হরবাবুর সঙ্গে কুঞ্জ সেনের বাজারেই দেখা হয়ে গেল। দুজনেই পুরোনো বঙ্কু। হরবাবু এখানে ছিলেন না। মঙ্গলগ্রহের মাটিতে চাষবাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কুঞ্জ সেন ছিলেন আরও দূরে। নেপচুনের চারদিকে আবহমণ্ডল রচনার গুরুতর কাজে প্রায় ত্রিশ বছর সেখানে থাকতে হয়েছে। গড়িয়াহাট বাজারে দু’জনের দেখা হয়ে গেল এক সকালবেলায়।
আরে! হর যে?
কুঞ্জ না? কী খবর?
ভারী খুশি হলেন দু’জনে। পুরোনো দিনের কথাবার্তা হল খানিকক্ষণ। কুঞ্জ সেন বললেন, সবই পাল্টে গেছে হে! এই গড়িয়াহাটে মার্কেট মাত্র ত্রিশ বছর আগেও ছিল একশ তিনতলা একটা ছোটো বাড়ি। এখন দেখ তো কেমন তিনশ তলা অবধি তুলে ফেলেছে।
হরবাবু বললেন শুধু কী তাই! আগে দুচারটে রোবট দোকানদার ছিল। এখন সবকটাই রোবট। আর এরা ভারী বেরসিক। সবজি বাজারে একটা রোবটকে ডাটার দর দু’টাকা কমাতে বলেছি। অমনি মুখখানা এমন আঁশটে করে ঘসকে ছিল যে অপমান বোধ করলুম।
কুঞ্জ যেন একটা শ্বাস ফেলে বললেন, দর বেশ চড়া। ত্রিশ বছর আগে কুঁচো চিংড়ির দর ছিল আড়াই হাজার টাকা কিলো। এখন পাঁচ হাজারের নীচ পাবে না। নেপচুনে তো এখনও চাষবাস ইত্যাদি শুরু হয়নি। ভ্যাকুয়াম প্যাকের খাবার খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল। তাই ভাবছিলুম একটু পালং-চিংড়ির ঘণ্ট খাবো।
হরবাবু একগাল হেসে বললেন, আমাদের মঙ্গলে ভায়া, সমস্যা নেই। গ্রিণ হাউসে দিব্যি সবজির চাষ হয়। মাছের ব্যবস্থাও হয়েছে। সব টাটকা।
তোমার কপাল ভাল। তা কদিন থাকবে এখানে?
দেখি। মঙ্গল থেকে বৃহস্পতি বা অন্য কোথাও পাঠাতে পারে। তোমার নেপচুনে থাকার মেয়াদ আর কত দিনের?
হয়ে এল। সামনের বছরেই চাঁদে চলে আসছি। ওখানে একটু জমি কিনে বাড়িও করে রেখেছি আগে থেকে।
ভালো করেছো। থাকার পক্ষে চাঁদই এখন ভাল। পৃথিবীর পলিউশনটা ওখানে নেই। দিব্যি গাছপালা হয়েছে। রাস্তাঘাট ভাল। পৃথিবীর সব জিনিসই পাওয়া যায়। আমিও ভাবছি একটু জমি কিনে রাখব।
চলে এসো চাঁদে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে রোজ।
গল্প করতে করতে দুই বঙ্কুতে একটা দোকানে গিয়ে ঢুকলেন। বড় মুদির দোকান। খদের গিজগিজ করছে। চারটে রোবট হিমশিম খাচ্ছে খদ্দের সামলাতে।
হরবাবু বললেন, ভীড় দেখেছো? পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে গেল নাকি?
না হে। এসবই গ্রহান্তর থেকে আসা প্রবাসী। যাওয়ার আগে জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছে। তা তুমি কী নেবে?
হরবাবু বললেন, দুশো গ্রাম পোস্ত নেবো, একটু গুড়ো হলুদ আর গরম মশলা।
আমি নেবো ধনে, জিরে, আদা, নুন আর সর্ষের তেল। ওহে ও রোবট ভায়া, এই আমার ফর্দখানা নেবে নাকি?
রোবট গম্ভীর গলায় বলে, একটু দাঁড়াতে হবে।
দোকানটা বেশ বড়, ছিমছাম। পলিপ্যাকে সাজানো সব জিনিস।
ভীড়টা একটু পাতলা হতেই দু’জনে জিনিস কিনে দাম মেটাতে গেলেন। দাম দিতে গিয়েই হরবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, এই রে! আমার মানিব্যাগ! সর্বনাশ, আমার যে পকেটমার হয়ে গেছে!
কুঞ্জবাবু তাড়াতাড়ি নিজের পকেটে হাত দিয়ে বলে উঠলেন, আরে! আমারটাও যে গেছে হে!
ডেলিভারি নিন না! কাউন্টার আটকে রাখবেন না, পিছনে ভীড় হয়ে যাচ্ছে।
দু’জনে চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কুঞ্জবাবু বললেন, ক্রেডিট কার্ড করাই হয়নি। দু-চারদিনের জন্য আসা, ওসব ঝামেলা কে করে?
দু’জনেই দোকানের প্রবেশপথের পাশে “পুলিশ” লেখা কোন যন্ত্রে বার্তা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উড়ন্ত পুলিশের দু’জন কনস্টেবল আকাশ থেকে নেমে এল। জিজ্ঞাসাবাদের পর সব টুকে নিয়ে বলল, পাকা হাতে কাজ।
কুঞ্জবাবু উদ্বিগ্ন কষ্ঠে বললেন, পাওয়া যাবে তো!
একজন কনস্টেবল বলে, পাওয়া যেত, যদি পকেটমার মানুষ হত। আজকাল মানুষের ছদ্মবেশে কত রোবট পকেটমার ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হিসেব নেই। দেখলে বুঝতেও পারবেন না। এদের কাজ এত পাকা যে কোনও সূত্রই রেখে যায় না। তবে আমরা চেষ্টায় আছি।
দুই বঙ্কুতে একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কুঞ্জবাবু মুখটা বিকৃত করে বললেন, পৃথিবীটা দিনদিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে! এই পঁয়ত্রিশশো পঁচাশি সালেও পকেটমারি চলছে ভাবতে পারো?
হরবাবুও সায় দিয়ে বললেন, যা বলেছে।
0 coment�rios: