গাছ-গাছালির মধ্যে ছোট্ট একটা বাড়ি। গাছের ডালপালা আর পাতা দিযে তৈরি। সেই বাড়িতে থাকত এক মেয়ে। তার নাম ডিরিরি। তার চার মেয়ে। সবাই খুব ছোট। মায়ের বয়েসও বেশি নয়। চার মেয়ের বাবা নেই। বুমেরাং নিয়ে বাবা একদিন শিকারে গেল। আর ফিরল না। শিকার করতে গিয়েই সে মারা গেল। মা এখন বিধবা।
ডিরিরির বড় কষ্ট। সারাদিন খাটে, কাজ করে। নিজে হয়তো সারাদিন কিছুই খেল না। কিন্তু মেয়েদের খুব যত্নআত্তি করত। তার সাধ্যমতো সে মেয়েদের ভালোভাবে রেখেছিল। আহা! বাপ-মরা ছোট ছোট শিশু। ওদের যেন কষ্ট না হয়। মায়ের প্রাণ কাঁদত।
বড় বলতে বাড়িতে সে একা। আশপাশে কোন পড়শিও নেই। তাই মেয়েদের নিয়ে মা খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। রাত হলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও ভয়। ডিরিরি ভাবত,—এই বুঝি বিপদ এল। মেয়েদের কথা ভেবে চমকে উঠত। তার শুধুই বিপদের ভয়। তাই বাড়ি থেকে কখনও সে বেশি দূরে যেত না।
এমনি করে ভয়ে-দুঃখে-কষ্টে তার দিন কাটে। সে ভাবে, কতদিনে যে মেয়েরা বড় হবে? বড় হলে তবে নিশ্চিত্ত।
এই সময় তার বাড়ির খুব কাছে একটা বাড়ি তৈরি হল। সারাদিন খেটেখুটে লোকটা বাড়ি তৈরি করল। ডিরিরি সেদিন বাইরেই বের হল না। মেয়েদের কাছে নিয়ে ঘরেই বসে রইল। সব দেখতে পেল ঘর থেকেই। সবসময় বুক কাঁপতে লাগল। এবার বুঝি সর্বনাশ হবে। কে যে এসে বাড়ি করল? কেন, দূরে তো অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। এখানে আসার কি দরকার ছিল? কিন্তু এসব মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছুই বলতে পারল না।
নতুন বাড়ি করেছে একটা পুরুষ। তার নাম বিববি। সে একা। চারদিকে আঁধার হয়ে এল। রাত হল। ডিরিরি মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে জেগে বসে রইল। শুতে পর্যন্ত পারল না। ভয়ে বুক টিপঢিপ করতে লাগল। ভয় বেড়েই চলল। আর সহ্য করতে পারছে না সে। যদি কিছু হয়? ডিরিরি ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘হায়! হায় ! ডিরিরি। সারা রাত ধরে এমনিভাবে সে কেঁদে গেল। কান্না তার থামে না।
শেষকালে আলো ফুটল, মেয়েরা জেগে উঠল। দরজা খুলতেই সে দেখতে পেল, বিববি তার বাড়ির দিকে আসছে। বেশি করে বুক কাঁপতে লাগল তার।
অমন করে কাঁদছিলে কেন? আধার রাতে অমন করে কাঁদতে আছে? কি হয়েছিল?
ডিরিরির চোখ ফোলা, চোখ লাল। সারা রাত সে ঘুমোয় নি। ধরা গলায় বলল, সারা রাত জেগে বসেছিলাম। মনে হল, কে যেন বাড়ির চারপাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। শুধু পায়ের শব্দ, খুব ভয় হচ্ছিল। বুক কাঁপছিল। আগে কোনদিন এমন পায়ের শব্দ শুনিনি। গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল তার।
বিববি বলল, ‘তুমি তো একা নও, সঙ্গে রয়েছে তোমার চার মেয়ে। পাঁচজন থাকতে ভয়ের কি আছে? মিছিমিছি ভয়।
দিন কাটল। এদিনও মা বাড়ি থেকে বেশি দূরে গেল না। ভয় তার কাটেনি। বিকেল যত গড়িয়ে যাচ্ছে, তার ভয়ও বেড়ে যাচ্ছে। এমনি করে অাঁধার নামল। গাছের সারির ওপারে সূর্য ডুবে গেল। আবার শুরু হল তার কান্না। একটানা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে, ‘হায! হায়! ডিরিরি। সারা রাত এমনিভাবে সে কেঁদে চলল।
বিববি শুনছে তার কান্না। সারা রাত। সে-ও ঘুমোতে পারল না। শেষকালে সকাল হলেই বিববি ডিরিরির বাড়িতে চলে এল। এসেই বলল, ‘কালও তো সারা রাত কেঁদেছ শুনতে পেলাম। ভয়? আমায় বিয়ে করো। আমি থাকব তোমার কাছে। আর ভয় পাবে না।
ডিরিরি মেয়েদের দিকে চেয়ে দেখল। কেমন মনে হল। মাথা নেড়ে সে 'না' বলল। ডিরিরি তাকে বিয়ে করতে পারবে না। মুখে আর কিছু বলল না।
বিববি আর কিছু না বলে চলে গেল। সে মাঠের মাঝখানে গিয়ে কাজ করতে লাগল। একমনে কাজ করছে সে। সে একটা সুন্দর ধনুক তৈরি করল। ধনুকে অনেকগুলো রং। চোখ-জুড়ানো রং। আকাশের একদিক থেকে অন্যদিকে ছড়িয়ে-পড়া ধনুক। এই ধনুক পৃথিবী থেকে তারার দেশে যাওয়ার রঙিন পথ। আঃ, কি সুন্দর।
ডিরিরি আকাশ পানে চেয়েই ভয়ে কাপতে লাগল। সব জিনিসেই তার ভয় । আর এমন অবাক-করা বিশাল ধনুক সে আগে কখনও দেখেনি। তার বুক আরও কাঁপতে লাগল। যদি বাছাদের কিছু হয়? সে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল। ‘হায়! হায় ! হায় !
ডিরিরি এদিক-ওদিক চাইল। আহা, যদি বিবরিকে দেখতে পেত। মনে সাহস পেত। বড় একা একা লাগছে। কিন্তু এধারে-ওধারে কোথাও সে বিবরিকে দেখতে পেল না। সে তখন কোথায় কোন বনে চলে গিয়েছে ডিরিরি তা জানে না। জলা-ভরা চোখে তবু সে পড়শিকে খুঁজতে লাগল। ডিরিরি আকাশের ওই দৃশ্য আর সহ্য করতে পারছে না। এবার বোধহয় তার বুক ফেটেই যাবে। সে চার মেয়ের হাত ধরে অল্প দূরে পড়শির বাড়ির দিকে হাঁটছে আর বারবার আকাশে ও পেছনের দিকে চাইছে, শেষকালে কোনরকমে বিববির বাড়ির সামনে এল।
উঁকি মেরে দেখল, বিববি ঘরে বসে রয়েছে। একটা বুমেরাং বানাচ্ছে। ডিরিরি কাদতে কাঁদতে বলল, ওটা কি? কেন হল? এখন কি করি?
বিবরি ঠোঁটের কোণে একটু হেসে বলল, “কি, ওই রামধনু? ও তো আমিই বানিয়েছি। তাহলেই বুঝে দেখ, আমি কত শক্তিমান। দেহে কত শক্তি থাকলে ওরকম বড় জিনিস বানানো যায়। তাইতো বলছি, আমায় তুমি বিয়ে করো, তোমার কোন ভয় নেই, কোন বিপদ আসতে দেব না। ভয়ে ভয়ে দিন আর রাত কাটাতে হবে না।
ডিরিরি কিছুই বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে চাইছে, আবার বিবরিকে দেখছে। মুখে কিছুই বলছে না।
বিবরি বলল, আর যদি বিয়ে না করো তবে এমন জিনিস বানাবো যা আরও অবাক করা। সেই জিনিসটা এমন সাংঘাতিক হবে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ বাঁচবে না। তাও আমি পারি।
ডিরিরি কাঁপতে লাগল। তাহলে তো তার মেয়েরা মরে যাবে। সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। হ্যাঁ, সে বিবরিকে বিয়ে করবে। বিববির চোখেমুখে হাসি ঝরে পড়ল।
সেইদিন ঘন গাছের নীচে ডিরিরি আর বিববির বিয়ে হয়ে গেল। বিববির চোখে হাসি। মেয়েরা বাবা-মাকে ঘিরে আনন্দ করছে। অনেকদিন তারা এমন প্রাণ খুলে বাইরে দৌড়াদৌড়ি করেনি।
অনেক অনেক কাল তারা সুখে-শাস্তিতে সংসার করল। কত নিশ্চিত্ত ডিরিরি, কত আনন্দ বিববির।
শেষকালে তারা একদিন বুড়ো হয়ে মারা গেল। মরবার পরে দুজনেই হয়ে গেল পাখি। ডিরিরি হল খঞ্জন পাখি। দুরন্ত গরমের নির্জন রাতে ডিরিরি আজও খঞ্জন পাখি হয়ে ডেকে চলে, ‘হায়! হায়! ডিরিরি ! হায়! ডিরিরি? ভয়ে একদিন সে যেভাবে কাঁদত, খঞ্জন পাখি হয়েও সে ভয় সে ভুলতে পারেনি। তাই আজও খঞ্জন পাখি ওভাবেই ডেকে চলে অাঁধারে ।
আর বিববি হল কাঠঠোকরা। উঁচু উঁচু গাছের মাথায় বাকলে নখ ঢুকিয়ে সে ঠুকরে চলে শক্ত গাছ। শক্ত ঠোঁটে আঘাত করে করে সে-ও চায় আর একটা রামধনু তৈরি করতে। পৃথিবী থেকে তারার দেশে ছড়িয়ে পড়বে সেই ধনুক। পারছে না, তাই বেদনায় আঘাত করে চলেছে। আজও তার সেই কাজের বিরাম নেই। রামধনু সে বানাবেই। আর একটা।
গল্পটি পড়া শেষ! গল্পটি কি সংগ্রহ করে রাখতে চাও? তাহলে নিচের লিঙ্ক থেকে তোমার পছন্দের গল্পটি ডাউনলোড করো আর যখন খুশি তখন পড়ো; মোবাইল, কস্পিউটারে কিংবা ট্যাবলেটে।
0 coment�rios: