সে অনেক কাল আগের কথা। এক বিধবা মাযের একটিমাত্র ছেলে ছিল। মা বিধবা, তাই ছেলেকে নিয়ে থাকত বাপের বাড়িতে। ছেলেটির ছয় মামা। এমনি করে দিন যায়।
পাহাড়ি নদীতে ঢল নেমেছে। নীচের দিকে টলটলে জল তরতর করে বয়ে চলেছে। মামারা বলল, "চলো ভাগ্নে, মাছ ধরতে যাই। বাঁশের ফাঁদ পেতে আসি। ছেলের মহাফুর্তি। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি।
ছয় মামা নদীর ওপারের দিকে সুন্দর করে বাঁশের জালের আটল বাঁধল। সুন্দর ফাঁদ তৈরি হল। এ ফাঁদ এমনই, মাছ ঢুকবে কিন্তু বেরুতে পারবে না। ছেলেটি কিছুটা নীচের দিকে জালের আটল বাঁধল। সেখানে খুব স্রোত। সে ছোট, ভালো কাজ জানে না। যেমন তেমন করে ফাঁদ পেতে বাড়িতে ফিরে এল।
পরের দিন সকাল হতেই সাতজন গেল তাদের নিজের নিজের ফাঁদের কাছে। আশ্চর্য। তার মামারা কতো ভালোভাবে ফাঁদ পেতেছিল, কিন্তু বাঁশের জালে আটকে পড়েছে কয়েকটা কুচো চিংড়ি। আর কোন মাছ নেই। আর ছেলেটির বাঁশের জালে মাছ ভর্তি। অনেক মাছ। তাদের ছটফটানিতে এই বুঝি জাল ভেঙে যায়। মামারা অবাক হল। মামারা বলল, ‘ভাগ্নে, এবার আমরা এখানে ফাঁদ পাতি। তুই আরও নীচে নেমে যা। ওইখানে ফাঁদ পেতে রাখ। ভাগ্নে রাজি। মামারা ভাগ্নের জায়গায় ফাঁদ পাতল। খুব ভালোভাবে আটল বাঁধল। অনেকক্ষণ ধরে কাজ করল। ছেলেটি নদীর নীচের দিকে অনেকটা নেমে গেল। সেখানে আরও বেশি স্রোত। পা রাখাই দায়। পরের দিন সকালে সেই একই কাণ্ড। আরও মজার কাণ্ড। আজ মামাদের ফাঁদে একটা মাছও ঢোকেনি। একটা কুচো চিংড়িও নয়। আর ছেলেটির ফাঁদভর্তি মাছ। চকচকে রুপোলি মাছে তার ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেল। মামাদের চ্যাঙারি শূন্য।
এমনি করে মামারা প্রতিদিন নতুন করে ভাগ্নের জায়গায় ফাঁদ পাতে, আর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দেয় নদীর আরও নীচের দিকে। সকালে ছেলেটির ঝুড়ি ভরে যায় মাছে, মামারা পায় অল্প কিছু মাছ। কোনদিন কিছুই পায় না। প্রত্যেক দিন ছেলেটিকে জায়গা পালটাতে হয়। একদম ভালো লাগে না। কিন্তু কি করবে সে? সে যে ছোট, মামারা বড়। সে যে বিধবা মায়ের অনাথ ছেলে।
এমনি করে দিন যায়। শেষকালে নতুন নতুন জায়গায় ফাঁদ পেতে ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে গেল। এক কাজ নিত্যিদিন ভালো লাগে? একদিন সে রেগেমেগে জলের তলায় আর ফাঁদ পাতল না। এক জায়গায় বড় বড় ঘাসের ঘন ঝোপ হয়ে ছিল। তার মধ্যে বাঁশের ফাঁদটিকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল। মামারা জানে না ভাগ্নে কোথায় রেখেছে তার ফাঁদ।
পরের দিন সকালে মামারা ভাগ্নেকে ডাকল। নদীর কাছে যেতে হবে। ফাঁদে কেমন মাছ পড়ল দেখতে হবে। ছেলেটি অনেক দিন পরে মুখ খুলল। বলল, কালকে তো আমি ফাঁদ পাতি নি। আমার ফাঁদ জলের তলায় বসাই নি। ঠিক আছে, আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি। এমনি যাচ্ছি। মামারা খুশি হল। ছেলেটি মামাদের পেছন পেছন চলল।
নদীর তীরে এসে মামারা নামল জলে। আর ছেলেটি গেল ঘন ঘাসের ঝোপের কাছে। আরে! ভেতরে একটা বনের ঘুঘু পাখি ! ঠোঁট দিয়ে বাঁশের সরু কাঠিগুলো ভাঙার চেষ্টা করছে। ছেলেটি বুনো লতা ছিড়ে আনল। হাত ঢুকিয়ে ঘুঘুকে বের করল আর তার পায়ে লতার ফাস দিয়ে আনন্দে চলল বাড়ির দিকে। আজ সে নতুন কিছু ধরেছে। খুব ভালো লাগল তার।
এই অনাথ ছেলেটির ছিল গোরুর একটা বাছুর। যেমন নাদুস-নুদুস তেমনি মসৃণ চিক্কণ কোমল তার দেহ। অমন সুন্দর বাছুর এ এলাকায় আর কারও ছিল না। ছেলেটি খুব ভালোবাসত তাকে। মামারা হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে যেত। তাদের বাছুরগুলো কেন ও রকম সুন্দর নয়? একদিন সুযোগ পেল তারা। ছেলে গিয়েছে বনে। তারা বাছুরটাকে মেরে ফেলল। হিংসে বেশি হলে মানুষ সব পারে।
ছেলে বাড়ি ফিরে দেখে, পাশের বাঁশঝাড়ে তার বাছুর পড়ে রয়েছে। মাটি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। কি আর করবে সে! বসে বসে বাছুরের ছাল ছাড়িয়ে ফেলল। কষ্ট হল মনে, কিন্তু উপায় কি? বাছুরের একটা ঠ্যাং কেটে ফেলল। সেটা নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখল এক ধনীর বাড়ির গোলাঘরের নীচে। এই লোকটির খুব দেমাক, সে নাকি খুব উঁচুজাতের মানুষ। গোরুর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, ছোঁয়ও না।
ছেলেটি তার বাড়ির এপাশ-ওপাশ ঘুরছে, এমন সময় দেখা হল ধনী লোকটির সঙ্গে। মুখোমুখি হতেই ছেলেটি বলল, “এঃ, আপনার বাড়ির ভেতর থেকে কেমন যেন গোরুর মাংসের গন্ধ ছড়াচ্ছে।
ভীষণ চটে গেল সে। এতবড় কথা? রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "শয়তান হতচ্ছাড়া বদমাইস কোথাকার। আমার বাড়িতে গোরুর মাংসের গন্ধ? তোর খুব আস্পর্ধা বেড়েছে। আমি হলাম গিয়ে উঁচুজাতের লোক। আমি কি ওসব খাই? হতচ্ছাড়া পাজি, তোকে বাঘ খায় না কেন? খোঁজ। খুঁজে দেখ। কোথায় গোরুর মাংস। যদি খুঁজে না পাস, তোকে মেরেই ফেলব। এতবড় কথা! রাগে সে কাঁপছে দুলছে। ঠিক আছে, খুঁজে দেখি। বোকা-বোকা চোখে ছেলেটি বলল। এমন ভাব করল যেন সে কিছুই জানে না।
ছেলেটি আলগা পায়ে উঠোনের মধ্যে ঢুকল। এলোমেলো এধার-ওধার ঘুরতে লাগল। নাঃ, পাওয়া তো যাচ্ছে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধনী মানুষটি। আস্তে আস্তে তার মুখে হাসি ফুটছে। ছেলেটি কোমর বেঁকিয়ে নিচু হয়ে নানা জায়গায় উঁকি মারছে। ছেলেটি জানে কোথায় আছে গোরুর ঠ্যাং, কোথা থেকে গোরুর মাংসের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে আস্তে আস্তে গোলাঘরের কাছে গেল, নিচু হল। চিৎকার করে উঠল, ‘আমি ঠিক বলেছিলাম। এই তো গোরুর মাংস ৷ লোকটির বুক কেঁপে উঠল। নিচু থেকে ছেলেটি ঠ্যাংটা বের করে আনল। সামনে তুলে ধরল।
লোকটি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। গায়ে একথা জানাজানি হয়ে গেলে তার সর্বনাশ হবে। উঁচুজাতের দেমাক আর থাকবে না। সবার সঙ্গে সমান হয়ে যেতে হবে। হায় কপাল। এ তার কি হল? সে আস্তে আস্তে ছেলেটির কাছে গেল। তাকে গোলাঘরের আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। ছেলেটির গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, "বাছা, তুই বড় অনাথ রে। তা বাবা, কাউকে যেন একথা বলিস না। সোনা ছেলে আমার। আমি তোকে অনেক সোনা-রুপো দেব। বলবি না তো? তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে গিয়ে লোকটি অনেক রুপো নিয়ে এল। থলে ভর্তি করে ছেলের হাতে দিল। লোকটি কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। ছেলেটি কোন কথা বলল না। জিনিস নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিল। গোরুর ঠ্যাংটা পথে ঘন ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল।
বাড়ি পৌছিয়েই ছেলে মাকে ডাকল। বলল, মা, মামারা বেতের যে কুনকেতে ধান মাপে সেটা নিয়ে এসো।
মা ভাইদের কাছে গিয়ে বলল, “দেখ, তোদের ভাগ্নে কুনকেটা চাইছে। কেন চাইছে তা তো বাপু জানি না। ছোট মামা কুনকে নিয়ে দিদির সঙ্গে এল। ভাগ্নে রুপোর চাকতিগুলো কুনকেতে ভরে মাপতে লাগল। এত রুপো? ভাগ্নে পেল কোথা থেকে? ফিরে এসে অন্য ভাইদের বলল, 'আশ্চর্য! ভাগ্নে অনেক রুপোর চাকতি নিয়ে এসেছে। সেগুলো সব মাপছে। কোথায় পেল কে জানে! অনেক অনেক রুপো !
মাপা হয়ে গেলে মা কুনকে ফিরিয়ে দিতে এল। ভাইরা বলল, 'ভাগ্নেকে একবার পাঠিয়ে দাও তো ।
মা ফিরে এসে ছেলেকে বলল, “তোর মামারা তোকে এখুনি ডাকছে। কি সব কথা আছে তোর সঙ্গে। যা দেখা করে আয়।
ছেলেটি ঠোঁটের ফাঁকে হাসল। গেল মামাদের ঘরে। মামারা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘তা ভাগ্নে, এত রুপো পেলি কোথায়? হ্যারে, কোথায় পেলি? মামাদের চোখ চকচক করছে।
ছেলেটি খুব শান্তভাবে বলল, এগুলো গোরুর মাংসের দাম। তোমারা আমার যে বাছুরটাকে মেরে ফেলেছিলে, তার মাংস বিক্রি করে এই দাম পেলাম। হাটের লোকজন বলল, খুব ভালো মাংস। আরও চাই। আমাকে আরও মাংস আনতে পাঠিয়ে দিল। তাই এলাম। আবার যাব?
মামারা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, "আচ্ছা, আমরা যদি গোরুর মাংস হাট নিয়ে যাই, ওরা কিনবে তো? মানে আমাদের কাছ থেকে মাংস কিনবে তো?
ছেলেটি উৎসাহ দিয়ে বলল, কেন কিনবে না? নিশ্চয়ই কিনবে। ওরা তো বসে রয়েছে। মাংস কিনবে বলেই বসে রয়েছে। তোমাদের তো অনেক অনেক গোরু আছে। সেগুলোকে মেরে তাদের সব মাংস যদি হাটে নিয়ে যাও, তবে কত টাকাই না পাবে। আমার তো মোটে একটা বাছুর। তাতেই কত পেলাম। তোমাদের তো ঘর ভরে যাবে। ছেলেটি হঠাৎ চুপ করে গেল। নিজের ভাঙা ঘরে ফিরে গেল।
এক ভাই তক্ষুনি একটা গোরুকে কেটে ফেলল। বড় বড় ঝুড়িতে চাপিয়ে ছয় ভাই রওনা দিল। ভাগ্নে তাদের ডেকে বলল, “শোনো মামা, গায়ের ওখানে এক ধনী লোক থাকে। তাকে তো চেনোই। তার বাড়ির কাছে গিয়ে তার কাছে মাংস বেঁচতে চাইবে ।
তার বাড়ির কাছে গিয়ে চিৎকার করে হাঁকবে— কে নেবে গোরুর মাংস? খুব ভালো মাংস। মনে রেখো।
ছয় ভাই পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সবার মাথায় মাংসের ঝুড়ি। একটা বড় গোরুর অনেক মাংস। সেই ধনী মানুষের বাড়ির সামনে এসে হাঁক দিল, “আমাদের গোরুর মাংস আছে। কে নেবে গোরুর মাংস? ভালো মাংস।
অনেক লোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। হাঁক শুনে বলল, ‘হ্যাঁ গোরুর মাংস নেব। নামাও এখানে। অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল। ছয় ভাই তখন ঢুকে পড়েছে ধনী লোকটির উঠোনে। লোকজনও সেখানে ঢুকল। ছয় ভাইকে তক্ষুনি দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল আর সবাই মিলে বেদম প্রহার করল। একসঙ্গে বলে উঠল, “হতচ্ছাড়া পাজি কোথাকার! আমাদের পাড়ায় এসেছিস গোরুর মাংস বিক্রি করতে? জানিস না আমরা কত উঁচু জাতের লোক? আমরা খাব গোরু! তোরা এখানে ঢুকলি কি বলে? মাংস বিক্রি করতে সাহস পেলি কেমন করে? বলছে আর মারছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তারা ছয় ভাইকে পাড়া থেকে দূর করে দিল।
ছয় ভাই ফিরে আসছে বাড়ির পথে। সারা দেহে ব্যথা। চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে, মাথার চুল ছিড়ে গিয়েছে। পথে যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করছে, ‘ওঃ! কি সাংঘাতিক ভাগ্নে! কীভাবেই না আমাদের বোকা বানালো! অমন সুন্দর গোরুটাকে কেটে ফেললাম? কিছুই বুঝতে পারি নি আগে। শয়তান কোথাকার। গোরুও গেল, মারও খেলাম। ঠিক আছে, দেখাচ্ছি মজা। বাড়ি গিয়েই ওর ঘর পুড়িয়ে দেব। ওকে ঘরছাড়া করব। আমাদের কাছেই থাকবে আর আমাদেরই জ্বালাবে?
বাড়ি ফিরে এসেই তারা আর কোনদিকে তাকাল না। আগুন জ্বালিয়ে দিল ভাগ্নের ঘরে। বাঁশ আর কাঠের তৈরি ঘর। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। অল্পক্ষণ পরেই ঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেল। শুধু পড়ে রইল ছাইয়ের গাদা। কি আর করবে ছেলেটি! ছোট দুটাে ঝুড়ি ছিল তার। সেই দুটাে ঝুড়িতে বাড়ি-পোড়া ছাই ভর্তি করে নিল। তারপরে রওনা দিল দূরের এক গ্রামের পথে।
ছেলেটি আগেই শুনেছিল, এই গ্রামে সবার ভীষণ চোখের ব্যামো হয়েছে। লাল হয়ে উঠছে চোখ, সবসময় কটকটু করে, অসহ্য যন্ত্রণা। কিছুতেই চোখের এই রোগ সারছে না। কত লতা-পাতার রস লাগাচ্ছে, কত টোটকা ওষুধ দিচ্ছে—কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ছেলেটি গেল সেই গাঁয়ে। ছেলেটিকে গাঁয়ে ঢুকতে দেখে কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, “ভিন গাঁয়ের ছেলে মনে হচ্ছে। তা কোন কাজ আছে নাকি? কাকে চাই?
ছেলেটি খুব নম্রভাবে বলল, “না কাউকে চাই না। আমি এসেছি আপনাদেরই কাছে। শুনলাম, আপনাদের গায়ের সবার চোখের ব্যামো হয়েছে। বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন। কিছুতেই নাকি সারছে না? তাই ওষুধ নিয়ে এলাম। খুব ভালো ওষুধ। চোখের রোগ সারবেই।’
সবার মুখে হাসি ফুটল। বড় ভালো ছেলে, ভিন গাঁয়ের ছেলে হয়েও কত উপকারী। তারা গাঁয়ের সবাইকে ডেকে আনল। কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। সবাই এল তাড়াতাড়ি। জড়ো হল এক জায়গায়। যার যা সামার্থ্য তাই দিল ছেলেটিকে। অনেক টাকা। হাতের থলে ভরে গেল। কেনই বা দেবে না ? চোখের যন্ত্রণা তো সারবে।
ছেলেটি বলল, “এক্ষুনি কিন্তু আপনারা এই ওষুধ চোখে লাগাবেন না। এ লাগাবার বিশেষ সময় আছে। দৈব ওষুধ তো! আমি কিছুটা পথ যাওয়ার পরে যেই চিৎকার করে বলব,–এবার ওধুধ চোখে লাগান, তখন ওষুধ চোখে দেবেন। চোখে দিয়ে ঘষবেন ।
বাড়ি-পোড়া ছাইয়ের বদলে অনেক টাকা-ভার্তি থলিটা ছেলেটি পিঠের ওপরে ফেলল। ভালোভাবে জুত করে রাখল। ছুটতে হবে তো? হাঁটছে ছেলেটি। পেছন থেকে শুনতে পেল, ‘এখন কি চোখে ওষুধ দেব? ছেলেটি জোরে পা চালালো, ‘এখনও নয়, একটু পরে। এমনি করে পেছন থেকে কথা ভেসে আসে, তারা অনুমতি চায়। আর দূর থেকে সেই গাঁয়ের মানুষগুলো শুনতে পায়, “এখনও নয় ।
অনেক এগিয়ে গিয়েছে ছেলেটি। এবার যদি গায়ের লোক তাড়াও করে তবু তাকে ধরতে পারবে না। আর কোন ভয় নেই। দূরের পথ থেকে ছেলেটির গলা ভেসে এল, ‘এবার ওষুধ লাগান। বলেই দৌড় দিল ছেলেটি। পিঠে ভারি বোঝা, দৌড়তে গেলে বোঝা দুলছে এধার-ওধার। কিন্তু গ্রামবাসীরা অনেক পেছনে। খুব জোরে না দৌড়লেও চলবে। তবু যত তাড়াতাড়ি পারে সে পথ চলছে।
এদিকে গাঁয়ের সবাই তখন শতগুণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পোড়া ছাই চোখে ঢুকে ব্যাথা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তারা ভালো হয়ে উঠবে ভেবে অনেকটা ছাই চোখে দিয়েছিল। উঃ, কি সর্বনাশ। চোখ ফুলে লাল হয়ে একাকার। এখনকার কষ্ট অনেক বেশি। আগের যন্ত্রণা কিছুই নয়। এ কি হল তাদের? নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, ‘টাকাও গেল, চোখের ব্যামোও বেড়ে গেল। কি ঠকবাজ ছেলে? কীভাবে ঠকিয়ে গেল? আসুক না আর একবার। হাত-পা বেঁধে এমন মার দেব জীবনে ভুলবে না। বলছে আর চোখ কচলাচ্ছে। ভীষণ যন্ত্রণা।
ফিরে এল বাড়িতে। মাকে পাঠালো মামাদের বেতের কুনকে আনতে। মা কুনকে নিয়ে এল। দিদির পেছনে পেছনে এল ছোট ভাই। ভাগ্নে কেন কুনকে চাইছে? দেখতে হবে সে কি করে। এসে দেখে—ভাগ্নে মেঝেতে ছড়িয়ে রেখেছে অনেক অনেক টাকা। আর কুনকে দিয়ে সেইসব টাকা গুনছে। অবাক হল ছোট মামা। ছুটে এল দাদাদের কাছে। সব বলল। ভাগ্নে ফিরে এসেছে। আরও অনেক টাকা। অনেক অনেক টাকা ।
সেবারের চেয়েও বেশি।
ছয় ভাই অবাক হল। গেল ভাগ্নের কাছে। জিঙ্গেস করল, ‘ভাগ্নে, কোথা থেকে এত টাকা পেলি? বল না ভাগ্নে?
ছেলেটি শান্ত চোখে মামাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাড়ি-পোড়া ছাইয়ের বদলে এই টাকা পেলাম। যে বাড়ি তোমরা পুড়িয়ে দিয়েছিলে তার ছাই বিক্রি করে এই টাকা পেলাম। যে গাঁয়ে ছাই বিক্রি করে এলাম, সেখানকার মানুষজন বলছে—আরও ছাই চাই, এত কম ছাই দিয়ে কি হবে? আরও ছাই নিয়ে এসো। আমার ঘরখানা তো ছিল ছোট, তা থেকে আর কত ছাই হবে। তা আমি আর কোথায় বেশি ছাই পাব।
তোমদের অনেকগুলো ঘর। ঘরগুলো অনেক বড় বড়। ভেবে দেখ, কত ছাই হবে। উঃ, ভাবতেই পারছি না। অত ছাই বিক্রি করলে তো টাকা বয়েই আনতে পারবে না। আর ভাবতে পারছি না।
ছয় ভাই চলে এল। পরামর্শ করল, “আমাদের ঘরগুলো পুড়িয়ে দি। কত টাকাই পাব। তখন আবার ঘর ছেয়ে নেব। বলামাত্রই কাজ শুরু হয়ে গেল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে শিখা ওপরে উঠল। বাঁশ আর কাঠের বাড়ি জ্বলছে। মাটির সঙ্গে মিশে গেল ঘরগুলো। অনেক ছাই। এত ছাই বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব! তাও ছয়জন মিলে যতটা পারে চেপে ঝুড়িতে রাখল। ঝুড়িও অনেক বড়। মাথায় চাপিয়ে রওনা দিল।
ভাগ্নে তখন তাদের কাছে গিয়ে উৎসাহ দিয়ে বলল, ‘শোনো মামা, ওই গাঁয়ে যাবে। ওই গাঁয়ে সবার চোখের ব্যামো হয়েছে। গায়ে ঢুকেই চিৎকার করে হাক দেবে,—ছাই নেবে গো? চোখের ব্যামো একদম সেরে যাবে। মনে রেখো।
মাথায় ভীষণ ভারি বোঝা। তবু তাড়াতাড়ি চলেছে ছয় ভাই। আঃ! কত টাকাই না মিলবে। চোখ বুজে মাঝেমধ্যে ভাবছে সেই কথা। পথ চলছে আনন্দে। এসে গেল সেই গাঁ, এই গাঁয়েই সবার চোখের ব্যামো হয়েছে, এখানেই ভাগ্নে ছাই বিক্রি করে অনেক টাকা ঘরে নিয়ে ফিরেছে। গায়ে ঢুকেই তারা হাঁক দিল, “ছাই নেবে গো? চোখের ব্যামো একদম সেরে যাবে।
পিলপিল করে গাঁয়ের লোক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। তখনও তাদের চোখের জ্বালা একটুও কমেনি। ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ছয় ভাইকে। মাথার ঝুড়ি কোথায় ছিটকে পড়ল, দামি ছাই কোথায় হাওয়ায় গেল উড়ে। মোটা মোটা দড়ি এনে তারা বেঁধে ফেলল ছয় ভাইকে। আষ্টেপিষ্ঠে বাঁধল। তারা যে ছাই এনেছিল তা এনে খুব করে তাদের চোখে ঘষে দিল, আর কয়েকজন মিলে শুরু করল বেদম প্রহার। সবারই রাগ, সবারই চোখ জ্বলছে। সবাই মারতে শুরু করল। পালা করে মারছে আর চোখে ছাই ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে চলল এই অত্যাচার। গায়ের লোকের রাগ শেষকালে কমল। তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ছেড়ে দিল ছয় ভাইকে। খোড়াতে খোড়াতে চোখ কচলাতে কচলাতে ছয় ভাই বাড়ি ফিরল। হায় কপাল!
বাড়িতে ঢুকেই চেপে ধরল ভাগ্নেকে। এবার আর রক্ষা নেই। ওকে মেরেই ফেলবে তারা। এতবড় শয়তান। ওর জন্য ওদের সুন্দর ঘর পুড়ল, দেহের এই হাল হল। ভাগ্নেকে ধরেই ওরা একটা লোহার খাঁচায় পুড়ল। শক্ত করে দরজা এঁটে দিল। ভেতর থেকে খোলার কোন উপায় নেই। ছয়জন মিলে মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলল সেই খাঁচা। খাঁচার মধ্যে ভাগ্নে। অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক চাইছে। নাঃ, এবার আর বাঁচার উপায় নেই। ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। সেই নির্জন জায়গায় গিয়ে তারা থামল। ধপাস করে ফেলে দিল খাঁচা। তারপরে বলল, ‘নদীর জলে ডুবিয়ে তোকে মারব। খাঁচাসমেত তোকে জলে ফেলে দেব। দেখি কে বাঁচায় তোকে। অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার তুই মরবি। একটু পরেই মরবি।
খাঁচা তো ভালোভাবে বাঁধাই রয়েছে। খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়া দরকার। খেয়ে এসে ওকে জলে ডোবালেই চলবে। তারা গেল গাছের ফল খুঁজতে। একটু দূরে। খাঁচার মধ্যে বসে বোকাবোকা চোখে চেয়ে আছে ছেলেটি। দু-একবার হাত দিয়ে দরজা নাড়ল। না, বেরিয়ে যাবার কোনই উপায় নেই। এবার বুঝি মরতেই হবে।
এমন সময় ছেলেটি একজন লোককে দেখতে পেল। খুব সাবধানে পা ফেলে এদিক ওদিক চেয়ে সে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসছে। সে একজন বিরাট সর্দারের ছেলে, সর্দারকে সবাই রাজা বলে। রাজার ছেলে শিকার করতে বেরিয়েছে। অনেক দূরের পাহাড়ি গাঁয়ে তার বাড়ি। শিকার খুঁজতে খুঁজতে সে অনেক দূরে চলে এসেছে। হঠাৎ শিকারি রাজপুত্রের চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। এমন জিনিস সে আগে কখনও দেখেনি। খাঁচার মধ্যে বসে রয়েছে পাখি নয়, জন্তু নয়—একটা মানুষ। কাছে এল সে। জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার? তুমি লোহার খাঁচার মধ্যে কেন? কে তোমায় খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে ?
ছেলেটি দুঃখের নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর বলেন কেন। আমার মামাদের একটা মেয়ে আছে। তার মতো সুন্দরী এই এলাকায় আর কেউ নেই। অন্য কোথাও নেই। কি রূপ তার! মামারা তার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চায়। কিছুতেই ছাড়বে না। আর আমার তো এই চেহারা। ওকে যদি বিয়ে করি, আমার তো ভীষণ হিংসে হবে। কি রূপ তার। লোকে আড়ালে আমাকে হাসি-ঠাট্টাও করতে পারে। কি বউয়ের কি বর! আমি তাই ওকে কিছুতেই বিয়ে করতে চাই না। মামারাও ছাড়বে না। তাই আমার এই হাল হয়েছে। মত দিলে তবেই নাকি খাঁচার দরজা খুলবে। কি যে করি! ওঃ ! মেয়ের রূপ যদি আপনি দেখতেন ।
রাজপুত্র অবাক হয়ে বলল,“আমি তো তাহলে মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারি। কি বল তুমি?
ছেলেটি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, তা পারেন। আপনার উপযুক্ত মেয়েই বটে। খুব মানাবে। মামারাও অরাজি হবে না।
রাজপুত্র বলল, কেমন করে বিয়ে হবে? তুমি ঠিকঠাক বলে দাও । ছেলেটি এবার আরও উৎসাহ করে বলল, “আপনি এই খাঁচার মধ্যে বসে থাকবেন। চুপটি করে বসে থাকবেন। অল্পক্ষণ পরেই মামারা এসে পড়বে। তারা এসেই আপনাকে জিজ্ঞেস করবে,— তোমার কি আর কিছু বলার আছে? তারা যখন আপনাকে এই প্রশ্ন করবে, আপনি জবাব দেবেন—মামা, আমার বলার কথা একটাই আছে, আমি রাজি, আমি আপনাদের মেয়েকে বিয়ে করব। আমার মত হয়েছে। ব্যাস, তাহলেই সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়ে যাবে।
শিকারি রাজপুত্র আনন্দে ডগমগ হয়ে বলল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। খুব ভালো ।
এবারে ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলল, “দেখুন, আর একটা কথা আছে। আপনি যদি শিকারের ওই পোশাকে খাচার মধ্যে বসে থাকেন, তবে মামারা ঠিক আপনাকে চিনে ফেলবে। বুঝবে, এ তো তাদের ভাগ্নে নয়। তাহলে বিয়েও পণ্ড হয়ে যাবে। আমি খাঁচা থেকে বেরিয়ে আপনার পোশাক পরি, আর আপনি আমার পোশাক পরে খাঁচায় ঢুকে পড়ুন। ব্যাস, তাহলেই হবে। একটু তাড়াতাড়ি করাই ভালো। মামাদের আসার সময় হয়ে এল। এই এল বলে।
রাজপুত্রের মন উতলা হয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা খুলে দিল। বেরিয়ে এল ছেলেটি। পোশাক খুলে ফেলল তাড়াতাড়ি। রাজপুত্রকে দিল তার পোশাক।
রাজপুত্র দিল নিজের নতুন ঝকমকে পোশাক, গলার হার, হাতের বালা। ছেলেটি পরে নিল সেসব। রাজপুত্র পরে নিল ছেলেটির অতি সাধারণ পোশাক। ঢুকে পড়ল খাঁচার মধ্যে। ছেলেটি বাইরে থেকে লোহার খাঁচার দরজাটি খুব ভালোভাবে সাবধানে এটে দিল।
সুন্দর নতুন ঝকমকে পোশাকে গলায় হার হাতে বালা পরে ছেলেটি রাজপুত্রের বেশে বাড়ির পথে হাটা দিল। কি সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে।
এখন হয়েছে কি, গাছের ফল খেয়ে নদীর জল খেয়ে মামারা ফিরে এল নদীর তীরে সেই জঙ্গলের কাছে। ওখানেই রয়েছে খাঁচায় বন্দি তাদের ভাগ্নে। এসে দেখে, না খাঁচা ঠিক আছে। ভেতরে বসে রয়েছে তাদের ভাগ্নে। মুখটা নিচু করে বসে রয়েছে। মামারা এসেই ঠাট্টা করে বলল, ‘ভাগ্নে, তোর কিছু বলার আছে?
রাজপুত্র হাসিহাসি মুখে বলল, ‘মামা ঠিক আছে, আমি রাজি। আমি ওকেই বিয়ে করব।
তার কথা মামারা শুনল কি শুনল না, ধাক্কা মেরে উলটে দিল খাঁচা, একবার গড়িয়ে গেল, আবার ধাক্কা, আবার গড়িয়ে গেল। শেষকালে ঝপ করে গিয়ে পড়ল নীচের নদীতে। ভাগ্নে কি যেন বলতে চাইল, মামারা শুনতে পেল না, শুনতে চায়ও না। জলের ওপরে অনেক বুদবুদ দেখা গেল, আবার জলেই সেগুলো মিলিয়ে গেল। নদীর জল যেমন বইছিল তেমন বয়ে চলল।
মামারা ফিরে আসছে জঙ্গলের পথে বাড়ির দিকে। মনে খুব আনন্দ। নিজেরা নিজেদের মধ্যে বলছে, “কি ভোগান্তিই না ভুগিয়েছে ভাগ্নে। ওঃ, কি পাজি শয়তান। এখন মরে গিয়ে শান্তি হল। আর জ্বালাতে আসবে না। তারা বাড়ি ফিরল।
বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই তারা চমকে উঠল। এ কি কাণ্ড ! ভাগ্নে তো মরেনি। দাওয়ায় বসে পা নাচাচ্ছে। সুন্দর ঝলমলে পোশাক, গলায় হার, হাতে বালা। যেন রাজপুত্র বসে রয়েছে। ও তো মরেনি। আশ্চর্য! আরও সুন্দর হয়েছে।
তারা আস্তে আস্তে ভাগ্নের কাছে এল। জিঙ্গেস করল, ‘ভাগ্নে, তোকে জলে ডুবিয়ে দিয়ে এলাম। খাঁচার দরজা বন্ধ। তা এত তাড়াতাড়ি এলি কেমন করে?
ছেলেটি তৃপ্তিভরে হাসল। শেষকালে বলল, “আমি কি আর একা এখানে ফিরে আসতে পারতাম? খাঁচা তো বন্ধ, জল তো অনেক। আমার দাদু-দিদিমারা আমাকে আবার এখানে পাঠিয়ে দিল। পালকি করে পাঠিয়ে দিল। পালকি চড়ে তাই এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম। খুব মজা?
মামারা তাকিয়ে রয়েছে অবাক চোখে। ভাগ্নে বলে চলেছে, “জলের তলায় ঢুকে যেতেই দাদু-দিদিমারা কাছে চলে এল, খাঁচা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন পোশাক, গলার হার আর হাতের বালা। পরে নিলাম। ফিরে এলাম। খুব মজা। ও, বলতে ভুলে গেছি, দাদু-দিদিমারা একটা কথা বলে দিয়েছে। ওঃ, একেবারে ভুলে গেছি। অনেকদিন তোমাদের দেখেনি, তাই একবার তোমাদের ছয়জনকে দেখতে চেয়েছে। এই কথা বলে দিয়েছে। আর তোমাদের জন্য এই সোনার ভোজালি পাঠিয়ে দিয়েছে, সোনার ভোজালি। হাতে নিয়ে দেখ।
মামাদের হাতে সে সোনার ভোজালিটা তুলে দিল। এমন সোনার বড় ভোজালি ভাগ্নে পাবে কোথা থেকে? জলের তলায় দাদু-দিদিমা না দিলে? সত্যিই, সোনার ভোজালি। মামারা অবাক হল, হিংসেতে ফেটে পড়ল।
একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে, ওখানে যাওয়া যায় কেমন করে? ভাগ্নে, বল তো, কেমন করে দেখা করব বাবা-মায়ের সঙ্গে?
ছেলেটি চোখের কোণে হাসির ঝিলিক টেনে বলল, ‘খুব সোজা। মামা, সেখানে যাওয়া খুব সোজা। তোমরা এক একজনে একটা করে লোহার খাঁচা বানাও। নদীর তীরে জঙ্গলের পাশে সেগুলোকে নিয়ে যাও। ঢুকে পড় তার মধ্যে। ব্যাস, হয়ে গেল। পৌঁছে যাবে দাদু দিদিমাদের দেশে ।
কথামতো কাজে লেগে গেল ছয় মামা। লোহার খাচা তৈরি করল। মাথায় করে বয়ে নিয়ে গেল নদীর তীরে জঙ্গলের পাশে। ঢুকে পড়ল যে যার খাঁচার মধ্যে। পেছনে পেছনে চলছিল ভাগ্নে। সে ভালোভাবে সাবধানে ছয়জনের খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিল। পাশাপাশি রয়েছে ছটা খাঁচা। ভেতরে ছয় মামা হাসছে। মনে আনন্দ । এখুনি পৌছে যাবে বাবা-মায়েদের দেশে। নতুন ঝলমলে পোশাক পাবে, গলায় হার পরবে আর হাতে বালা। তার ওপরে পাবে সোনার ভোজালি। খুব মজা হবে।
বড় মামার খাঁচা গড়িয়ে দিল ভাগ্নে। কয়েকবার গড়িয়ে সেটা গিয়ে পড়ল গভীর জলে। অনেক বুদবুদ উঠল জলের ওপরে। আবার মিলিয়ে গেল। ভাগ্নে চিৎকার করে উঠল, ‘মামারা, তাকিয়ে দেখ। বড় মামা দাদু-দিদিমাদের কাছে যেতেই তারা তাকে অনেকটা ধেনো মদ খেতে দিয়েছিল। তাড়াতাড়ি পচাই খেয়ে দেখ বড় মামা কেমন ভকভক করে বমি করছে, জলে কত বুদবুদ। ইস, কি বমিই না হল।
তারপরে মেজ মামার খাঁচা ঠেলতে লাগল। খাঁচা গড়াতে লাগল। মেজ মামার মুখে হাসি, মনে আনন্দ। ঝপ করে খাঁচা গিয়ে পড়ল নদীর গভীর জলে। আবার অনেক বুদবুদ। এমনি করে ছয় মামার ছটি খাঁচাই হারিয়ে গেল নদীর জলে। জল এখন শান্ত, নদী আগের মতোই বয়ে চলেছে। জঙ্গলে আর কোন খাঁচা নেই। ভাগ্নে ফিরে চলল বাড়ির পথে।
বাড়ির উঠোনে পা দিতেই ছয় মামি ভাগ্নেকে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “তোর মামারা ফিরবে কখন?
ভাগ্নে আড়চোখে মামিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “মামি, খুব তাড়াতাড়ি তো ফিরতে পারবে না। একটু তো দেরি হবেই। সবে মামারা তাদের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছেছে। কত দিন পরে দেখা-সাক্ষাৎ হল। সহজে কি তারা ছেলেদের ছাড়বে?
একটু দেরি তো হবেই। মামিরা নিশ্চন্ত হল।
তিন দিন তিন রাত্তির কেটে গেল। স্বামীরা তবু ফিরল না। চার রাত্তির কেটে গেল,—তবু তো কেউ এল না। আর কত দেরি হবে? এখনও কি বাবা-মায়েরা ছেলেদের ছাড়ছে না? এবার মামিরা উতলা হল। জিঙ্গেস করল, ‘ভাগ্নে, অনেক দিন তো হল। এখনও কেন তোর মামারা ফিরছে না? খুব চিন্তা হচ্ছে।
ভাগ্নে বলল, “এই তো ফিরল বলে। মামারা তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে। কোন ভাবনা নেই?
আরও তিন দিন তিন রাত্তির কেটে গেল। তবু স্বামীরা ফিরে এল না। একজনও এল না। মামিরা কান্নাভরা চোখে জিঙ্গেস করল, ‘ভাগ্নে, কই বাছা, মামারা তো তোর এখনও ফিরে এল না।
ভাগ্নে এবার বলল, ‘মামি, মামাদের ভাত আলাদা আলাদা করে ভরে নোকসেক-এ রেখে দাও।
মামিরা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। একথার অর্থ–ছয় মামাই মরে গিয়েছে। হায়। ছয় স্বামীই মারা গিয়েছে। তারা আর কখনও ফিরে আসবে না। চিরকালের জন্য তারা চলে গিয়েছে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মামিরা কাঁদতে লাগল। সে কি কান্না!
মামাদের ভাগ্নে অনাথ ছেলেটি খুব ধনী হয়ে গেল। অনেক টাকাকড়ি তার, রুপোর গয়না, সোনার ভোজালি, কুনকে কুনকে ভর্তি রুপোর চাকতি। কত বড়লোক সে। আর কেউ বেঁচে নেই যে তাকে হিংসে করবে, তাকে কষ্ট দেবে, সর্বনাশ ডেকে আনবে। অনেক বড়লোক হয়ে ভাগ্নে সুখে-শান্তিতে বাস করতে লাগল।
0 coment�rios: