ের দৃশ্য। শোকবিহুল ভিড়। কিন্তু পিছনের সারিতে সদাশিবের বড় আর মেজো ছেলের মাথার মাঝখান দিয়ে একটা ফিচেল মুখ বেরিয়ে আছে। মুখে ইয়ার্কির হাসি। আর সেই গোঁফ! কালুরাম মুখখানা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল। এ যে চেনা মুখ! কালুরাম মল্লিকবাড়ির গ্রুপ ফটোটা বের করে মিলিয়ে নিল। কোনো ভুল নেই। এ সেই লোক।
সদাশিবের বড় ছেলে রামশিব ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ উঠে বললেন, এ লোকটা কে? এ তো আমাদের পরিবারের কেউ নয়। এ কোত্থেকে এল?
কালুরাম মাথা চুলকে বলল, এ ব্যাটা মহাবজ্জাত। মল্লিকবাড়ির ফটোতেও ঢুকে পড়েছিল।
তার মানে? মানে কি ছাই কালুরামই জানে? সে মাথা চুলকোতে লাগল। তবে এর পর থেকে খুবই সতর্ক হয়ে গেল কালুরাম।
এর পরের ফটো খুবই সাদামাটা। মহেশ দত্তর একমাত্র ছেলের বিয়ে। ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে মহেশ দত্ত আর তার গিন্নি ছবি তুলবেন। মোট চারজন। কালুরাম খুবই সর্তক হয়ে চারদিক দেখে নিয়ে তবে সাবধানে ছবিটা তুলল। না, এবার আর কোনো উটকো লোক ঢুকে পড়তে পারেনি। বড় গ্রুপ তো নয়।
কিন্তু নিজেদের ডার্ক রুমে নেগেটিভ দেখতে গিয়ে কালুরামের বুক আর হাত দুটোই কেঁপে গেল। সামনে পাশাপাশি দুটাে চেয়ারে দত্ত আর দত্তগিন্নি, পিছনে দাঁড়ানো ছেলে আর ছেলের বউ। কিন্তু তাদের মাঝখানে আরেক জন। নির্ভুল আরেক জন। কালুরাম দুই চোখ কচলে নিয়ে ফের দেখল। ভুল নেই। তারপর নেগেটিভ প্রিন্ট করে দেখল, সেই ফিচেল গোঁফওয়ালা লোকটাই।
দত্তবাবু ছবি দেখে অবাক হয়ে বললেন, এ কী? আমার ছেলে আর বউমার মাঝখানে এটা কে?
কালুরাম সতর্ক হয়ে গেল। তার দোষ বলে দত্তবাবু যদি ছবির দাম না দেন। সে মাথা চুলকে বলল, দেখুন, ছবি তোলার কথা, তুলে দিয়েছি। লোকজন কে কোথেকে এল তা বলি কী করে? আপনাদেরই কেউ হবে। দত্তবাবু রাশভারী লোক। গম্ভীর মুখ করে বললেন, আমার বাড়িতে এরকম কোনো লোক নেই। তবু খোঁজ নিয়ে দেখছি বউমার বাপের বাড়ির কেউ সেদিন হঠাৎ হাজির হয়েছিল কি না।
বউমাকে ডাকানো হল। তিনি ছবি দেখে চোখ গোল করে বললেন, না তো! সেদিন তো কেউ আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়নি! আর একে তো কস্মিনকালেও দেখিনি।
কালুরাম ঘন ঘন মাথা চুলকোতে লাগল। দত্তবাবু গম্ভীরতর হয়ে বললেন, বুড়ো বয়সে তোমার গণ্ডগোল হচ্ছে। অন্য কোনো ছবির নেগেটিভের সঙ্গে মিশিয়ে প্রিন্ট করেছ নিশ্চয়ই। নাঃ, দেখছি অন্য কোনো ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে নতুন করে ছবি তোলাতে হবে।
এইভাবে কালুরামের ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড় হল। অন্য সব চ্যাংড়া ফটোগ্রাফার দিব্যি ছবি তুলে বেড়াচ্ছে, কারও কোনো গোলমাল হয় না। কিন্তু কালুরাম ক্যামেরা ক্লিক করলেই কোত্থেকে গোঁফওয়ালা ফিচেল লোকটা এসে হাজির হয় তা কালুরাম আকাশ-পাতাল ভেবেও বুঝতে পারছে না। ক্যামেরা বা ফিল্মের কোনো দোষ নেই, কালুরাম ভালই জানে। প্রিন্টেও কোনো গণ্ডগোল সে করছে না। তবে এটা হচ্ছেটা কী?
কালুরাম ফিচেল লোকটার ছবি নেগেটিভ থেকে কেটে এনলার্জ করে ভাবভাবে মুখটা স্টাডি করল। লোকটার বয়স ত্রিশের মধ্যেই। গোঁফজোড়া বেশ মিলিটারি ধাচের এবং জম্পেশ। মাথায় অনেক চুল। চেহারাটা ভালই। হাসিটাও খারাপ বলা যায় না। যাকে ফটোজেনিক ফেস বলে তাই। ক্যামেরায় যখন ধরা পড়েছে, তখন লোকটাও কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু কোথায় আছে?
কালুরামের রীতিমতো দুশ্চিন্তা হতে লাগল। ভয়ও হতে লাগল। খাওয়া কমে গেল। ঘুম কমে গেল। শরীরটা বেশ রোগও হয়ে গেল। পুরনো ক্যামেরাগুলো কালুরাম ভাল করে পরিষ্কার করে নিল। ফিল্ম পাল্টে ফেলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। নিতান্তই একটা সূর্যাস্তের ছবি তুলেছিল কালুরাম। তাতেও দেখল, সেই লোকটা ঠিক ছবির বাঁ কোণে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে।
অগত্যা লোকটার এনলার্জ করা ছবিটা নিয়ে কালুরাম দারোগাবাবু হরিহরের সঙ্গে দেখা করে বলল, একটু মুশকিলে পড়ে এসেছি।
দারোগাবাবু কালুরামকে ভালই চেনেন। তিনি বললেন, আরে এসো, এসো। অনেক কাল তোমাকে দেখি না। তা আমি তো ভাই শিগগিরই রিটায়ার করব। আমার এই ইউনিফর্ম-পরা চেহারাটা একদিন বেশ জুত করে তুলে দাও তো।
কালুরাম আমতা-আমতা করে বলল, সে আর বেশি কথা কী? দেবখন তুলে। আচ্ছা দারোগাবাবু, এই লোকটাকে কি চেনা-চেনা ঠেকছে? একটু ভাল করে দেখুন তো।
ছবিটা দেখেই দারোগাবাবু চমকে উঠলেন, কোথায়! কোথায় সে! এক্ষুনি একে ধরা দরকার।
দারোগাবাবু এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যে কালুরাম ঘাবড়ে গেল। আমতা-আমতা করে বলল, এ কি কোনো ফেরার আসামী? দারোগাবাবুর চেঁচামেচিতে সেপাই-সান্ত্রী ছুটে এসেছে।
দারোগাবাবু কালুরামের দিকে চেয়ে বললেন, কোথায় লোকটা? কালুরাম দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, তা তো জানি না।
কিন্তু এ কে দারোগাবাবু?
কে! কে তা কি তুমি জানো না?
আজ্ঞে না।
কিন্তু এই যে বললে লোকটা খুনী!
কালুরাম অবাক হয়ে বলে, কখন বললুম?
বলোনি?
না তো!
তা হলে কি ডাকাত?
তাও তো জানি না।
দারোগাবাবু রুমালে মুখের ঘাম মুছে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর হাতের ইঙ্গিতে সেপাই-সান্ত্রীদের বিদেয় দিয়ে বললেন, তা হলে লোকটার ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? যেভাবে ছবিটা বের করে দেখালে তাতে তো আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, লোকটা নিৰ্ঘাত কোনো খুনী, ডাকাত, ফেরার আসামী।
কালুরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, আপনার ব্লাডপ্রেশারটা বোধহয় খুব বেশি।
দারোগাবাবু বললেন, হ্যাঁ বড্ড বেশি। একটুতেই এমন অ্যাজিটেটেড হয়ে যাই। তা লোকটা তা হলে কে?
সেইটে জানতেই তো আপনার কাছে আসা। লোকটাকে চোখে দেখতে পাইনি। অথচ যতবার যেখানেই ছবি তুলি, লোকটা ছবিতে এসে যায়।
অ্যাঁ, সে কী কথা!
আজ্ঞে। এমন-কি ডার্করুমে পর্দার ওপর আলো ফেলে ছবি তুলেও দেখেছি। ছবিতে কিছুই না থাকার কথা। কিন্তু এই লোকটা ঠিক ছবিতে চলে আসে।
রাম রাম রাম রাম। শিগগির ছবিটা নিয়ে বিদেয় হয়ে যাও।
কেন দারোগাবাবু?
এ ভূতের ছবি। আমার ওতে ভীষণ ভয়। ভূতটুত আমি আদপেই ভালবাসি না। কালুরাম উঠে পড়ল। তারপর সে এস. ডি. ও. সাহেবের সঙ্গে দেখা করল। এস. ডি. ও. সাহেব ভারি মিষ্টি শান্ত ভালমানুষ। মশামাছি অবধি মারেন না। ছবিটি দেখে মোলায়েম গলায় বললেন, পাত্রটি কে?
পাত্ৰ! পাত্র নয়। আসলে—
এস. ডি. ও. সাহেব কালুর কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, আমরা হলুম কুলীন কায়স্থ। আমার মেয়েকে তো দেখেছেন! একটু কালো। আর দাঁতগুলো যা একটু উঁচু। এ ছাড়া নিখুঁত সুন্দরী। মনে করে যে পাত্রের খবর এনেছেন তাতে ভারি খুশি হয়েছি। পাত্র আমার পছন্দসই। তবে গোঁফজোড়া বড্ড প্রমিনেন্ট। মিলিটারি হলে তো খুবই ভাল। দাঁড়ান। মেয়ের মাকে ফটোটা দেখিয়ে আনি।
সত্য বটে, কালুরাম অনেক জায়গায় ঘোরে বলে তাকে এস. ডি. ও, সাহেব মেয়ের জন্য পাত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ যে পাত্র নয় সেই কথাটা কালুরাম আর বোঝাতে পারল না।
এস. ডি. ও. সাহেব ফিরে এসে হাসিমুখে বললেন, পাত্র আমাদের খুব পছন্দ। তাড়াতাড়ি সম্বন্ধটা এনে ফেলুন। পাত্রের বাবার ঠিকানাটাও দরকার।
কালুরাম বেজার মুখে বলল, যে আজ্ঞে। জনে-জনে ছবিটা দেখিয়ে বেড়াল বটে কালুরাম, কিন্তু সুবিধে হল না। ফিচেল লোকটা যে কোত্থেকে এসে ছবিতে উদয় হয় তা বোঝা গেল না।
কালুরাম নিজে ফটোগ্রাফার হলেও তার নিজের ছবি কস্মিনকালেও তোলেনি। বলতে কি, কালুরামের কোনো ফটোও নেই। কয়েকদিন দুশ্চিন্তায় কাটিয়ে কালুরাম স্থির করল, টাইমার দিয়ে এবার সে নিজের কয়েকটা ছবি তুলবে। লোকটা যদি তার আশেপাশে এসে হাজির হয় তা হলে টপ করে চেপে ধরবে বাছাধনকে।
নিজের স্টুডিওর ভিতরে ক্যামেরা ফিট করে সামনে চেয়ার বসিয়ে কালুরাম তৈরি হল। সেলফ টাইমারের বোতাম টিপে গিয়ে চেয়ারে বসল। তারপর দু’ধারে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হুঁ হু বাবা, এত সোজা নয়। এসো দেখি এবারে বাছাধন, দেখাব মজা।
ক্লিক করে ক্যামেরার অটোমেটিক শাটারের শব্দ হল। কালুরাম চারদিকে চেয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হল, কেউ নেই।
কিন্তু ছবিটা প্রিন্ট করার পর কালুর একগাল হাসি। ছবিতে তার নিজের চিহ্নও নেই। চেয়ারে সেই ফিচেল লোকটাই গোঁফ চুমরে হাসি-হাসি মুখে বসে আছে।
কালুরাম দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠল। অন্য সব ছবিতে লোকটা এসে হানা দেয় বটে, কিন্তু যাদের ছবি তোলা হয় তাদের কেউ অদৃশ্য হয়ে যায় না। কিন্তু এ ছবিতে তা-ই ঘটেছে। কালুরাম সম্পূর্ণ অদৃশ্য। বসে আছে ফিচেলটা।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কালুরাম স্টুডিওতে বসে বসে রাত গভীর করে ফেলল। তার দেরি দেখে ভিতর বাড়ি থেকে তার স্ত্রী এসে বললেন, কী ব্যাপার। তুমি এখনও বসে বসে কী করছ? রাত হয়ে গেছে যে!
কালুরাম বিরসবদনে বলল, বড্ড চিন্তা হচ্ছে।
কিসের চিন্তা! বাঃ, এই ছবিটা কোথায় পেলে? এই বলে কালুরামের বউ ফিচেলের ফটোটা তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।
কালুরাম কৌতুহলী হয়ে বলল, ছবিটা কেমন দেখছ?
চমৎকার। দেখাওনি তো আমাকে কখনও? চেনো নাকি লোকটাকে?
কালুরামের বউ অবাক হয়ে বলল, ও আবার কীরকম কথা? যার সঙ্গে পঁচিশ বছর ঘর করছি তাকে চিনব না মানে? বিয়ের সময় তো তোমার এই গোঁফই ছিল! ঝ্যাটা গোঁফ পছন্দ করি না বলে বকে বকে ছটিয়েছিলুম। ওই তো গালের আচিলটা দেখা যাচ্ছে। আর এই যে বাঁ ভ্রুর ওপর কাটা দাগ!
কালুরামের মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল কিন্তু… কিন্তু...
বউ হেসে বলল, তুমি তো জন্মেও ফটো তোলাও না। এমন কি বিয়ের সময় পর্যন্ত ছবি তোলাতে রাজি হওনি। আমার যেজন্য ভারি দুঃখ ছিল। যে দুনিয়াসুদ্ধ সকলের ফটো তুলে বেড়ায় তার নিজের কোনো ফটো নেই। কিন্তু এই ফটোটা যে তুলিয়েছিলে তা কখনও বলোনি তো। এটা আমি নিলুম, বাঁধিয়ে রাখব।
কালুরামের একেবারে বাক্য হরে গেল। তবে কথাটা মিথ্যেও নয়। তার হঠাৎ মনে পড়ল, ঠিক এইরকম গোঁফ সে যৌবনে রাখত বটে। গালের আঁচিল এবং ভ্রুর ওপর কাটা দাগ এখনও আছে। সে ফিচেল হাসিও হাসতে জানত এক সময়ে। না, সন্দেহ নেই। এটা তারই ছবি বটে। তবে যৌবনকালের ছবি।
ফটোগ্রাফার কালুরাম রাতে ঘুমোতে পারল না। এপাশ ওপাশ করতে লাগল। তারপর এক সময়ে থাকতে না পেরে ভূতের মতো গিয়ে নিজের অন্ধকার স্টুডিওতে ঢুকে বসে রইল। সে নিজেই কী করে ছবির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে? তাও এখনকার সে নয়, যৌবনের সে!
ভাবতে ভাবতে কালুরাম বিড়বিড় করে বলল, অসম্ভব! এ হতে পারে না। আমারই মাথার গণ্ডগোল।
অন্ধকারে ফিচ্ করে কে যেন হাসল।
কালুরাম চমকে উঠে বলল, কে রে?
আমি গো আমি। আমি কালুরাম। তার মানে আমি হচ্ছি তুমিই।
অ্যাঁ! বলে কালু হাঁ করে রইল।
অবিশ্বাসের কী আছে হে? আমিই তুমি। বহুকাল ধরে একসঙ্গেই আছি।
কালুরাম কথা বলতে পারছিল না। অনেক কষ্টে শুধু বলল, কী করে হয়?
ফিছ্ করে একটু হাসি শোনা গেল অন্ধকারে। ফিচেলটা বলল, কালুরাম, এক সময়ে তোমার গোঁফ ছিল, হাসি ছিল, মজা ছিল। এখন তুমি এক গোমড়ামুখো ফটোগ্রাফার। তোমার ভিতরকার হাসিখুশি কালুরামটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তাই একদিন হাসিখুশি কালুরাম গোমড়ামুখো কালুরামের ভিতর থেকে ফট করে বেরিয়ে এসেছে।
অ্যাঁ! বলো কী?
তাই তো বলছি। গোমড়ামুখো কালুরামের সঙ্গে পোষাল না বলে ভেন্ন হয়েছি, তাই বলে কি আর খুব তফাত হতে পারি? কাছাকাছিই আছি হে। কিন্তু ফটোর ভিতরে ঢুকছ কী করে?
খুব সোজা। আমাকে এমনিতে তুমি দেখতে পাও না বটে, কিন্তু তোমার ক্যামেরা তো আমাকে ভালই চেনে। তোমাকে জব্দ করার জন্য হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যাই।
কিন্তু আমার যে ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে তোমার জন্য। তার আমি কী করব?
গোমড়ামুখো লোক আমি দু'চোখে দেখতে পারি না।
কালুরামের এবার ভয় কেটে গিয়ে খুব রাগ হল। এই ফিচেলটা যদি সে নিজেই হয়ে থাকে তাও ক্ষমা করা যায় না। সে রাগে গরগর করে বলে উঠল, ভাল চাও তো শিগগির ফের আমার ভিতরে ঢুকে পড়ো। নইলে—
নইলে কী করবে? তোমাকে ভয় খাই নাকি?
তবে রে—বলে কালুরাম গলার স্বরটা লক্ষ্য করে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল দ্বিতীয় কালুরামের ওপর।
তারপর যা ঘটল তা আর কহতব্য নয়। ধুন্ধুমার লড়াই চলতে লাগল।
ক্যামেরা-ট্যামেরা সব উলটে পড়ে গেল, কাঁচ ভাঙল, চেয়ার ওলটাল, কালুরামের গা থেকে গলগল করে ঘাম ঝরতে লাগল। কিন্তু কে হারল, কে জিতল তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে এক সময়ে লড়াই থামল। কালুরাম তখন মেঝের ওপর পড়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাফাচ্ছে। পাশাপাশি আর-একটা লোকও পড়ে আছে, টের পেল কালুরাম।
একটু মায়া হল কালুরামের। শত হলেও লোকটা তো সে নিজেই। লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে কালুরাম বলল, খুব লেগেছে নাকি?
তুমি মহা পাজি লোক।
আহা রাগ করো কেন? মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। ওঠো, হাতেমুখে জল দিয়ে এসো।
তুমি দাও, তা হলেই আমারও হবে।
একটা কথা ছিল।
কী কথা?
বলছিলাম কি, এবার আর আমি অত গোমড়ামুখো থাকব না। বেশ হাসিখুশি লোক হয়ে যাব। চাও তো বেশ জম্পেশ গোঁফও রাখতে পারি।
মাঝে মাঝে নিজের ফটো তোলাবে?
তাও তোলাব। সব হবে। এবার টুক করে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ো তো কালুরাম।
কালুরাম কালুরামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পরদিন থেকে আর কালুরামের ফটোতে কোনো গণ্ডগোল রইল না।
0 coment�rios: