Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

রাজা আর্থারের আমলে কর্নওয়ালে বাস করত এক চাষী। তার একটিমাত্র ছেলে, নাম জ্যাক। তরুণ জ্যাক যেমন ছিল শক্তসমর্থ, তেমনি ছিল সাহসী আর বুদ্ধিমান। স...

দুঃসাহসী জ্যাক-১ -- ইংল্যান্ডের রূপকথা

রাজা আর্থারের আমলে কর্নওয়ালে বাস করত এক চাষী। তার একটিমাত্র ছেলে, নাম জ্যাক। তরুণ জ্যাক যেমন ছিল শক্তসমর্থ, তেমনি ছিল সাহসী আর বুদ্ধিমান।
সেময় কর্নওয়ালের পাহাড়ে থাকত করমোরান নামে এক ভয়ঙ্কর দৈত্য। বেজায় লম্বা আর তাগড়া সেই দৈত্যের গায়ে ছিল অসম্ভব শক্তি—তার ওপর সে ছিল সাঙ্ঘাতিক নিষ্ঠুর। আশপাশের সব শহর আর গায়ের লোকজন তার ভয়ে তটস্থ থাকত। পর্বতের মাঝখানে দুর্গম এক জায়গায় জঙ্গলে ঘেরা এক মস্ত গুহার ভেতরে বাস করত সে। কিছুদিন পর পর গুহা ছেড়ে বাইরে বেরোত খাবারের খোঁজে।
দৈত্য শহরে বা গাঁয়ে পা দিলেই মানুষজন ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেত। তখন ইচ্ছেমত গরুবাছুর ছাগল-ভেড়া ধরে নিয়ে যেত সে। একবারে ছটা ষাড় অনায়াসে পিঠে ফেলে নিয়ে যেতে পারত করমোরান। সেইসঙ্গে কোমরবন্ধের সঙ্গে ঝুলিয়ে নিয়ে যেত অসংখ্য ছাগল আর ভেড়া। যাওয়ার সময় সাজানো ঘরবাড়ি অনর্থক পা দিয়ে মাড়িয়ে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়ে যেত, মাঠভর্তি ফসল দলে-পিষে নষ্ট করত ।
এভাবেই বছরের পর বছর দৈত্যের অত্যাচার চলছিল। কেউ কোন প্রতিকার করতে পারেনি, কারন করমোরানের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে। কর্নওয়ালের অসহায় লোকজন দিনে দিনে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল, তাদের দুঃখকষ্টের কোন সীমা রইল না।
অনেকের মত জ্যাকও ছোটবেলা থেকে অত্যাচারী দৈত্যের নিষ্ঠুর কাণ্ড-কারখানা দেখে আসছিল। দৈত্যের অত্যাচারে তার বাবাও আজ নিঃস্ব । অবশেষে একদিন কী ভেবে সে গিয়ে হাজির হলো নগরপালের সামনে ।
করমোরানকে যে মারতে পারবে তার পুরস্কার কী? জানতে চাইল জ্যাক ।
‘দৈত্যের সমস্ত ধনরত্বের মালিক হবে সে,’ নগরপাল উত্তর দিলেন। 
‘বেশ, আমি তাহলে চেষ্টা করে দেখতে চাই,’ জ্যাক বলল। 
একদিন সকালে সে একখানা কোদাল, একটা গাইতি, একটা বড় শিঙে আর কিছু খাবার নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেল। দুর্গম পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে দৈত্যের গুহার কাছাকাছি জঙ্গলে যখন পৌছল তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে দূরে দৈত্যের গুহা চোখে পড়তেই থেমে পড়ল সে। খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ সেখানে বিশ্রাম নিল। তারপর দূর থেকে দৈত্যের গুহার ওপর নজর রাখতে লাগল।
সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। জ্যাক দেখতে পেল, দৈত্য নিজের গুহা ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ছোট একটা গুহায় আটকে রাখা জন্তুজানোয়ারের ভেতর থেকে একটা বড়সড় ষাঁড় ধরে নিয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করার পর সে এক সময় মেঘের গর্জনের মতো দৈত্যের নাক ডাকার আওয়াজ শুনতে পেল। বুঝতে পারল, রাতের খাবার সেরে করমোরান এখন গভীর ঘুমে মগ্ন।
এবার জ্যাক তার গোপন আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে গুহার কাছে এগিয়ে গেল। সারা রাত ধরে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে সে গুহার ঠিক সামনে খুব গভীর আর প্রকাণ্ড একটা গর্ত খুঁড়ল। তারপর সেই গর্তের ওপরটা লম্বা লম্বা ডাল, ণতাপাতা আর খড় দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিল যাতে তাকালে জায়গাটাকে সাধারণ সমতল একটা জায়গা বলেই মনে হয়। শেষরাতে কাজ সারা হলে ক্লান্ত জ্যাক গর্ত থেকে কিছুটা সরে এসে ঘাসের ওপর শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগল ।
ভোরের আলো মাত্র ফুটতে শুরু করেছে, ভালো করে কিছুই ঠাহর করা যায় না—এমনি সময়ে জ্যাক শিঙেয় মুখ লাগিয়ে খুব জোরে ফু দিল ।
শিঙের বিকট আওয়াজে দৈত্যের ঘুম ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গুহা ছেড়ে ফুসতে ফুসতে বেরিয়ে এল সে।
কে রে তুই, ছোকরা? জ্যাককে দেখতে পেয়ে মাটিতে পা ঠুকে গর্জে উঠল সে, এত বড় সাহস তোর, আমার ঘুম মাটি করতে এসেছিস! দাঁড়া, এক্ষুনি তোকে পিষে মেরে কাবাব বানিয়ে নাশতা সারব আমি।”
আস্ফালন করতে করতে দৈত্য কয়েক পা মাত্র এগোতেই ডাললতাপাতা-খড় নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল গর্তের ভেতরে। তার বিশাল দেহের ওজন তো কম নয়—সমস্ত পাহাড় কেঁপে উঠল থরথর করে ।
কিহে, করমোরান! কোথায় তুমি এখন? চেঁচিয়ে বলল জ্যাক । "এখনও আমাকে কাবাব বানিয়ে খাওয়ার মতলব করছ নাকি?” দৈত্যকে নিয়ে খানিকক্ষণ এভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করল সে, তারপর গর্তের কাছে গিয়ে তার মাথায় ধারাল গাইতি দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘা বসিয়ে দিল। তাতেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল অত্যাচারী দৈত্যের।
চারদিকটা একটু ঘুরে-ফিরে দেখে গুহার ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সেখানে সে পেয়ে গেল দৈত্যের জমানো অজস্র ধনরত্ন ।
করমোরান মারা পড়েছে শুনে কর্নওয়ালের লোকজনের আনন্দ দেখে কে! নগরকর্তারাও বহু যুগ পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে র্বাচলেন। তাদের পক্ষ থেকে জ্যাককে উপাধি দেয়া হলো ‘দুঃসাহসী জ্যাক’ । সেইসঙ্গে তাকে উপহার দেয়া হলো একখানা তলোয়ার আর একটা কোমরবন্ধ। কোমরবন্ধের ওপর সোনালি অক্ষরে লিখে দেয়া হয়েছে:

কর্নওয়ালের গর্ব এ যে তরুণ তেজীয়ান 
এরই হাতে খতম হলো দৈত্য করমোরান ।

জ্যাকের দৈত্যবধের কাহিনী খুব শিগগিরই দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। ব্লানডারবোর নামের আরেক ভয়ঙ্কর দৈত্যের কানেও গিয়ে পৌছল সে খবর। সে মনে মনে ঠিক করল, যখনই সুযোগ পাবে জাতভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
ব্লানডারবোর থাকত গভীর এক অন্ধকার বনের মাঝখানে এক প্রকান্ড দুর্গে। কয়েক মাস পরে জ্যাক সেই বনের ভেতর দিয়ে কর্নওয়াল থেকে ওয়েল্‌স যাচ্ছিল। একটানা অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে সে একটা ঝর্নার ধারে বিশ্রাম নিতে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল তার। নরম ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
ঝর্না থেকে পানি নিতে এসে ব্লানডারবোর দেখতে পেল ঘুমন্ত জ্যাককে। ভারী কৌতুহল হলো তার। কোমরবন্ধের ওপরের লেখাটা চোখে পড়তেই দৈত্য জ্যাককে চিনতে পারল। আমনি তাকে খপ্‌ করে তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলে দুর্গের দিকে যাত্রা করল।
ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দৈত্য এগিয়ে চলেছে, এমন সময় জ্যাকের ঘুম ভেঙে গেল। মস্ত এক দৈত্য তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যেমন আশ্চর্য হয়ে গেল সে, তেমনি খুব ভয়ও পেয়ে গেল ।
দুর্গে পৌছে ভেতরে ঢুকল দৈত্য। জ্যাককে কাঁধ থেকে নামাল। জ্যাক দেখতে পেল, এককোণে মানুষের হাড়গোড়ের বিরাট একটা স্তৃপ।
তোমার হাড়গোড়ও শিগগিরই ওখানে জমা হবে, বুঝলে, বাপু? দৈত্য বিকট হাসি হেসে বলল ।
শুনে জ্যাকের ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তবে একা একা তোমাকে সাবাড় করতে চাই না, বলল ব্লানডারবোর। দাঁড়াও, আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে আসি—দু’জনে মিলে খাসা ভোজ খাবো।’
ওপরতলার বড় একটা কামরার ভেতরে জ্যাককে তালাবন্ধ করে রেখে দৈত্য চলল তার ভাইকে ডেকে আনতে । বনের অন্য এক কোণে তার ভাইয়ের বাস ।
দৈত্য চলে যেতেই জ্যাক কামরার খোলা জানালার কাছে গিয়ে উঁকি  দিয়ে দেখল, ঠিক নিচেই দুর্গের ফটক। তবে জানালা থেকে মাটি অনেক নিচে। কাজে লাগার মতো কিছু একটা পাবার আশায় ঘরের চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকল সে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, এক কোণে ভাঙা আসবাবপত্রের ফাঁকে বেশ কিছু মোটা দড়ির টুকরো পড়ে আছে। টুকরোগুলো গিট দিয়ে জুড়ে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব লম্বা একগাছা মজবুত দড়ি তৈরি করে ফেলল।


জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেেএক সময় দেখতে পেল দুই দৈত্য অনেক দূরে বনের পথ ধরে হেঁটে আসছে। হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকে দৈত্যের ভোজ হতে চাই না আমি, বিড়বিড় করে বলল সে। লম্বা দড়ির দু’মাথায় দুটো ফাঁস তৈরি করল যত্নের সঙ্গে । তারপর ফাসঁ হাতে জানালার কাছে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই দৈত্য কাছে এসে পড়ল। দুর্গের লোহার ফটক খুলে যেই তারা ভেতরে ঢুকেছে অমনি ওপর থেকে ঝপ করে দড়ির ফাঁসদুটো ঝুঁড়ে দিল জ্যাক। মজবুত ফাঁস দুই দৈত্যের গলায় আটকে গেল। একটুও দেরি না করে জ্যাক দড়ির মাঝখানটা চেপে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টানতে শুরু করল। দড়ির ফাঁস শক্ত হয়ে চেপে বসল দৈত্যদুটোর গলায়, তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। ছটফট করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দু'জন।
জ্যাক তখন দড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল । দেখল, দৈত্যদুটো তখনও বেঁচে আছে। তলোয়ারের ঘায়ে দুজনের দফা রফা করল সে তৎক্ষণাৎ ৷

ব্লানডারবোরের চাবির গোছা নিয়ে জ্যাক একে একে দুর্গের সব কামরা খুলে দিল। তিনটে কামরা থেকে তিনজন সুন্দরী মেয়েকে উদ্ধার করল। অনাহারে থেকে তাদের প্রাণ যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।

‘দৈত্য আর তার ভাইকে মেরে ফেলেছি আমি,’ তাদের বলল জ্যাক। তোমরা এখন মুক্ত। এই নাও দুর্গের সব চাবি।’
মেয়ে তিনটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জ্যাক ওয়েলসের পথে যাত্রা করল।

0 coment�rios: