অনেক অনেক কাল আগের কথা। অনেক পুরনো দিনের কথা। সেই পুরনো দিনে আমরা সবাই ছিলাম দাস, ক্রীতদাসও বলতে পার। দিন-রাতের সবটুকুই অন্যের জন্য বাঁধা ছিল। নিজের ইচ্ছে বলতে কিছুই ছিল না।
সেই পুরনো দিনে শুধু গোষ্ঠীপতি ছিল অন্যরকম। সে ক্রীতদাস ছিল না। থাকবে কেমন করে? আমরা যে তারই কাজকর্ম করতাম। সর্দারের সবকিছু করতাম। না করে উপায় ছিল না। কিন্তু এ জীবন আর ভালো লাগে না। বড় কষ্টের। কতদিন ধরে চলবে এই ক্রীতদাসের জীবন।
একদিন সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে তারা সকলে পাশের বনে গেল। অনেক কথা হল। শেষকালে তারা ঠিক করল, একজন দূতকে পাঠাবে দেবতার কাছে। তিনিই শুধু বুঝবেন তাদের কষ্ট। দেবতা থাকেন ওই দূর পাহাড়ের ওপারে, বন পেরিয়ে সেখানে যেতে হবে । দূত হবে কুকুর। সেই সবসময়ের বন্ধু, কুকুর কখনও কথার খেলাপ করে না, সে বড় বিশ্বস্ত। তাছাড়া কুকুরের মতো গতি আর কার আছে? সে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে দূরের দেবতার কাছে। সেই তাহলে দূতের কাজ করুক।
বন্ধু কুকুরও রাজি। মানুষের উপকার করবে, এতে তার খুব আনন্দ। সে দৌড় দিল বন-বাদাড় পেরিয়ে। তাকে আর দেখা গেল না। গায়ের মানুষ নিশ্চিত্ত হল।
দেবতা এবার তাদের কষ্ট দূর করবেন।
এক গাঁয়ের পাশ দিয়ে কুকুর দৌড়ে যাচ্ছে। সে হাঁপিয়ে পড়েছে, জিভ বেরিয়ে পড়েছে, ঘামে দেহের লোম ভিজে উঠেছে, অনেক আস্তে চলেছে সে। হঠাৎ খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে কুকুর দেখতে পেল, ঘরের মধ্যে বসে এক বুড়ি উনুনে কি যেন ফোটাচ্ছে। উনুনের মুখে শুকনো পাতা দিচ্ছে বুড়ি, হাড়ির চারপাশ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। রান্না করছে বুড়ি।
কুকুর থেমে পড়ল। বড্ড খিদে পেয়েছে। নাহয় একটু পরেই যাওয়া যাবে। এত তাড়া কিসের? একটু কিছু খেয়ে যাই। আর যদি সময় কিছু নষ্টই হয়, খেয়েদেয়ে আরও জোরে ছুটব না হয়। দেহে জোর পাব, দম পাব। কুকুর দোরের সামনে বসে পড়ল। জিভ চাটছে আর লেজ নাড়ছে। মাঝে মাঝে অশান্তিতে উঠে পড়ছে, আবার বসছে।
এমন সময় বুড়ি পেছন ফিরে তাকাল। দেখতে পেল কুকুরকে। তবে রে! উনুনে দেবার চেরা কাঠ নিয়ে তেড়ে গেল বুড়ি। কুই কুই করে কুকুর একটু দূরে সরে গেল। তার খিদে গেল আরও বেড়ে। বুড়ি ফিরে গেল ঘরে। আপদ যত সব।
আবার বুড়ি পেছন ফিরে তাকাল। দেখতে পেল কুকুরকে। আবার গেল তেড়ে। কুকুর আর একটু দূরে সরে গেল। বুড়ি ফিরে যেতেই সে আবার দোরের মুখে বসল। এমনি করে অনেকক্ষণ কেটে গেল। বুড়ি আর হাঁড়ি নামায় না উনুন থেকে। কুকুরও নড়ে না সেখান থেকে।
কুকুর তো ফিরছে না। কেন এত দেরি হচ্ছে? গায়ের মানুষজন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এতক্ষণ তো কুকুরের ফেরা উচিত। একটা ছোট ছাগল-ছানা একথা শুনতে পেল। আহা ! মানুষদের বড় কষ্ট। বন্ধু কুকুর শেষকালে এমন কাজ করল? নাঃ, কাউকে বিশ্বাস নেই, সেই যাবে দেবতার কাছে। সেই পৌঁছে দেবে কষ্টের কথা, সে নিজেই যাবে দেবতার কাছে। একটু বেশি সময় হয়তো লাগবে। কিন্তু উপায় কী ? ছাগল ছানা রওনা দিল।
চলেছে, চলেছে, ছাগল ছানা চলেছে। যত তাড়াতাড়ি পারে সে ছুটে চলেছে। বনের মধ্যে দিয়ে তাও চলা যায়, কিন্তু পাহাড়ি পথে বড়ই কষ্ট। পায়ে লাগে, হেঁচট খেতে হয়। তবু চলেছে ছাগল-ছানা। মানুষ কত আদর করে তাকে, তার উপকার সে করবে না?
এদিকে বসেই রয়েছে কুকুর। প্রচণ্ড খিদে, তার ওপরে লোভ। সে ভুলে গেল তার কাজের কথা। এমন সময় হাঁড়ির জল টগবগ করে ফুটে উটল। কুকুরের চোখ গোলগোল হয়ে উঠল। বুড়ি গেল পাশের বড় ঘরে। কোলে তুলে আনল একটা বাচ্চা ছেলেকে। দাওয়ার ওপরে বসাল বাচ্চাটাকে। উনুনের ওপর থেকে হাড়িটা তুলে আনল। হাড়িটা রেখে আর একটা বড় হাড়ি নিয়ে এল। তাতে ঢেলে দিল কিছুটা ঠান্ডা জল। তারপরে.... । ককুর অবাক হল। মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল। বুড়ি উনুন থেকে আনা হাড়িটা উপুড় করে দিল। গরম ধোয়া-ওঠা জল পড়ল নীচের বড় হাড়িতে। শুধুই ফুটন্ত জল। বুড়ি চান করাতে লাগল, বাচ্চাটা জল পেয়ে খলবল করে উঠল। বুড়ি চান করাচ্ছে বাচ্চাটাকে।
কুকুর লাফিয়ে উঠল। হায়! কত সময় বয়ে গেল। কিছুই তো হল না। মনে পড়ল তার কাজের কথা। ভুলে গেল খিদের কথা। লজ্জা পেল সে। দেড় দিল, ভীষণ দৌড়। হঠাৎ পথে দেখা ছাগল-ছানার সঙ্গে। ছাগল-ছানা পাহাড়ি পথে নেমে আসছে, আস্তে আস্তে। বড় ক্লান্ত সে।
কুকুর বলল, ছাগল-ছানা, এই কষ্টের পথে তুমি কোথায় গিয়েছিলে? একা একা । ছাগল-ছানা কিছু বলতে চাইল। সে হাঁপাচ্ছে। দম নিয়ে বলল, “বন্ধু, তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
কুকুর মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল, “বন্ধু, অনেক দেরি হয়ে গেল। আমি যাচ্ছি দূর পাহাড়ের ওপারে। মানুষ পাঠিয়েছে আমাকে। দেবতার কাছে যাচ্ছি। একটা কথা বলতে হবে।
মানুষের কথা আমি দেবতাকে বলে এসেছি। তুমি ফিরে যাও।
কুকুর অবাক হল। কেমন আঁকুপাকু করতে লাগল। শেষে বলল। ‘ছাগল-ছানা, দেবতার কাছে তুমি কি বললে?
‘কেন ? ঠিক কথাই বলেছি। মানুষের বড় কষ্ট। মানুষ আর গোলামি করতে পারছে না। ক্রীতদাসের এই জীবন থেকে সে মুক্তি চায়। দেবতা তুমি মুক্তি দাও। মানুষ এই জীবন থেকে মুক্তি চায়, সে মৃত্যু চায়। মৃত্যুই ভালো। এ জীবনের বদলে মৃত্যু ভালো। দেবতা তাই দিলেন।
একথা শুনে কুকুর কেমন যেন হয়ে গেল। তার পা কাঁপছে, বুকে যেন কি চেপে বসছে, চোখ ভিজে উঠছে, ঝাপসা হয়ে আসছে'চারপাশ । সে বসে পড়ল।
এ কি সর্বনাশ করে এল ছাগল-ছানা। এ কি ভীষণ ভুল করে এল সে। ভুল প্রার্থনা, ভুল খবর, মানুষ তো এ মুক্তি চায়নি। অন্য মুক্তি চেয়েছিল। দেবতার কাছে গিয়ে ভুল শোধরাতে হবে।
শিকারির হাত থেকে যেমনভাবে বর্শা ছুটে যায়, ধনুক থেকে যেমন তির ছুটে যায়, আকাশ থেকে যেমন বিদ্যুৎ ছুটে আসে-কুকুর তেমনি গতিতে পাহাড়ে উঠতে লাগল। ওপারে পৌঁছে গেল কুকুর। দেবতার বাড়িতে। দেবতা বসে রয়েছেন কাঠের আসনে।
কুকুর কিছু বলতে গেল। দেবতা ধমকে উঠলেন। একটু আগেই মানুষের আর্জি শুনেছেন। মানুষ যা চেয়েছে, তিনি তাই দিয়েছেন। আবার কেন নতুন করে আর্জি? এত ঘন ঘন মানুষের কথা শোনা সম্ভব নয়। আর নতুন করে কিছু করাও অসম্ভব। দেবতা একবার যা বলেছেন, তাই সত্য হবে। তাকে পালটানো যায় না। দেবতা নতুন করে কিছু শুনবেন না।
কুকুর অস্পষ্টভাবে কিছু যেন বলতে চাইল। দেবতা অন্য দিকে চেয়ে আছেন। তার সামনে কুকুর যে নত হয়ে বসে রয়েছে, দেবতা তা খেয়ালই করছেন না। কুকুর কয়েকবার বলতে চেষ্টা করল। ভয় পেল। পারল না। কুকুর ফিরে চলল।
বারবার হোঁচট খাচ্ছে কুকুর। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এ কি হল? বন্ধু মানুষের ভাগ্যে এ কি ঘটে গেল। তারই জন্য, তারই দোষে, তারই লোভে। সে কেমন করে ফিরে যাবে গায়ে। সে যদি এখনই মারা যেত অনেক ভালো হত। হায় দেবতা, এ তুমি কি করলে? দেবতারই বা দোষ কি?
সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে মৃত্যু এল। আগে মানুষ মারা যেত না। ভুল খবরে মৃত্যু এল। আর আজও মানুষ ক্রীতদাস হয়েই রয়েছে। এ জীবন থেকে মুক্তি ঘটেনি।
মৃত্যু হলে তবেই মুক্তি।
0 coment�rios: