মানুষের পাপের ফলে আজ আর আমরা স্বর্গ দেখতে পাই না। মৃত্যুর আগে দেখতে পাই না। কিন্তু একদিন পেতাম। সেই দূরের স্বর্গের গোচরণভূমিতে গোরু চরাত এক রাখাল। সকালবেলা হলেই রাখাল গোরু নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। গোরুরা চরছে, সে গাছের নীচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। চারিদিকে সেই সংগীতের মিষ্টি সুর ছড়িয়ে পড়ত। মাঝে-মধ্যে গোরুরাও ভুলে যেত খাবার খেতে। রুপোলি বাঁশির সেই সুর আশেপাশের মেঘে আঘাত পেয়ে নানা সুরে ভেঙে পড়ত। সারাদিন বাঁশি বাজাত রাখাল। সে নিজেই যেন মিষ্টি গানে তৈরি।
স্বৰ্গদেবতার নয় মেয়ে। সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে রেশমি রঙের মেঘে মেঘ বোনে। মেঘ বুনে চলাই তার কাজ। আকাশে মেঘের কতরকম চেহারাই না আমরা দেখি। সবচেয়ে উজ্জ্বল রেশমি রঙের বুননের কাজ করে ওই মেয়ে।
একদিন এই কাজ করতে করতে মেয়ে আনমনা হয়ে গেল। আজ কেন যেন বড় একঘেয়ে লাগছে। আর ভালো লাগছে না। এদিকে-ওদিকে চেয়ে দেখছে, হাতের কাজ বন্ধ। চেয়ে রয়েছে আকাশি নদীর দিকে। টলটলে শীতল জল বয়ে চলেছে। মেয়ে ভাবল, 'আঃ, কি সুন্দর জল। স্নান করে আসি, তাহলে বোধহয় মন ভালো লাগবে।
যেন ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে ছুটে গেল মেয়ে। কেউ নেই। খুলে ফেলল তার দেহের পোশাক। সোনালি দেহ এলিয়ে দিল জলে। কি আনন্দ। মিষ্টি স্বর্গীয় গান ভেসে আসছে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে।
ঝোপের আড়ালে বসে ছিল রাখাল। জলের শব্দ হতেই পেছন ফিরে চাইল। এ কি রূপ? এ কি দেহের বরণ? এ কে? সোনালি গরু ফিসফিস করে বলল, “দেরি করো না, মেয়ের পোশাক লুকিয়ে ফেলো। গরু পাশে শুয়ে গান শুনছিল। আর দেরি নয়। রাখাল ছুটে গিয়ে পোশাক তুলে নিল হাতে, বুকের কাছে নিয়ে ঝোপে লুকিয়ে পড়ল।
অনেকক্ষণ স্নান করল মেয়ে। এবার জল ছেড়ে উঠে আসছে মেয়ে। সোনার বরণ মেয়ে। মেয়ে তীরে উঠে দেখে পোশাক নেই ! এধার-ওধার চাইল। সে বাড়ি ফিরবে কেমন করে? পোশাক কোথায় গেল। মেয়ে কাঁদতে শুরু করল।
ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রাখাল। মেয়ের সামনে এসে দাঁড়াল, হাতে তার রেশমি পোশাক। বলল, ‘ওগো মেয়ে, তুমি যদি আমায় বিয়ে করো, তবেই আমি পোশাক দেব, নইলে নয়। বল, বিয়ে করবে।
কান্না-ভরা লাল চোখ তুলে মেয়ে দেখল, এক পবিত্র কিশোর মিষ্টি মুখে দুষ্টুমি-ভরা চোখে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার সুন্দর গোলাপি ঠোঁটদুটো হাসির রেখায় ভরা। ‘মেয়ে, বিয়ে করবে না? কি সহজ সুরে কথা বলছে ছেলে। মেয়ে অবাক হল। বড্ড ছেলেমানুষ। বড়ো ভালো লাগছে। মেয়ের মনও সহজ। সোনার মেয়ে রাজি হল। অনেক স্বর্গীয় গরুর মাঝখানে তাদের বিয়ে হয়ে গেল।
দুটি রঙিন প্রজাপতি ঘর বেঁধেছে। কি সুন্দর তাদের মিলন, কি পবিত্র তাদের চারিদিক। এমনি করে দিন বয়ে যায়।
একদিন মেয়ে বলল, ‘ওগো কিশোর, এবার যে আমায় যেতে হবে। অনেকদিন রেশমি মেঘ দিয়ে মেঘ বোনার কাজ করিনি। বাবা হয়তো ভীষণ রেগে রয়েছে। এখন গিয়ে অনেক বোনার কাজ করে বাবার রাগ ভাঙাতে হবে। কতদিন করি নি কে জানে। এবার আমায় যেতে দাও, মেয়ের চোখে টলটলে শিশিরবিন্দু।
ছেলে দুঃখে ভেঙে পড়ল, ‘সোনার মেয়ে, আমি তোমায় আবার কবে দেখতে পাব? আবার কবে দেখা হবে?
মেয়ে বলল, “বছরে মাত্র একবার। সেদিন আমাদের দুজনের দেখা হবে। মেয়ে আর কিছু বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে বাড়ির পথে চলল।
না, মেয়েকে যেতে দেবে না রাখাল ছেলে। বুকভরা অভিমান। কেন যাবে আমায় ছেড়ে? পেছনে পেছনে চলল রাখাল। পেছন ফিরে তাকাল মেয়ে। তার সোনালি আঙুল তুলে নিষেধ করল। আসতে নেই, এসো না গো।
এগিয়ে চলেছে মেয়ে। পেছনে চলেছে ছেলে। দুজনের চোখেই টলটলে শিশিরবিন্দু। রাঙা ফুলের মতো চোখ মেলে মেয়ে বলল, ‘ওগো, এসো না, আসতে নেই, বাবা দেখলে রাগ করবে, বকবে। এসো না, সোনা ছেলে।
ছেলে এগিয়ে চলেছে। নিষেধ মানে না সে। বড় অবুঝ মেয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে জল-ভরা চোখে বলল, “আমাদের দেখা হবে। বছরে একবার। মাত্র একবার। যেদিন আকাশ-পথে রুপোলি ছায়াপথ দেখা দেবে, সেদিন আমাদের দেখা হবে। প্রতীক্ষার পরে মিলন হবে অনেক আনন্দের। তুমি বড় ছোট। বুঝবে কি এসব কথা? এসো না, আসতে নেই গো সোনা ছেলে?
একথা বলেই মেয়ে তার মাথার মেঘবরণ কেশগুচ্ছ থেকে খুলে নিল একটা চুল বাঁধবার সুন্দর কাঁটা। তাই দিয়ে ফুলের পাঁপড়ির মতো সুন্দর আঙুলে মেঘের ওপরে দাগ কেটে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বয়ে গেল একটা রুপোলি নদী, আকাশপথে ছায়াপথ। রুপোলি নদীর ওপারে স্বর্গীয় রাখাল আর এপারে মেঘকন্যা। দুজনের বিচ্ছেদ হল। ছেলে তাকিয়ে রইল মেয়ের দিকে, মেয়ে ছেলের দিকে। হাওয়ায় যেমন করে গাছের পাতা ঝুরুঝুরু কাঁপে, তেমনি কাঁপা হাতে বিদায় জানাল মেয়ে। ছেলে দাড়িয়ে রইল। কোন কথা বলল না, বিদায় জানাল না। মেয়ে এগিয়ে গেল।
প্রতিবছর আকাশে একবার ছায়াপথ দেখা দেয়। সেদিন পৃথিবীর যত দোয়েল পাখি আছে তারা ডানা মেলে উড়ে আসে। রুপোলি নদীর ওপরে। ডানা মেলে ভেসে থাকে রুপোলি নদীর সবখানে।এপার থেকে ওপারে। তারা যে এই প্রেমিক-প্রেমিকাকে ভালোবাসে। ছেলে অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটির জন্য, মেয়ে অপেক্ষা করে থাকে এই দিনটির জন্য। পাখির সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যায় ছেলে, দৌড়ে যায় সোনা ছেলে। ওপারে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সোনার বরণ মেঘকন্যাকে। এই একদিনের জন্য।
বাছারা, তোমরা দেখবে আকাশে যেদিন ছায়াপথ দেখা দেয়, প্রায় বছরেই সেদিন বৃষ্টি পড়ে। এ কিন্তু অন্যদিনের মতো বৃষ্টি নয়। দুজনে মিলিত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদেরই চোখের জল মেঘের পথ বেয়ে নেমে আসে। মিলনের মুহুর্তে আবার বিচ্ছেদের ভাবনায় তারা কাঁদে দুটি স্বর্গীয় প্রেমিক-প্রেমিকা কোন ভুলে-যাওয়া কাল থেকে মিলিত হচ্ছে আর কাঁদছে।
0 coment�rios: