কুকুর একসময় বনেই থাকত। সে ছিল বুনো কুকুর। অন্য বুনো পশুদের সে খুব ভয় করত। ভাবত, তাদের সঙ্গে বোধহয় পেরে উঠবে না। ওরা হিংস্ৰ ! তাই লুকিয়ে - চুরিয়ে কুকুর একা একাই বনে থাকত। তার কোন বন্ধু ছিল না। একা, একেবারে একা। কিন্তু এ জীবন তো আর ভালো লাগে না। সবাই একসঙ্গে থাকে, সবারই বন্ধুবান্ধব আছে। সেই শুধু একা। এবার সে বন্ধু পাতাবেই কারও-না-কারও সঙ্গে।
এই ভেবে সে তার নির্জন গুহা থেকে বেরিয়ে পড়ল। যা থাকে কপালে। পথে এক ঝোপের পাশে দেখা হল এক খরগোশের সঙ্গে। তাকে দেখেই কুকুর বলল, ‘বন্ধু, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। এসো, আমরা একসঙ্গে থাকি। এক বাড়িতে।
খরগোশ কান খাড়া করল। কুকুরকে বুঝতে চেষ্টা করল। সব বুঝে বলল, “বেশ তো ভালোই। একসঙ্গে থাকি।ঠিক হল তারা কুকুরের আস্তানাতেই থাকবে। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে আস্তানায় পৌছল। অনেক হাসি, অনেক আনন্দ। অনেক জমানো কথা। শেষকালে দিনের আলো কমে এল, সূর্য পাহাড়ের ওপারে ঢলে পড়ল। দুজনে দুপাশে শুয়ে পড়ল।
মাঝ রাত্তির। চারিদিকে কোন সাড়া-শব্দ নেই। মাঝে মধ্যে দু-একটা পাখি শুধু চেঁচিয়ে উঠছে। বোধহয় ভয় পেয়েছে। হঠাৎ কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে লাগল। খরগোশের ঘুম গেল ভেঙে। লাফিয়ে উঠে সে বসল, কানদুটো সোজা হয়ে আছে। বেচারা বড় ভয় পেয়েছে।
‘বন্ধু, তুমি চেঁচাচ্ছ কেন? থাম, থাম। এক্ষুনি নেকড়ে শুনতে পাবে। আর শুনলে রক্ষা নেই। এসে দুজনকেই শেষ করবে। খরগোশ ফিসফিস করে বলল।
কুকুর ভাবল, ‘হায় কপাল। আমি তো ঠিক বন্ধু জোটাতে পারি নি? আমি ভয়ে মরি, ভাবলাম সাহসী বন্ধুর আশেপাশে থাকব, তা না এ আমার চেয়েও ভিতু। এ বন্ধু চলবে না। আমার মনে হচ্ছে, নেকড়ে নিশ্চয়ই কাউকে ভয় পায় না । এই ভেবে কুকুর গুহা থেকে বেরিয়ে গেল। চলল নেকড়ের সন্ধানে।
কুকুর লেজ নেড়ে চলেছে পথে। হঠাৎ দেখা নেকড়ের সঙ্গে। কুকুর একটু ভয় পেল, তবু সাহস করে বলল, “বন্ধু, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। এসো, আমরা একসঙ্গে থাকি। এক বাড়িতে।
নেকড়ে বলল, “মন্দ কি ! বেশ তাই হবে। ঠিক হল তারা নেকড়ের গুহাতেই থাকবে। তারা দুজনে গুহায় ঢুকল। অনেক হাসি, অনেক আনন্দ। অনেক জমানো কথা। শেষকালে দিনের আলো কমে এল, চারিদিকে অন্ধকার। দুজনে পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।
�মাঝ রাত্তির। হঠাৎ কুকুর চিৎকার করে উঠল। ঘেউ ঘেউ শব্দে নেকড়ের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভীষণ ভয় পেয়ে কুকুরকে বলল, “বন্ধু চেঁচাচ্ছ কেন ? এই রাত্তিরে? এক্ষুনি শব্দ শুনতে পাবে পাহাড়ি ভালুক। তাহলে আর রক্ষে নেই। এক্ষুনি দুজনকেই পেটে পুরে দেবে। চেঁচিয়ো না।
কুকুর মনে মনে ভাবল, ও বাবা, এও দেখছি আমার মতো ভিতু। আমি তাকে যা ভেবেছিলাম নেকড়ে তো তা নয়। সে আবার পাহাড়ি ভালুককে ভয় পায়। ঠিক বন্ধুত্ব হয় নি। তাহলে বুঝতে পারছি পাহাড়ি ভালুকই সবচেয়ে সাহসী।
কুকুর বেরিয়ে এল গুহা থেকে। পাহাড়ি ভালুকের সন্ধানে। যাচ্ছে যাচ্ছে, কুকুর কান খাড়া করে চলেছে। হঠাৎ দেখা এক পাহাড়ি ভালুকের সঙ্গে। কুকুর বেশ ভয় পেল, তবু বলল, “বন্ধু, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। এসো, আমরা একসঙ্গে থাকি। এক বাড়িতে।
ভালুক সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘এতে আর আপত্তি করার কি আছে। বেশ তাই হবে।
ঠিক হল, তারা থাকবে ভালুকের গুহায়। দুজনে গেল পাহাড়ি গুহায়। অনেক হাসি, অনেক আনন্দ। অনেক জমানো কথা। শেষকালে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তারা পাশাপাশি শুয়ে পড়ল।
মাঝ রাত্তির। চারিদিক নিঝুম। হঠাৎ কুকুর ডেকে উঠল। ঘেউ ঘেউ শব্দে পাহাড়ি ভালুকের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভয়ে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, ও কুকুর, তুমি চেঁচাচ্ছ কেন? এই ডাক শুনতে পেলে এখুনি শিকারি মানুষ ছুটে আসবে। আমাদের দুজনকেই শেষ করে দেবে। ওদের হাতে তির-ধনুক আর বর্শা আছে। চেঁচিয়ো না।
কুকুর আকাশ থেকে পড়ল। এ কি হল? যাকে সে ভেবেছিল সবচেয়ে শক্তিমান, যার ওপরে তার ছিল এত আশা—সে-ও ভয়ে কাঁপছে? পাহাড়ি ভালুক কাউকে ভয় পায় না, সে তো তাই ভেবেছিল। ভাবনাটা ঠিক নয়। ঠিক বন্ধুত্ব হয়নি। এ রকম বন্ধু তার দরকার নেই। মনে হয়, মানুষই সেই বন্ধু যে কাউকে ভয় করে না। চলল মানুষের সন্ধানে।
যেতে যেতে শেষকালে সে একজন মানুষের দেখা পেল। অনেক দূরে। সে শিকারি মানুষ। তাকে দেখেই কুকুর লেজ নেড়ে বলল, “বন্ধু, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। এসো, আমরা এক সঙ্গে থাকি। এক বাড়িতে।
মানুষ বলল, "বাঃ, ভালোই তো। বন্ধু সবসময়েই ভালো। যত বন্ধুত্ব হয় ততই ভাল। ঠিক হল, তারা দুজনে শিকারির তাঁবুতে থাকবে। ছোট তাঁবু, কিন্তু সবকিছু গোছানো। মাঝ রাত্তির। শিকারি এবার ঘুমোতে গেল। সারাদিন সে অনেক পরিশ্রম করেছে। কুকুরও ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ কি যেন কেন কুকুর চিৎকার করে উঠল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে শিকারি জেগে উঠল। বিছানা থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর কুকুরকে বলল, “বন্ধু, তোমার কি খিদে পেয়েছে? তাঁবুতে খাবার কিছু নেই। তুমি অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ো। শিকার ধরে আনো। বিপদে পড়লে আমাকে ডাকবে। তির-ধনুক-বর্শা আমার পাশেই আছে। ভয় নেই। আমিও কাউকে ভয় পাই না। কিন্তু শুধু শুধু ঘেউ ঘেউ করে আমার ঘুম ভাঙিয়ো না। ভয়ের কি আছে?
কুকুর আনন্দে লেজ নাড়তে লাগল। হাঁ, এতদিনে সে সত্যিকারের বন্ধু পেয়েছে। যে ভয় করে না, যে বিপদ দেখে পালায় না, যে ফিসফিস করে কথা বলে না। যাক শেষকালে ঠিক বন্ধু সে পেয়েছে।
কুকুর মনে মনে ঠিক করল, সে মানুষের কাছেই থেকে যাবে। আর কোথাও যাবে না। আজও সে মানুষের পাশেপাশেই রয়েছে। কোনদিন ছাড়াছাড়ি হয়নি।
0 coment�rios: