সেই আদ্দিকালে মানুষ আর পশু একসঙ্গে বাস করত। যে কালের কথা বলছি সেটা ছিল সৃষ্টির আদিকাল। মানুষ আর পশু ভাই-ভাই হয়ে পাশাপাশি থাকত। ঝগড়া নেই, বাটি নেই, হিংসে নেই। বড়ই ভাব। কিন্তু ছাড়াছাড়ি হল কেমন করে? পশু কেন মানুষের শত্ৰু হল? মানুষ কেন পশুর শত্ৰু হল? সেই কথাই বলছি।
বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায়, গাছের কোটরে মানুষও থাকত, পশুও থাকত। গলাগলি ভাব। কিন্তু বনের এই জীবন মানুষের আর ভালো লাগল না। বড়ই কষ্ট। তাই ভেবে চিত্তে মাথা খাটিয়ে সে কুঁড়েঘর তৈরি করতে শিখল। ছাউনি যখন হল, তখন আর গুহায় কিংবা কোটরে থেকে লাভ কি? শুধুই কষ্ট পাওয়া। ফাঁকা মাঠের মধ্যে গাছের ডালপালা আর পাতা দিয়ে সে ঘর তৈরি করল। বন ছেড়ে আলোয় এল। রোদ্দুরে কষ্ট নেই, বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না, শীতেও অনেক আরাম। কি বুদ্ধি মানুষের! কিন্তু পশুরা রয়ে গেল বনে, পাহাড়ি গুহায়, গাছের কোটরে। ওরা ঘরবাড়ি তৈরি করতে জানত না। বেচারা পশুরা! কি আর করে? বনেই রয়ে গেল। ভাইয়ে ভাইয়ে ছাড়াছাড়ি হল। কিন্তু তখনও হিংসে তেমন ছিল না, কেউ কারও তেমন শত্রু হয়নি। একবার আমাদের এই এলাকায় ভীষণ ঠান্ডা পড়ল। সে কি কাঁপুনি। ঘরের মধ্যে থাকলেও কাঁপতে হচ্ছে। তখন তো কোন মানুষ পোশাক পরত না। তাই শীতও লাগে বেশি। এমনি এক ভোরে এক কাণ্ড ঘটে গেল। এক বুড়ি ঠকঠক করে কাঁপছে। আকাশে মেঘ, রোদের তেজ নেই। ঘর থেকে বাইরে এসে দেহ গরম করার উপায় নেই। তার ওপরে বাইরে হাওয়া বইছে। বুড়ো সারা রাত ভয়ে ভয়ে থেকেছে—এই বুঝি বুড়ি মরে যাবে। রাত পোহাল কিন্তু বুড়ির কাঁপুনি কমছে না। বুড়ো কি যেন ভাবল। চোখ কুঁচকে বাইরে তাকাল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতে তুলে নিল একটা এবড়ো খেবড়ো পাথর আর বুনো লতার একটা গুলতি। হাঁটা দিল বনের পথে।
অল্পক্ষণ পরেই বুড়ো ফিরে এল। তার হাতে একটা চামড়া, তখনও গরম রয়েছে, চামড়ার একপাশে লাল টকটকে রঙ। গোটা পশুর গোটা চামড়া। ব্যাস, আর দেখে কে! মানুষে-পশুতে সরাসরি লড়াই শুরু হয়ে গেল। চরম শত্ৰুতা। একে অন্যকে পেলেই ছিড়ে খুঁড়ে মেরে ফেলত। আর সেই ভাই-ভাই ভাব কোথায় মিলিয়ে গেল। এখন আমরা যেমন দেখতে পাই। শুরু হয়েছিল বুড়োর চামড়া আনার দিন থেকে।
কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। তাই পশুরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা সভা ডাকল। সব পশু এল। সলা-পরামর্শ করা দরকার। মানুসের হাত থেকে তারা বাঁচবে কেমন করে? মানুষ শয়তান, জঘন্য। দুষ্টুবুদ্ধিতে তাদের হারিয়ে দিচ্ছে। ওদের শায়েস্তা করার পথ বাতলাতে হবে। সবাই বলুক, মন খুলে বুদ্ধি দিক। এই মানুষ কি সাংঘাতিক ! বড় বড় দাঁত নেই, ধারালো নখ নেই, থাবাও নেই,—আর গায়ের জোরও কিছুই নেই। তবু সবচেয়ে বড় আর শক্তিমান পশুকেও মেরে ফেলছে। তার ছাল ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। দেহ গরম করছে। নিজের কিছুই নেই। অথচ তীর-ধনুক,বর্শা, গাছের মোটা ডাল, বুনো লতার গুলতি, এবড়ো খেবড়ো পাথর,—যা পায় তাই কাজে লাগায়। দূর থেকে আমাদের কাবু করে দেয়। আসুক না সামনাসামনি। কিন্তু ওসব কথা বলবে কে? কাপুরুষ কোথাকার! ভিতু কোথাকার! তবু জিতে যাচ্ছে, আমাদের মেরে ফেলছে। নিজের দেহে লোম নেই। আমাদের লোমশ ছালে দেহ গরম করছে। ছিঃ, লজ্জা করে না? লজ্জা নেই। আমরা শুধু মরছি। ওদের মতো তীরধনুক-গুলতি যে আমরা বানাতে পারি না। নিজের দেহের বাইরের কিছুই কাজে লাগাতে পারি না। হায়! আমাদের বাঁচার উপায় কি?
কিন্তু পশুদের একটা জিনিস ছিল। সে জিনিস মানুষের ছিল না। পশুরা জাদু জানত। অনেক জাদু। আর জাদু দিয়ে রোগ বানাতে জানত। জাদু দিয়ে তারা অনেক রকমের রোগ আবিষ্কার করেছিল।
সেই আদিকালে কোন রোগ-বালাই ছিল না। কোন মানুষ কখনও অসুস্থ হয়ে পড়ত না। অসুখের নামগন্ধ ছিল না। অন্য অনেক কষ্ট ছিল, কিন্তু অসুখের কষ্ট ছিল না। বড়ই সুখের দিন ছিল।
কিন্তু প্রতিশোধ নেবার জন্য পশুরা নানা ধরনের রোগকে পাঠাতে লাগল মানুষের গায়ের দিকে। এক একটা নতুন নতুন রোগ আবিষ্কার করে আর পাঠিয়ে দেয় মানুষদের কাছে। হায়! হায়! গাঁয়ে দেখা দিল হামজুর, সকাল-সন্ধে কাঁপুনি জ্বর, সর্দি-কাশি, হাঁটুর ব্যথা, পিঠের ব্যথা, বমি। আরও কত কি। সবচেয়ে সাংঘাতিক রোগ হল বাতের ব্যথা। কাজ না করলে খাবার আসবে কেমন করে? অথচ বাতের ব্যথায় কিছুই করা যায় না। মানুষজন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। গাল-গলা ফুলে যাওয়া রোগ কে পাঠিয়েছিল আমি বলতে পারব না। কিন্তু শোনা যায় বাতের ব্যথার রোগ পাঠিয়েছিল হরিণ। কেননা, সেই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী ছিল। সেই সবচেয়ে বেশি মারা পড়ত। রোগ আসছে, রোগ আসছে – রোগ বাড়ছে। ভীষণ প্রতিশোধ। লোক মরছে, লোক খোড়া হচ্ছে, অকেজো হচ্ছে। ভীষণ প্রতিশোধ। শেষকালে এমন হল, মানুষ বুঝি শেষ হয়ে যাবে। আর কেউ বেঁচে রইবে না।
মানুষ জানতেও পারেনি এমন সব রোগ এল কেমন করে। আগে তো ছিল না। অনেক ভাবল সে, কোন কুল-কিনারা করতে পারল না। কোন উপায় বের করতে পারল না । মরতে লাগল।
পশুদের মহা ফুর্তি। অনেক নিশ্চিন্ত তারা। আর কিছুদিন বাদেই একেবারে নিশ্চিত্ত হবে। ছাল ছাড়ানো বের করছি। সন্ধেবেলা গুহার মুখে বসে প্রায়ই তারা এসব আলোচনা করে।
সেই গুহার ওপরে ছিল আইভি লতার গাছ। একটা লতা বাড়তে বাড়তে গুহার মুখে ঝুলে পড়েছিল। পশুরাও খেয়াল করে না, গায়ে লাগলেও সেদিকে তাকায় না। বনের পশু— ওরকম কত লতাপাতা রোজ গায়ে লাগে।
সেই সবুজ লকলকে আইভি লতা একদিন পশুদের কথা শুনে ফেলল। সে আঁতকে উঠল। তাহলে? তাহলে পশুরাই রোগ পাঠিয়ে মানুষের এমন সর্বনাশ করছে? সে ভয়ও পেল। মন তার কেঁদে উঠল। সে শক্ত তালগাছকে বলে দিল। তাল গাছ কেঁপে উঠল। চুপিচুপি নিচু গলায় হাওয়াকে বলে দিল। হাওয়া দুলে উঠল। সে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মাঠের ঘাসকে বলে দিল। ঘাস পাশের নলখাগড়াকে বলে দিল। এই সাংঘাতিক খবর বনের আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। চুপিচুপি, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি। যেমন বনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বনের লতা-গাছ-ঘাস তখন এক সভা ডাকল। সবাই বেশ চিন্তিত। বনের মধ্যে ফাঁকা মাঠে বিরাট সভা বসল।
তালগাছ বলল, “আমার মনে হয়, মানুষকে এভাবে মরতে দেওয়া ঠিক হবে না। মানুষ মরছে পোকার মতো। এটা ঠিক নয়। কেননা, কেন যেন আমার মনে হচ্ছে মানুষ একদিন দারুণ কিছু করবে। অসাধারণ সব জিনিস-পত্তর বানাবে। ঠিক কি করবে আমি বলতে পারব না, কিন্তু বিরাট কিছু করবে। বেচারারা এখনও খুবই গরিব। সবাই পোশাক-আশাকও পরে না ঠিকই। কিন্তু একদিন তারা বাঘ আর দেবদারু গাছের মতোই বিরাট হবে, শক্তিমান হবে।
মুকুলের মতো সজীব। পশুর হাত থেকে ওদের বাঁচাতেই হবে।
আইভি লতা বলল, ‘আহা, ফুলের মতো উজ্জ্বল ওরা, ফুলের মতো হাসিখুশি ওরা। ওরা মরছে—খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।
সব গাছ পাতার শব্দ করে সায় দিল। ঠিক কথা, ঠিক কথা। মানুষকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু কয়েকটি লতা গাছ আর বিষাক্ত ছোট বাঁকড়া গাছ মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করল। না, তাদের সায় নেই। মানুষ যখন-তখন আমাদের কেটে শেষ করে দিচ্ছে। বিছুটি ভীষণ রেগে গেল। তাকেই বেশি মার খেতে হয়। সে রোয়া ফুলিয়ে বলল, ওসব মানি না। সুযোগ পেলেই আমি ওদের গায়ে বিষ ঢালব। লাল চাকাচাকা দাগ করে দেব। ফোস্কার মতো জ্বালা ধরিয়ে দেব। মানি না ওসব ভালো কথা।
দু-একজনের কথায় কেউ কান দিল না। শুধু রসাল আগাছা বলল, “আমি তক্ষুনি রস লাগিয়ে চাকাচাকা দাগ সারিয়ে তুলব। ওদের কথায় আর কোন কথা-কাটাকাটি হল না।
গাছ-গাছালি লতা-পাতা ঘাস-শ্যাওলা সবাই নিজের দেহের অংশ থেকে রোগের ওষুধ তৈরি করল। পাতা-ডাল-বাকল-শেকড় সব থেকেই ওষুধ তৈরি হল। শিখিয়ে দিল মানুষকে। পশুরা যে যে রোগ আবিষ্কার করছে, গাছপালা তারই ওষুধ তৈরি করে ফেলছে। মানুষ সেরে উঠছে। মানুষ বেঁচে যাচ্ছে।
ছেলেমেয়েরা, তোমরা যদি চোখ মেলে চেয়ে দেখ, দেখতে পাবে সব গাছ-গাছালি থেকেই ওষুধ তৈরি হয়। আমরা অনেক গাছের গুণ ভুলে গেছি। কিন্তু বাপ ঠাকুরদারা জানত। বিষাক্ত গাছ থেকেও ওষুধ তৈরি হয়। সব গাছেই ওষুধ তৈরি হয়। তাই সব গাছ আমাদের দেবতা। ওদের গায়ে আঘাত দিতে নেই। ওদের জন্যই আমাদের রোগ সারে।
ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড
0 coment�rios: