অনেকদিন আগে এক পাহাড়ি উপত্যকায় থাকত এক বুড়ো আর এক বুড়ি। নির্জন পাহাড়ে সুখে-শান্তিতে তাদের দিন কেটে যেত। তাদের ছিল এক অদ্ভুত শখ। ঘোড়াকে তারা খুব ভালোবাসত। অন্য পশুদের তেমন নয়। ঘোড়া দেখলেই তারা আদর করত, গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ভালো ভালো খেতে দিত। কত বুনো ঘোড়াকেই না তারা আদর করেছিল।
তাদের নিজেদেরও একটা পোষা ঘোড়া ছিল। যেমন সে দেখতে, তেমনি আদুরে। এমন তেজি ঘোড়া ওই এলাকায় আর ছিলনা। বুড়ো-বুড়ির খুব গর্ব। হবেই বা না কেন।
এক চোর ভাবল, ঘোড়াটাকে চুরি করতে হবে। অনেক দিন থেকেই সে সুযোগ খুঁজছিল। একদিন অন্ধকার রাতে সে বুড়ো-বুড়ির বাড়ির কাছে একটা উঁচু পাথরের আড়লে লুকিয়ে রইল। চারিদিক নিস্তদ্ধ হয়ে এলে চোর আস্তাবলের ছাদে উঠে চুপটি করে বসে রইল। সুযোগ পেলেই ঘোড়া নিয়ে পালাবে। ছাদের ফাঁক দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখল, ঘোড়া তখনও খামার থেকে ফেরেনি। এত দেরি হচ্ছে কেন? বুড়ো তো ফিরে এসেছে। তবে? চোর অপেক্ষা করতে লাগল। অনেকক্ষণ— । আরও অনেকক্ষণ— । তার কেমন ঘুম পেয়ে গেল। সে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুম।
এখন হয়েছে কি, সেই পাহাড়ের এক গুহায় থাকত একটা নেকড়ে বাঘ। অনেকদিন থেকেই তার ইচ্ছে সে বুড়ো-বুড়িকে খাবে। তেমন সুযোগ পায়নি। সেদিন সে ঠিক করল, আজকে খাবই। বেশ অন্ধকার রাত। সেও গেল বুড়ো-বুড়ির বাড়ির দিকে। নেকড়ে বাঘ সব সময় ভাবত, এই দুনিয়ায় আমার চেয়ে শক্তিমান আর কেউ নেই।
ঘুম আসছে না বুড়ো-বুড়ির। তারা কথাবার্তা বলছে। পুরনো দিনের কথা, পুরনো দিনের শিকারের কথা, সুখ-দুঃখের কথা। ঘাপটি মেরে জিভ বের করে দোরের কাছে বসে রয়েছে নেকড়ে বাঘ। সব কথা সে শুনছে। সুযোগের অপেক্ষায় সে রয়েছে।
কি থেকে যে কি কথা এসে যায়! বুড়ো বুড়িকে জিঙ্গেস করল, "আচ্ছা বুড়ি, তোমার কি মনে হয় বলতো? এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ের, সবচেয়ে সাংঘাতিক কোন জিনিস আছে? তোমার মত কি?
বুড়ি বলল, “আমার কথা যদি বলো, তাহলে আমার মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে সাংঘাতিক হল নেকড়ে বাঘ। ওর কথা মনে হলেই বুক কাঁপে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
নেকড়ে বাঘ কথাটা শুনে খুব খুশি হল। সে একটু নড়েচড়ে বসল। মুখে তৃপ্তির হাসি। সে যা ভাবে তাহলে কথাটা মিথ্যে নয়। বেশ, এরা যখন তাকে এমন ভয় পাচ্ছে, তাহলে আজ রাতেই এদের মাংস খাওয়া যাবে। বেশি বেগ পেতে হবে না।
হঠাৎ বুড়ি কাঁপা গলায় জিঙ্গেস করল, ”আচ্ছা বুড়ো, তোমার কি মনে হয়? এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ের, সবচেয়ে সাংঘাতিক কোন জিনিস আছে? তোমার মত কি?
‘আমার মত হল, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ের সাংঘাতিক জিনিস হল পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদ। বৃষ্টির জল যদি একবার ঢুকতে শুরু করে— ।
নেকড়ে বাঘ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সে শুনেছে পুরনো বাড়ির ফুটাে ছাদ? আর কিছু শোনার মতো অবস্থা তার নেই। সে ভাবল, এতকাল জানতাম আমিই সবচেয়ে সাংঘাতিক, সবচেয়ে শক্তিমান। কিন্তু বুড়ো একি কথা শোনাল! আমার চেয়েও সাংঘাতিক জিনিস আছে? পুরনো বাড়ির ফুটাে ছাদ? সে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। এই বুঝি পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদ এসে পড়ে। কিন্তু সে দৌড়তে পারল না, সেখানে দাঁড়িয়েই কাঁপতে লাগল, দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে।
এমন সময় ছাদের ওপরে চোর জেগে উঠেছে। তলায় তাকিয়ে দেখে, বুড়োর ঘোড়া দাড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তেমন ঠাহর হয় না,—না আর দেরি নয়। লাফিয়ে পড়ল ঘোড়ার পিঠে । ঠিক মতন লাফ দিতে পেরেছে।
নেকড়ে বাঘ আরও চমকে উঠল। এ নিশ্চয়ই তার চেয়েও সাংঘাতিক পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদ। মৃত্যু ঠেকায় কে! তবু চেষ্টা করা যাক। এর কথাই বুড়ো বলেছিল। হায়! তার একি হল?
প্রাণের ভয়ে নেকড়ে বাঘ দৌড় দিল। চার পায়ে প্রচণ্ড গতি। এমন দৌড় সে আগে জানত না। সে চলেছে বন্ধুর কাছে। বন্ধু থাকে গুহায়। সে যদি বাঁচায় তাকে।
আর চোর বুঝেছে, সে ঘোড়াকে পেয়েছে। তাকে পালাতে দেবে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ঘোড়ার গলা। ছুটছে নেকড়ে বাঘ, পিঠে লেপটে আছে চোর। ছুটছে নেকড়ে বাঘ, পিঠে চড়ে রয়েছে সাংঘাতিক জিনিস, পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদ।
গুহার মুখে গিয়ে চোর ছিটকে পড়ল। ঘোড়া গুহায় ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু চোর গুহার মুখে বসে রইল। ঘোড়া কতক্ষণ থাকবে গুহার ভেতরে? বেরোতে তাকে হবেই। তখন? সে চুপটি করে গুহার মুখ পাহারা দিয়ে রইল।
গুহার মধ্যে অনেক জন্তু-জানোয়ার। রাতের শিকারে বেরোবে বলে তৈরি হচ্ছিল। নেকড়ে বাঘ হাঁপাতে হাঁপাতে গুহায় ঢুকেই শুয়ে পড়ল। সে ক্লান্ত। তবু হাঁপাতে হাঁপাতে দলপতিকে বলল তার শোনা কথা। সব বলল। পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদের কথা। কি সাংঘাতিক।
জানোয়ার দলপতি গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে? তাহলে তোমাদের মধ্যে কে পুরনো বাড়ির ফুটাে ছাদকে ধরতে যাবে? কে রাজি আছ?
নেকড়ে বাঘেরই এমন অবস্থা। কেউ রাজি হল না। সবাই বলল, আমি পারব না, আমি যেতে চাই না, আমার দ্বারা ওসব হবে না, ওর মধ্যে আমি নেই।
এক ছিল বানর। সে খুব চালাক। ভাবল, দেখাই যাক না কি হয়। সে রাজি হয়ে গেল। দলপতি বাহবা দিল। সবাই নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু চুপ করে রইল।
বানর গুহার দিকে মুখ করে পেছনে সরতে লাগল। লেজটা লম্বা হয়ে আগে আগে যাচ্ছে। গুহার বাইরে লেজ এল। লেজের গোডায় ঠান্ডা হাওয়া লাগল। বানর একটু থামল। নাঃ, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। লেজ আর একটু বাইরে এল। লেজ নড়ছে।
চোরের চোখ-মুখ খুশিতে ভরে গেল। তবে? বেরোতে তোমাকে হবেই।
লেজ আর একটু বেরিয়েছে। লোমশ লেজ। খপ করে মুঠোতে চেপে ধরল, বানর লাফিয়ে উঠেই কাঁপতে লাগল। দুহাতে লেজ চেপ ধরে প্রাণপণে চোর টানছে, সে একটা পাথরে দু’পা বাঁধিয়ে নিয়েছে। ঘোড়াকে পালাতে দেবে না সে।
বানরের মুখ ভর্তি লোম। তার মধ্যেও তার গোল গোল চোখ দেখা যাচ্ছে, লাল হয়ে উঠেছে। নেকড়ে বাঘ এক লাফে গুহার কোণে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সব জন্তু কোণে যেতে চায়। হুটোপুটি। একজন আর একজনের গায়ের ওপরে পড়ে যাচ্ছে। দলপতিও তাদের মধ্যে। সে এক কাণ্ড।
বানর খুব বুদ্ধিমান। সে-ও গুহার পাথরের একটা ফাটল দুহাতে ধরে ফেলেছে। শক্ত করে। একবার এগোচ্ছে দেহ, আবার পেছোচ্ছে। এগোবার সময় পাথরে মুখ ঘষে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে, চোখ যেন বেরিয়ে যাবে। দেহের সব রক্ত মুখে জমা হয়েছে, লেজের গোড়া টনটন করছে। এই বুঝি ছিঁড়ে যাবে। যাক। সেও ভালো। সত্যি সাংঘাতিক, সত্যি অসীম বলবান এই পুরনো বাড়ির ফুটো ছাদ। গায়ে কি জোর । কি সাহস। প্রাণটা বুঝি গেলই। কি দরকার ছিল কায়দা করার। বানর এগোচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে। মুখ ঘষে যাচ্ছে পাথরে।
নেকড়ে বাঘ একটু গলা উঁচিয়ে বানরকে দেখতে চেষ্টা করল। বানরের অবস্থা দেখেই মুখ লুকিয়ে ফেলল। অন্য জন্তুরাও ভয়ে কাঠ।
বানরের বিরাট লেজ। এখন টান টান হয়ে আছে। হঠাৎ পটাং করে আওয়াজ হল। বানরের মুখ থেতলে গেল পাথরে, সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চোর দুই পা তুলে উলটে গেল। হাতে তার বানরের লেজ, অনেকটা।
সেদিন থেকে বানরের লেজ আজকের মতো ছোট হয়ে গেল। আগের মতো আর বড় রইল না। বানরের মুখ চোরের টানাটানির জন্য বারবার পাথরে ঘষে গিয়েছিল। সেই ঘষায় মুখের সব লোম উঠে গেল। দেহের সব জায়গায় লোম, কিন্তু তখন থেকে বানরের মুখে কোন লোম নেই। রক্ত জমে গিয়েছিল মুখে। বাপরে যা টানাটানি।
সেদিন থেকে বানরের মুখ রক্তের মতো লাল হয়েই রইল।
0 coment�rios: