Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

        এক সময় ছিল গরিব একটি লোক। এমন গরিব যে নিজের একমাত্র ছেলেকে মানুষ করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ছেলে তাকে বলল, “বাবা, তোমার অবস্থা এ...

সাপের তিনটি পাতা - জার্মানের উপকথা

        এক সময় ছিল গরিব একটি লোক। এমন গরিব যে নিজের একমাত্র ছেলেকে মানুষ করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ছেলে তাকে বলল, “বাবা, তোমার অবস্থা এতই খারাপ যে আমি তোমার কাছে একটা বোঝার মতো। বেরিয়ে পড়ে দেখি, নিজের রুটি নিজে রোজগার করতে পারি কি পারি না।” বাবা তাকে আশীর্বাদ করে মনের দুঃখে বিদায় দিল।
        সে-সময় এক শক্তিশালী এলাকার রাজা যুদ্ধ করছিল। সেই তরুণ তার সৈন্যদলে যোগ দিয়ে চলে গেল যুদ্ধ করতে। শক্রর সেনা দারুণ লড়তে লাগল। সেই তরুণ আর তার দলের সৈন্যদের উপর বৃষ্টির মতো নীল বুলেট লাগল ঝরতে। তার দলের অনেকেই গেল মারা। অন্যরা চাইল পালাতে। কিন্তু সেই তরুণ এগিয়ে গিয়ে বলল, “ভয় পেয়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ো না। আমাদের পিতৃভূমিকে কিছুতেই আমরা ছেড়ে যাব না।” তার কথা শুনে তারা আবার যুদ্ধ করতে ফিরে গেল আর ফিরে গিয়ে নিঃশেষ করে দিল শত্ৰু-সেনা। সেই তরুণের জন্য জয়ী হয়েছেন শুনে রাজা তাকে প্রধান অফিসার করলেন, দিলেন অনেক ধনসম্পত্তি আর করলেন তাকে নিজের প্রধান উপদেষ্টা। রাজার ছিল একটি মেয়ে। যেমন রূপসী তেমনি খামখেয়ালী। সে পণ করেছিল এমন কাউকে বিয়ে করবে যাকে প্রথমে অঙ্গীকার করতে হবে সে মারা গেলে একই কবরে তার সঙ্গে সে যাবে জীবন্ত অবস্থায়। রাজকন্যে বলেছিল, “আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসলে আমি মরবার পর আমার স্বামী আর বেঁচে থাকতে চাইবে না।” এ কথাও সে বলেছিল -স্বামী আগে মারা গেলে তার সঙ্গে সে-ও জীবন্ত অবস্থায় যাবে কবরে।
        এই অদ্ভুত পণের জন্য কেউই তাকে বিয়ে করতে সাহস করে নি। কিন্তু তার রূপে সেই তরুণ এমনই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, রাজকন্যের পণ শুনে সে ভয় পেল না। তাই রাজাকে গিয়ে সে বলল, রাজকন্যেকে বিয়ে করতে সে রাজি।
        রাজা প্রশ্ন করলেন, “তোমাকে কী প্রতিজ্ঞা করতে হবে জান তো?”
        সে বলল, “জানি–রাজকন্যে আগে মারা গেলে তার সঙ্গে আমায় কবরে যেতে হবে। কিন্তু তাকে আমি এতই ভালোবেসে ফেলেছি যে, সেই সর্তেই রাজি।” রাজা তাই বিয়েতে মত দিলেন। আর খুব ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। কিছুকাল তারা খুব আনন্দেই কাটাল। তার পর হঠাৎ একদিন রাজকন্যে পড়ল ভয়ংকর অসুখে। কোনো রাজবাদ্যই তার অসুখ সারাতে পারল না। রাজকন্যে মারা যেতে সেই তরুণের মনে পড়ল নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। রাজকন্যের সঙ্গে জীবন্ত অবস্থায় কবরে যাবার কল্পনায় আতঙ্কে সে শিউরে উঠল। কিন্তু পালাবার কোনো পথ নেই। কারণ যাতে সে পালাতে না পারে তার জন্য বুড়ো রাজা শহর থেকে বেরুবার পথে পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলেন। রাজকন্যের মৃতদেহের সঙ্গে সেই তরুণকেও রাজ-সমাধিকক্ষে নামিয়ে দরজায় কুলুপ এঁটে দেওয়া হল। কফিনের কাছে একটা টেবিলের উপর রাখা ছিল চারটে বড়ো-বড়ো মগ জল, চারটে পাউরুটি আর চার বোতল মদ। সেই খাদ্য আর পানীয় শেষ হলেই তাকে উপোস করে মরতে হবে। খুব মনমরা হয়ে সে বসে থাকে। প্রতিদিন খায় রুটির ছোট্টো টুকরো আর সামান্য মদ। আর বুঝতে পারে মৃত্যু গুটিগুটি আসছে তার দিকে এগিয়ে।
        মনমরা হয়ে একদিন মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে, এমন সময় - দেখে সেই সমাধিঘরের এক কোণ থেকে নিঃশব্দে একটা সাপকে বেরিয়ে। এসে রাজকন্যের মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যেতে। সে ভাবল সাপটা ৷ সম্ভবত এসেছে রাজকন্যের মৃতদেহটা খেতে। তাই খাপ থেকে তরোয়াল বার করে সে বলে উঠল, “যতক্ষণ আমি বেঁচে ততক্ষণ রাজকন্যের দেহ কেউ সম্পর্শ করতে পারবে না।” এই-না বলে সঙ্গে সঙ্গে। সাপটাকে সে তিন টুকরো করে দিল।
        খানিক পরে সেই কোণ থেকে বেরিয়ে এল আর-একটা সাপ। কিন্ত অন্য সাপটাকে টুকরো-টুকরো হয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখে দ্বিতীয় সাপটা পালিয়ে গেল। খানিক বাদেই ফিরল মুখে তিনটি সবুজ পাতা নিয়ে। তার পর মরা সাপের তিনটে টুকরো জুড়ে দ্বিতীয় সাপটা প্রত্যেকটা জোড়ের মুখে রাখল একটা করে সবুজ পাতা। আর সঙ্গে সঙ্গে কাটা সাপটা জোড়া লেগে বেঁচে উঠল আর তার পরেই সাপ দুটো গেল পালিয়ে। কিন্তু যাবার সময় মেঝেয় তারা ফেলে গেল সেই সবুজ তিনটে পাতা।
        সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ্য করে সেই তরুণের মনে হল—মরা সাপকে বাঁচাবার আশ্চর্য ক্ষমতা পাতা তিনটের থাকলে হয়তো মরা মানুষকেও এগুলো বাঁচাতে পারে। তাই সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে একটা রাখল রাজকন্যের মুখে আর অন্য দুটো তার দু চোখে। আর কী আশ্চর্য! প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যের শিরায় শিরায় বইতে শুরু করল রক্ত আর তার ফ্যাকাশে মুখটা হয়ে উঠল গোলাপী। তার পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখ মেলে তাকিয়ে অবাক হয়ে রাজকন্যে চেঁচিয়ে উঠল:
        হা ভগবান! এ আমি কোথায়?”
        তার স্বামী বলল, “বউ, তুমি আমার কাছে রয়েছ।”
        তার পর জানাল কী করে তাকে সে বাঁচিয়ে তুলেছে। রাজকন্যেকে সে খেতে দিল রুটি আর মদ। রাজকন্যে সুস্থ হয়ে উঠলে দুজনে তারা গিয়ে দরজায় দিতে লাগল ধাক্কা আর চেঁচিয়ে শুরু করে দিল ডাকাডাকি, করতে। তাই-না শুনে প্রহরীর দল ছুটে গিয়ে রাজাকে খবরটা জানাল।
        রাজা স্বয়ং নেমে এসে দরজা খুললেন আর তাদের দুজনকে সুস্থ দেখে আনন্দে হয়ে গেলেন আত্মহারা।
        সেই তরুণ, সাপের সেই তিনটে পাতা সঙ্গে করে এনেছিল। নিজের ভৃত্যকে সে বলল, “এগুলো সাবধানে রেখে দাও সব সময় যেন তোমার সঙ্গে থাকে। দরকারের সময় এগুলো আমাদের কাজে লাগতে পারে।” কিন্তু বেঁচে ওঠার পর রাজকন্যের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। মনে হল স্বামীর প্রতি সব ভালোবাসা তার হৃদয় থেকে যেন মুছে গেছে। কিছুকাল পরে সেই তরুণ জাহাজে করে বেরুল তার বুড়ো বাপকে দেখতে। রাজ কন্যেও ছিল সেই জাহাজে। যেতে যেতে সেই জাহাজের এক নাবিককে রাজকন্যে খুব ভালোবেসে ফেলল। এক রাতে সেই তরুণ রাজা যখন ঘুমুচ্ছে—রাজকন্যে ধরল তার মাথা আর সেই নাবিক ধরল তার দুটো পা। আর তার পর দুজনে মিলে তাকে তারা ফেলে দিল সমুদ্রে।
        এই দুষ্কর্ম করার পর সেই নাবিককে রাজকন্যে বলল, "এবার দেশে ফেরা যাক। ফিরে বলব, আমার স্বামী পথে মারা গেছে। রাজার কাছে তোমার এত প্রশংসা করব যে নিশ্চয়ই তিনি আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে তোমাকে তার উত্তরাধিকারী করে যাবেন।”
        কিন্তু সেই বিশ্বাসী ভৃত্য লক্ষ্য করেছিল সমস্ত ঘটনাটা। তাই জাহাজ থেকে চুপি চুপি একটা নৌকা নামিয়ে সে গেল যেখানে তার প্রভুকে ফেলে দেওয়া হয়। তার পর জল থেকে তার মৃতদেহ তুলে সেই পাতা তিনটের একটা সে রাখল তার মুখে আর অন্য দুটো তার দুচোখে। এইভাবে সে বাঁচিয়ে তুলল তার প্রভুকে।
দিনরাত দাঁড় বেয়ে তারা চলল। ফলে তাদের ছোটো নৌকাটা অন্যদের আগেই পৌছল সেই বুড়ো রাজার রাজত্বে। তাদের একলা ফিরতে দেখে অবাক হয়ে রাজা কারণটা জানতে চাইলেন। তার মেয়ের শয়তানীর কথা প্রথমটায় তার বিশ্বাসই হল না। সত্য ঘটনা প্রকাশ করার জন্য জামাই আর ভৃত্যকে তিনি বললেন একটা গুপ্ত ঘরে লুকিয়ে থাকতে।
        কিছুদিন পরেই জাহাজটা ফিরে এল। সেই শয়তান বউ শোকার্ত বিষণ্ণ মুখে হাজির হল তার বাবার সামনে।
        রাজা তাকে প্রশ্ন করলেন স্বামীকে ফেলে একলা সে ফিরেছে কেন? উত্তরে রাজকন্যে বলল, “বাবা। আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। সমুদ্রে যেতে-যেতে হঠাৎ আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এই দয়ালু নাবিক সাহায্য না করলে আমার কী যে হত জানি না। আমার স্বামীর মৃত্যুর সময় এই নাবিক সেখানে উপস্থিত ছিল। সব কথা এ তোমাকে বলতে পারবে।”
        শুনে রাজা বললেন, “তোমার মৃত স্বামীকে প্রাণ দিয়ে আমি ফিরিয়ে আনছি।” সেই গুপ্ত ঘরের দরজা খুলে যে দুজন সেখানে লুকিয়ে ছিল রাজা তাদের বললেন বেরিয়ে আসতে।
        স্বামীকে জীবন্ত দেখে রাজকন্যে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল আর তার পর নতজানু হয়ে বসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল।
        কিন্তু রাজা তাকে ক্ষমা করলেন না। বললেন, “তোমার জন্যে এ। মরতে প্রস্তুত ছিল, তোমাকে এ মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। প্রতিদানে ঘুমন্ত অবস্থায় একে তুমি ডুবিয়ে দিয়েছিলে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবার কর।”
        রাজকন্যে আর সেই নাবিককে তলায় ফুটোওয়ালা একটা জাহাজে তুলে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হল। দেখতে দেখতে সমুদ্রের ঢেউয়ের তলায় তারা গেল মিলিয়ে।

0 coment�rios: