পাহাড়ের কোলে বিরাট বন। নানা জাতের গাছ-গাছালি। সেই বনে ছিল একটা কাঠবাদামের গাছ। মস্ত উঁচু। সব গাছের মাথা ছাড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডালপালায় ভরা গাছ। অনেক বয়েস হয়েছে। বুড়ো গাছ। অনেক কিছু দেখেছে সে।
শরৎকাল এসে গেল। ডালে ডালে কাঠবাদাম। কাঠবাদামে ছেয়ে গিয়েছে গাছ। বাদামি রং ধরেছে ফলে। ফলগুলো সব পেকে উঠেছে। গাছ আরও সুন্দর হয়েছে।
পাশেই থাকত এক কাঠবেড়াল। ঝড়ে ভেঙে-পড়া একটা মরা গাছের কোটরে সে থাকত। ঢোকার মুখটা ছোট, কিন্তু ভেতরে বিরাট ঘর। কাঠবেড়াল তরতর করে কাঠবাদামের গাছে উঠে পড়ল। ফল পড়তে লাগল নীচে। যা ধারালো দাঁত! দাত বসাচ্ছে আর ফল পড়ছে নীচে। সব বাদাম শেষ। গাছে আর একটাও ফল নেই। নীচে নেমে এল সে। খুব তাড়াতাড়ি এক জায়গায় জড়ো করল ফলগুলো। কান্না-কান্না গলায় গাছ বলল, “বন্ধু কাঠবেড়াল, সব ফল নিয়ে যেয়ো না। একটা ফল গাছের নীচে রেখে দাও। একটিমাত্র ফল। বুড়ো হয়েছি। বনে তো এ গাছ আর নেই। আমি মরে গেলে কেউ রইবে না। বাচ্চা একটা চারা গজিয়ে উঠুক। আমার সত্তান। দোহাই তোমার, সব নিয়ে যেও না। একটা ফল রেখে দাও।
‘ওসব হবে না। কারও কথা ভাববার সময় নেই। এই তো শীত আসছে। বরফ পড়বে, বরফের ঝড় বইবে। তখন খাব কি? বাইরে যাব কেমন করে? ওসব শুনছি না। না খেতে পেয়ে মরলে তুমি দেখবে? কেউ দেখে না। কাঠবেড়াল লেজ তুলে মুখঝামটা দিল।
একটা কাঠবাদামের খোলা ভাঙে আর মুখে করে গাছের কোটরে রেখে আসে। কাঠবেড়াল ভীষণ ব্যস্ত। খোলাগুলো জমে উঠেছে। অনেক খোলা, খোলা বেড়েই চলেছে। কোনদিকে তাকাচ্ছে না সে, শুধু এক কাজ।
ঝাপসা চোখে গাছ,
ঘন পাতার গাছ,
দেখছে নীচে ফল,
ফেলছে চোখের জল।
হঠাৎ ঘন ঝেপের আড়াল থেকে তীরের বেগে ছুটে এল একটা খেঁকশেয়াল। কাঠবেড়াল তার দাঁতে আটকে গেল। খেঁকশেয়াল মেরে ফেলল কাঠবেড়ালকে, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
ঝাপসা চোখে গাছ,
ঘন পাতার গাছ,
দেখছে নীচে ফল,
ফেলছে চোখের জল।
হঠাৎ গাছের ফাঁক থেকে লাফিয়ে পড়ল একটা বুনো নেকড়ে। ছটফট করল খেঁকশেয়াল। বুনো নেকড়ে মেরে ফেলল খেঁকশেয়ালকে, যে খেকশেয়াল মেরেছিল কাঠবেড়ালকে, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
ঝাপসা চোখে গাছ,
ঘন পাতার গাছ,
দেখছে নীচে ফল,
ফেলছে চোখের জল।
আধবোজা চোখে নেকড়ে হাড় চিবোচ্ছে। আর খিদে নেই। পেট ভর্তি। তবু হাড় চিবোচ্ছে। আঃ! একটু জিরিয়ে নিয়ে গুহায় ফেরা যাবে।
হঠাৎ একটা হলুদ তীর ছুটে এল। চিতা লাফিয়ে পড়েছে নেকড়ের দেহের ওপর। কামড়ে ধরেছে নেকড়ের গলা। ঝটাপটি, মারামারি। নেকড়ে নিথর হয়ে গেল। চিতা মেরে ফেলল নেকড়েকে, যে নেকড়ে খেঁকশোয়ালকে মেরেছিল, যে খেকশেয়াল কাঠবেড়ালকে মেরেছিল, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
ঝাপসা চোখে গাছ,
ঘন পাতার গাছ,
দেখছে নীচে ফল,
ফেলছে চোখের জল।
খাচ্ছে, খাচ্ছে, চিতা মাংস খাচ্ছে। তুলতুলে মাংস, রক্তমাখা নরম মাংস। পেট ভরে গেল। যাওয়ার তাড়া নেই। চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে রইল গাছের নীচে। গাছের পাতা কাঁপছে। ঘন পাতার ছায়া। আবামে চোখ বন্ধ হয়ে এল চিতার। সে ঘুমিয়ে পড়ল ।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। অনেক বয়েস হয়েছে গাছের, আর তেমন শক্তি নেই। হাওয়ার তেজ সহ্য করতে পারল না। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল গাছ। ঠিক চিতার পেটের ওপর। চিতা তক্ষুনি মরে গেল, যে চিতা নেকড়েকে মেরেছিল, যে নেকড়ে খেঁকশেয়ালকে মেরেছিল, যে খেঁকশেয়াল কাঠবেড়ালকে মেরেছিল, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
কোথা থেকে আকাশে মেঘ জমল। মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের আলো। হঠাৎ বাজ পড়ল নীচে, কাঠবাদাম গাছের ওপর। দাউ দাউ জ্বলে উঠল কাঠবাদাম গাছ, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গাছ, যে গাছ চিতার ওপর পড়েছিল, যে চিতা নেকড়েকে মেরেছিল, যে নেকড়ে খেঁকশেয়ালকে মেরেছিল, যে খেঁকশেয়াল কাঠবেড়ালকে মেরেছিল, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
বাজের আওয়াজ আর বিদ্যুতের চমকানো থেমে গেল। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। চারিদিকে অাঁধার-করা বৃষ্টি। ছাই পচে গেল। শেষকালে একদিন গাছ মাটির সঙ্গে মিশে গেল, যে গাছে বাজ পড়েছিল, যে গাছ চিতার ওপরে পড়েছিল, যে চিতা নেকড়েকে মেরেছিল, যে নেকড়ে খেঁকশেয়ালকে মেরেছিল, যে খেঁকশেয়াল কাঠবেড়ালকে মেরেছিল, যে কাঠবেড়াল কাঠবাদাম খাচ্ছিল।
মাটি ভিজে রয়েছে। বর্ষাকাল। বর্ষার জলে, পচে-যাওয়া গাছের ছাইয়ে সেখানকার জমি আরো ভালো হল। উর্বর হল। এল বসন্ত। সেই জমিতে অনেক কাঠবাদামের গাছ। কচি ডাল, সবুজ পাতা। অনেক ফল ছড়িয়ে ছিল সেই গাছের নীচে। আজ গাছের অনেক ছোট্ট চারা। সেখানে কাঠবাদামের বন হয়ে গেল। ঘন বন। অনেক বাদামের গাছ। কাঠবাদাম গাছের সন্তান।
সেই থেকে বনে বনে কাঠবাদামের গাছের বন হল। একটা কাঠমাদামের গাছ তাই তোমরা কখনও দেখতে পাবে না। ওরা ডালে ডালে লেগে থাকে, এক গাছের ডাল অন্য গাছে। আর তো একা নয়, তাই ভয়ও নেই।
ডাউনলোড PDF : ডাউনলোড
0 coment�rios: