সবুজ বনে-ঢাকা এক পাহাড়ি ঢালুতে ছিল এক গ্রাম। সেই গ্রামে থাকত একজন লোক আর তার বউ। তাদের ছিল সাত মেয়ে। সবাইকেই কাজ করতে হত। খুব খাটতে হত। এতগুলো মুখ, এতগুলো পেট,—অনেক খাবার লাগত।
পাশেই ছিল একখণ্ড জমি। সেই জমিতে তারা চাষ করত। এইরকম একবারের কথা। বাবা-মা চাষ করেছে সেই জমিতে। মাটি বেশ নরম হয়েছে। এখন বীজ বুনতে হবে। ধানের বীজ ছড়াতে হবে। বাবা-মা আর পারছে না। তাই মেয়েদের বলল, ‘ভালোভাবে ধানের বীজ ছড়াও। সাবধানে পা ফেলবে।
মেয়েরা এর আগে অনেক রকম কাজ করেছে। কিন্তু বীজ ছড়ানোর কাজ তেমন ভালোভাবে জানত না। আলতোভাবে বীজ ছড়াতে হবে। নইলে ধান ভেঙে যাবে, তার খোসা উঠে যাবে। হলও তাই । ধানের খোসা গেল উঠে, ভেতরের চাল গেল ভেঙে। এ বীজ মাটিতে ছড়িয়ে লাভ কি? মা ভীষণ রেগে গেল। খুব বকাবকি করতে লাগল। কত ক্ষতি হয়ে গেল। এমনিতেই কত অভাব। কাজে একটুও মনোযোগ নেই। আরও কত কি বলল মা । মা তো এমন করে আগে কখনও বকেনি। এমন কি অপরাধ করেছে তারা? ভীষণ অভিমান হল বড় মেয়ের। সে কেঁদে ফেলল। আচমকা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। আর পাহাড়ি ঢালুতে গড়িয়ে গেল। ঘুরতে ঘুরতে পড়ছে সে। জমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেল সে। পাক খেয়ে নেমে যাচ্ছে সে। পাহাড়ি শক্ত মাটিতে, কাঁটাঝোপে, ঘাসের ছুঁচলো আঘাতে তার দেহ কেটে ছড়ে একাকার হয়ে গেল। রক্ত ঝরছে সারা দেহে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। মেয়ে নিথর হয়ে গেল।
পরের দিন মেজ মেয়ে এমনি করেই ইচ্ছে করে গড়িয়ে পড়ল। দিদির পথে। তারও একই দশা হল । শেষকালে সে-ও নিথর হয়ে গেল।
পর পর ছয় দিন ছয় মেয়ে এমনি করে পাহাড়ি ঢালুতে গড়িয়ে পড়ল। একজন হঠাৎ অন্য পাঁচজন ইচ্ছে করে। সবাই শেষকালে নিথর হয়ে গেল।
ছোট মেয়েও ঠিক করল, দিদিরা যে পথে গিয়ে নিথর হয়ে গিয়েছে, সে-ও তাই করবে। দিদি যেখানে দাঁড়িয়েছিল ছোট বোন সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। কেউ নেই। কি সুন্দর দিন। নিথর হতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু দিদিরা কেউ তো সঙ্গী নেই! কি হবে বেঁচে থেকে? গড়িয়ে পড়ল ছোট বোন। কিন্তু পড়েই সে কেঁদে উঠল। হাত দিয়ে কিছু ধরতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। গড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁদছে। দুহাতে কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছে, পারছে না। ক্ষতবিক্ষত দেহে গড়িয়ে যাচ্ছে।
পাহাড়ি ঢালুর এক জায়গায় ছিল একটা মস্ত গাছ। ছোট বোনের দেহ গিয়ে লাগল সেই গাছের গুড়িতে। আশ্চর্য, মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কোথায় চলে গেল ছোট বোনের দেহ? আর কোনদিন কেউ তার দেহ খুঁজে পায়নি। তার নিথর দেহ কেউ দেখেনি।
অল্পক্ষণ পরেই চারপাশেই সুন্দর সব গাছ গজিয়ে উঠল। গাছে গাছে সুন্দর সব পাকা ফল ঝুলছে। ঠিক যে জায়গায় মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তারই চারপাশে এ সব ফলের গাছ। আগে ছিল না।
তার নরম দেহের নরম মাংস থেকে জন্মাল সাদা ধবধবে ধানের ছোট ছোট চারা— এই ধান থেকেই আমাদের এখানে সবচেয়ে ভালো চাল হয়। তার কচি কচি হাড় থেকে জন্মাল সাধারণ চাল। আর তার অপরূপ সুন্দর লাল রক্ত থেকে জন্মাল লাল রঙের চাল। ছোট মেয়ে যখন হাসত সবাই অবাক হয়ে চেয়ে থাকত। এমন মিষ্টি হাসি, মুক্তোর মতো দাঁত। ঝিনুকের মধ্যে যেমন মুক্তো হাসে, তার হাসিভরা মুখেও মুক্তো ঝরত। তার মুক্তোর মতো দাঁত থেকে জন্মাল ভুট্টা। অনেক হয়, আমাদের গোলা ভরে যায়। মেয়ে ছিল মুক্তকেশী। মন ভরে যেত। মাথা-ভর্তি কালো চুলের রাশি। সেই মাথা থেকে জন্মাল নারকেল। অনেক অনেক হয়। আমাদের দ্বীপের চারপাশে।
আমাদের আদরের মেয়ে, ছোট বোন চলে গেল। আর কোনদিন ফেরেনি। কিন্তু সে আমাদের অনেক দিয়ে গেল। প্রতিটি ফসলের পরবে তাই আমরা তার গান গাই। বেদনার গান, খুশির গান।
0 coment�rios: