আমি বরাবর দেখেছি, আমাদের বল্টুদার যখন তেজ এসে যায়, তখন তাকে ঠেকানো ভারী মুশকিল।
রবিবার সকালে দিব্যি চাটুজ্জেদের রকে বসে আছি আর একটা কাকের পালক কুড়িয়ে নিয়ে আরামে কান চুলকোচ্ছি, হঠাৎ কোথেকে বল্টু দা এসে হাজির ৷ বললে, চল প্যালা-একটু বেরোনো যাক।
—কোথায় যেতে হবে ?
—মানে বন্ধু-বান্ধবদের একটু উৎসাহ দেওয়া দরকার। দেখছিস্ নে- সব কেমন মিইয়ে যাচ্ছে ?
শুনে কানের ভেতর আচমকা একটা পালকের খোচা লেগে গেল ।
—যাকে পাই। বুঝলি, চারদিকে সবাই যেন কি রকম দমে যাচ্ছে। এই তো সেদিন তোর বন্ধু হাবুল সেনকে বললুম, চল হাবল, একটা অ্যাডভেঞ্চারের ফিলিম হচ্ছে —দুজনে মিলে দেখে আসি। তোর পকেটে যদি পাঁচ সিকের পয়সা থাকে, তা হলেই হয়ে যাবে এখন।’ বললে বিশ্বেস করবি না প্যাাঁ, হাবুল একেবারে খ্যাক করে উঠল। আমার নাকের সামনে হাত নেড়ে বললে থাউক, অত আহলাদ করতে হইবো না । যাইতে হইলে একাই যামু—তোমারে নিমু কান্ ? শুনলি একবার কথাটা ? দেশের এ কী অবস্থা হল বল দিকি ?
আমি বললুম, হু—দেশের অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু তাই বলে যদি আমাকে উৎসাহ দিতে এসে থাকে, তবে সুবিধে হবে না তা বলে দিচ্ছি। আমার পকেটে ঠিক তিনটে নয়া পয়সা আছে। চাও তো তা থেকে একটা তোমায় দিতে পারি।
বল্টুদা নাকটাক কুঁচকে মুখটাকে মোগলাই পরোটার মত করে বললে,থাক থাক, তোকে আর দয়া করতে হবে না। তুই যে এক নম্বরের ট্যাঁক-খালির জমিদার সে আর আমি জানিনে ? চল—আমাদের অভিলাষকে একটু উৎসাহ দিয়ে আসি।
অভিলাষের নাম শুনে আমার কান খাড়া হয়ে উঠল।
—কোন অভিলাষ ? ওই যে সিনেমার সামনে নতুন রেস্তোর খুলেছে ?
বল্টুদা বললে, আবার কে ? উৎসাহ দিতে হলে ভালো ভালো লোককেই দেওয়া উচিত--অাজে বাজে লোককে দেওয়া আমি পছন্দ করি না । নে— উঠে পড়—
তক্ষুণি উঠে পড়লুম।
—কী রকম উৎসাহ দেবে বল্টুদা ?
—চল না, দেখতেই পাবি ।
পরমানন্দে উঠে পড়লুম। আমার আর ভাবন কী। পকেটে তো মোট তিনটে নয়া পয়সা। তা ছাড়া বল্টুদার মনে যখন একবার উৎসাহ দেবার তেজ এসে গেছে তখন আর ওকে ঠেকাবে কে !
—ডি-লা গ্র্যাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস—বলতে বলতে বল্টুদার পেছু নিলুম।
অভিলাষ আমাদের পাড়ার ছেলে । ওর বাবার মস্ত বড় পটোলের ব্যবসা । তাই অভিলাষকে বেশি লেখাপড়া না শিখিয়ে পটোলের ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। দু-বছর ধরে অভিলাষ এমন ব্যবসা করলে যে পটোলের দোকান পটোল তোলে আর কি ! তখন ওর বাবা রেগে মেগে ওকে কষে ঘটে থাপ্পড় দিলেন। অভিলাষ তাই শেষ পর্যন্ত এই রেস্তোরা খুলেছে আর মনের দুঃখে পটোল ভাজা পর্যন্ত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
আমরা যখন গেলুম, তখন ওর দোকানে বিশেষ লোকজন নেই। একজন ঝাঁটাগুফো ভদ্রলোক তারিয়ে তারিয়ে ডিমের পোচ খাচ্ছেন আর এক বুড়ো নাকের ডগায় খবরের কাগজটা ধরে বসে আছেন।
অামাদের দেখেই অভিলাষের হাসি কান ছাপিয়ে, নকের ডগা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল ।
–এই যে এসে বল্টুদা—আয় প্যালা—
বল্টুদা আর আমি ততক্ষণে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছি। বল্টু,দা বললে, আরে আসব বই কি ! তুই বললে আসব, না বললে আসব, তাড়িয়ে দিলেও ফিরে আসব।
শুনে অভিলাষ ‘হেঁ— হেঁ’ করল।
—অারে তাড়াব কেন ? তোমরা হলে খদের—দোকানের লক্ষ্মী। কী খাবে বলো এখন |
বল্টুদা বললে, কী খাব না, তাই বল। তোকে উৎসাহ দেবার জন্যেই তো প্যালাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম। তোর কেক খাব, বিস্কুট খাব, টোস্ট খাব, ওমলেট খাব, চপ–কাটলেট-মাংস-ও, সেগুলো বুঝি এবেলা হয় না? আচ্ছ বেশ–চপ–কাটলেটগুলো সন্ধ্যেবেলায় এসেই খাওয়া যাবে তা হলে । এখন চা খাব, কফি খাব—
আমি বললুম, যদি আরো বেশি উৎসাহ পেতে চাস, তা হলে তোর কাপ —ডিশচামচে -কাঁটাগুলোও খেতে পারি।
অভিলাষ দারুণ খুশি হতে যাচ্ছিল, কিন্তু এবারে যেন একটু নার্ভাস হয়ে গেল । তাড়াতাড়ি বললে, না— না, কাপ-ডিশগুলো বরং—
—তুই আপত্তি করছি –বল্টুদা বললে, আচ্ছ, ওগুলো তবে থাক। আর যদ্দুর মনে হচ্ছে কাপ-ডিশ খেতে খুব ভালো লাগবে না, কাঁটা-চামচে খাওয়াও বেশ শক্ত হবে। তবে প্যালার যদি খুবই ইচ্ছে হয়ে থাকে, একটা ভাঙা পেয়ালা বরং ওকে দে—বসে বসে চিবোক । আর আমার জন্যে দুখান প্লাম কেক, চারটে টোস্ট, দুটো ডবল ডিমের ওমলেট—
আমি ভীষণ প্রতিবাদ করে বললুম, না, আমি কক্ষনো ভাঙা কাপ খাব না। আমিও কেক, টোস্ট, ওমলেট এইসবই খেতে চাই।
অভিলাষ বললে, হ্যা-হ্যা, তুইও খাবি। একটু বোস—আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
প্রায় নাচতে নাচতে চলে গেল অভিলাষ। বোধ হয় ভাবছিল সকালে কার মুখ দেখেই না উঠেছে আজকে । কমসে কম তিন টাকা করে ছ’টাকার খদ্দের। কিন্তু আমি যদি বল্টুদাকে চিনে থাকি তা হলে—
এদিক বুড়ো ভদরলোক উঠে যেতেই ছো মেরে খবরের কাগজটা তুলে এনেছে বল্টু,দা। একমনে খেলার খবর পড়ছে।
বললুম, বল্ট দা—
一উু!
—পকেটে টাকা-ফাকা অাছে তো ? না তোমার পাল্লায় পড়ে ঠ্যাঙানি খাব শেষ পর্যন্ত ?
বল্টুদার নাকের ডগায় একটা মাছি অনেকক্ষণ ধরে পজিশন নেবার চেষ্টা করছিল। খবরের কাগজের ঘা খেয়ে সেটা পালালে। বল্টু দা আমার কথা শুনে উঁচুদরের একটা হাসি হাসল-বাংলায় যাকে বলে হাই ক্লাস ।
—কে ঠ্যাঙাবে ? অভিলাষ ? না ও তেমন ছেলে নয়।
– তাই নাকি ?—আমার খটকা তবুও যেতে চায় না। জিজ্ঞেস করলুম, কী করে জানলে ?
–ও যখন পটোলের দোকানে বসত—জানিস তো ? সেই যখন দোকানের পটোল
তোলার জো হয়েছিল ? সেই সময় একদিন ও একা দোকানে বসে রয়েছে, দুজন লোক এসে হাজির ৷ একজন বললে, “খোকন, আমায় পটলডাঙার টেনিদার বাড়িটা চিনিয়ে দিতে পারো ?’ ও বললে, “ওই তো— বাটার দোকানের পাশ দিয়ে চলে যান । শুনে লোকটা বললে, “আমি কলকাতায় নতুন এসেছি ভাই—পথ-ঘাট কিছু চিনিনে। একটু আসবে সঙ্গে ? অভিলাষ বললে, “আমি যে দোকানে একা আছি । লোকটা বললে ‘তাতে কী—আমার সঙ্গের বন্ধুটি তোমার দোকান পাহার দেবে।’ শুনে অভিলাষ তো তাকে এগিয়ে দিতে গেল ।
পটলডাঙার গলিতে ঢুকেই লোকটা একদম ভ্যানিশ। ও মশাই, কোথায় গেলেন বলে অভিলাষ একঘণ্টা ধরে চেঁচিয়ে মিথ্যে গরু খোঁজ করে, ফিরে এসে দেখে লোকটা সঙ্গীও নেই। আর নেই—
বললুম, কী নেই ?
বল্টুদা বললে, এক ঝুড়ি পটোল। ভীষণ মন খারাপ করে হিসেবের খাতায় লিখে রাখল রাখলে ‘সাত সের তের ছটাক পটল কেহ বাকীতে লইয়া গেল। তাহার নাম-ঠিকানা কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না।” আর সেই হিসেব দেখে ওর বাবা—
—ওর বাবা কী করলে ?
বল্টুুদা চোখ মিট-মিট করে বললে, পরে বলব। ওই যে অভিলাষ আসছে ।
সত্যই অভিলাষ আসছে। নিজের হাতে করে আনছে দুটো প্লেট । তাতে ডবল ডিমের ওমলেট, দুটো করে প্লাম কেক আর চারটে করে টোস্ট !
বল্টুদা বললে, বা, তোফা! —তারপর প্রায় অভিলাষের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিয়েই খাওয়া শুরু করে দিল । আর আহ্লাদী আহ্লাদী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইল অভিলাষ। কী খুশি !
—ওমলেট কেমন হয়েছে বল্টুদা ?
—খাসা ! তোকে তো উৎসাহ দিতেই এলুম অভিলাষ ! তোর ওমলেট খেয়েই বুঝতে পারছি-- তোর ভবিষ্যৎ কী নিদারুণ উজ্জল ।
অভিলাষের চোখ-মুখ চক-চক করে উঠল –তাই নাকি ?—
—তবে আর বলছি কী ? তোর রেঁস্তোরাঁ দিনের পর দিন ফেঁপে উঠবে, দেলখোসকে মেরে বেরিয়ে যাবে।
—সত্যি ?—আনন্দে অভিলাষ বার তুই খাবি খেল ।
—তা ছাড়া কী ? তারপর তোর রেঁস্তোরাঁ আরো বড় হবে – গ্র্যাগু হোটেলকেও ছাপিয়ে উঠবে। গ্রেট ইস্টার্ণ বা ফিরপোতে না গিয়ে দলে দলে লোক ছুটে আসবে তোর দোকানে। চাং-ওয়ার চাউ চাউ হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকবে আর তুই গদী-আঁটা চেয়ারে বসে খালি টাকা গুনতে থাকবি ।
বক্তৃতা আর খাওয়া সমানে চলছে বল্টদার। আমিও যতটা পারি চট্পট্ প্লেট সাফ করছি। কখন যে কী হয়ে যায় কিছুই তো বলা যায় না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ নেচে নিলে অভিলাষ ; তারপর দৌড়ে যেতে যেতে বলে গেল, বোসো, তোমাদের জন্য ভালো করে ডবল কাপ চা নিয়ে আসি দুটো। বল্টুদা শেষ প্লাম কেকটা গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বললে, কেমন বুঝছি ? বললুম, ভালো নয়। পকেটে যদি টাকা না থাকে— —টাকা ? টাকা কী হবে ? উৎসাহ দেবার শক্তি থাকলেই যথেষ্ট। দেখছিস না—এর মধ্যেই কেমন নাচতে শুরু করেছে অভিলাষ ? অার তাও ভেবে দ্যাখ প্যালা— ঝট্ করে কি রকম ওর রেঁস্তোরাঁটাকে গ্র্যান্ড হোটেলের চাইতেও বড় করে দিলুম। আর কী চাই ? হু হু ।
—মুখে বললেই তো হয় না !
—মুখে বলব না তো কান দিয়ে বলব নাকি ? কিন্তু তুই তো আমায় ভাবিয়ে তুললি, সত্যিই তো–কান দিয়ে কি বলা যায় ? অবিশ্যি নাক দিয়ে কেউ কেউ ঘুমের সময় বলে বটে, কিন্তু কী যে বলে তা বোঝাই যায় না । বোধ হয় হিব্রু বলে । না কি জার্মান ভাষা ? খুঁ-ঘুরুর—ঘুরুর— আচ্ছা, চীনে ভাষা না তো ? তোর কী মনে হয় প্যালা ?
নাকের ডাকের ভাষাটা যে কী বোঝবার আগেই অভিলাষ চা আনল। কী মনে হয় তা আর বলতে পারলুম না।
বল্টুদা আর আমি বেশ মন দিয়ে চা-টা শেষ করলুম। তারপর ধীরে মুস্থে— গোটা দুই ঢেঁকুর তুলে বল্টুদা উঠে দাঁড়াল। আমিও তক্ষুণি একেবারে দোরগোড়ায়— এইবারে যা হওয়ার হবে—-এসপার ওসপার।
বল্ট দা বললে, জোর খাইয়েছিস্ ! দ্যাখনা—বছর ঘুরতে না ঘুরতে তুই দেলখোসকে মেরে দিবি । তারপর ফিরপো—গ্রেট্ ইস্টার্ণ-গ্র্যাণ্ড হোটেল—
আনন্দে অভিলাষ হাসের মতো হাসফাস করতে লাগল ।
—তা হলে চলি—
—এই যে বিলটা—অভিলাষ একখানা কাগজ এগিয়ে ধরল : পাচ টাকা বারো আনা—
—কিসের বিল ? কিসের টাকা ?—বল্টুদা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আর অভিলাষ পড়ল—না, আকাশ থেকে নয়, সোজা স্পুটনিক থেকে ।
—বা-রে, পাঁচ টাকা বারে আনার খেলে দুজনে মিলে ?
বল্টুদা বললে, মোটে পাঁচ টাকা বারো আনার ? তা হলে তো তোর কাছে আরো চুয়াল্লিশ টাকা চার আনা পাওনা রইল।
অভিলাষ এবার স্পুটনিক থেকে—না-না, সোজা চাঁদ থেকে পড়ল। পাঁচ বার খাবি খেয়ে বললে, চুয়াল্লিশ টাকা চার অান মানে ? আমি আবার কবে তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি ? কক্ষণো না । তুমি এক পয়সাও পাও না আমার কাছ থেকে ।
—বটে ? বসে বসে পঞ্চাশ টাকার উৎসাহ দিইনি এতক্ষণ ? বলিনি—লেগে থাক অভিলাষ—শেষে গদী-অাঁটা চেয়ারে বসে টাকা গুনবি ? সেই থেকে তো মোটে পাঁচ টাকা বারো আন শোধ হল ।
অভিলাষ বললে, তা—আঁ—আঁ—
—আঁ আঁ আঁ নয়, বল হাঁ হাঁ হাঁ। আর তোর হিসেবের খাতায় লিখে রাখ ; “কেহ পঞ্চাশ টাকা জমা দিয়া পাঁচ টাকা বারাঁ আনার খাইয়া গেল। পরে ক্রমশঃ বাকীাঁ খাইবে।” আচ্ছা চলি, টা-াঁ-—
অভিলাষ হাঁ—হাঁ বলতে পারলে না—একেবারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল ।
কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে আমার মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল । বেচার অভিলাষ । বল্টুদার পাল্লায় পড়ে ওকে অমন ভাবে ঠকানোটা একদম ঠিক হল না—না খেলেই ভালো হত বল্টুদার সঙ্গে। কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার পকেটে তো মোটে তিনটে নয়া পয়সা ছাড়া কিছু নেই। যদি কোনো দিন যোগাড় করতে পারি, ওর টাকা নিশ্চয় আমি শোধ করে দেব ; এ সব জোচ্চরিতে আমি নেই!
ভীষণ রাগ হল বল্টুদার ওপর। ট্রামে উঠতে যাচ্ছি—বল্টুদা ঠ্যাং ধরে আমায় টেনে নামাল।
—কোথায় যাচ্ছিস ?
—যাব একবার বলাই ঢ্যাং লেনে।
—ও, আমাদের পাচুগোপালের বাড়িতে ? তা চল—চল। ওর ক্ষেমঙ্করী পিসিম বেশ ভালো খাওয়ায় ।
কী রাক্ষস দেখেছ ? এই মাত্র অভিলাষের মাথায় কাঁটাল ভেঙে এতগুলো খেয়ে এসেছে। আবার এক্ষুণি খাই খাই করছে।
বললুম, আজ গিয়ে সুবিধে হৰে না। পাচুগোপাল ফুটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে পড়ে আছে।
—পা মচকে পড়ে আছে ? আহা, চুক চুক। তা হলে তো ওকে উৎসাহ দেবার জন্যে আরো বেশি করে যাওয়া দরকার। চল-চল—
একটা হ্যাঁচকা টানে বল্টুদা আমায় ট্রামে তুলে ফেলল।
পাঁচুগোপালের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তে ওর ক্ষেমঙ্কর পিসিমা দরজাটা খুলে দিলে। বল্টুদা সঙ্গে সঙ্গে এক মুখ দাঁত বের করে ফেলল। গলেই গেল বলতে গেলে ।
—পাঁচু কেমন আছে দেখতে এলুম পিসিমা ।
ক্ষেমঙ্করী পিসিমা ভারী খুশি হলেন : আহা বাবা, আয় আয়। বাাঁ আমার আজ ছুদিন থেকে মনমরা হয়ে শুয়ে আছে।
—সেই জন্যেই তো এলুম। শরীর খারাপ বলেই তো ওকে ভালো করে উৎসাহ দেওয়া দরকার ।
—তাই দে বাবা । আমি তোদের জন্য ক’টা তালের বড়া ভেজে আনি ।
সত্যিই তালের বড়ার গন্ধে বাড়ি ম-ম করছিল। বল্টুদা মুখটাকে ছুঁচোর মতো ছুঁচোলো করে আমায় চুপি চুপি বললে, দেখলি তো প্যালা—হু-হু! কেমন প্রেমসে গরম গরম তালের বড়া খাওয়া যাবে। কপাল ভালো থাকলে এমনিই হয়। এখন চল দেখি-- পেঁচোটা কী করছে ।
পায়ে চুন-হলুদ মাখিয়ে পাঁচুগোপাল প্যাচার মতো পড়ে আছে। বল্টুদা গিয়ে ধপাৎ করে তার পাশে বসে পড়ল ।
—কিরে পেঁচো, কেমন আছিস্ ?
পাচুঁ চি-চি করে বললে, ভীষণ ব্যথা।
—ভীষণ ব্যথা –বর্টুদা উৎসাহ দিতে লাগলঃ অমন হয়। ব্যথা হতে হতে শেষে সেপটিক হয়ে যায়।
পাঁচুগোপাল ভীষণ ঘাবড়ে গেল : মচকানি থেকে সেপটিক হয় ?
—হয় বই কি ! অনেক সময় পা কেটে ফেলতে হয়—কত লোকে মরেও যায়।
পাঁচুগোপালের চোখ কপালে চড়ে গেল : অ্যা—আমি তবে মারা যাব নাকি ?
উৎসাহ দিয়ে বল্টুদাবলতে লাগল, যেতে পারিস্–কিছু অসম্ভব নয়। তবে মারা না-ও যেতে পারিস্–মানে, মনে জোর থাকলে বেঁচে গেলেও বেঁচে যেতে পারিস। তবে একটা পা কাটা গেলেও ঘাবড়াসনি। না হয় লাঠি ভর করেই হাটবি। আর যদি মারাই যাস্—মনে কর মারাই গেলি—তা হলেও ঘাবড়ে যাসনি। দেখিস পেঁচো—বল্টুদা আরো বেশি উৎসাহ দিতে লাগল ? তোর মৃত্যুর পর আমরা কি রকম একখান শোকসভা—
বল্টুদা আর বলতে পারল না—শব্দ হল ঝপাং ! বাপ—বাপ বলে বল্টুদা লাফিয়ে উঠল।
ক্ষেমঙ্কর পিসিমার ঝাটা আবার নামল বল্টুদার পিঠে। পিসিমা যে কখন ঘরে ঢুকেছে আমরা দেখতে পাইনি।
বিকট রকম দাঁত খিঁচিয়ে ক্ষেমঙ্করী পিসিম আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল ; তবে রে অলপ্পেয়ে–নচ্ছার, ড্যাকর, হাড়হাবাতে ! আমার পাঁচুর ঠ্যাং কাটা যাবে? আমার পাঁচু মারা যাবে ? তার অাগে তোরই মরণ ঘনিয়েছে—দেখে নে !
আবার ঝাঁটা নামল ; ঝপাং—ঝপাং—
—বাবারে গেছি—গেছি—বলে বল্টুদা ছুটল। পেছনে ছুটল ঝাটা হাতে ক্ষেমঙ্করী পিসিমা । কী আর করা—আমাকেও ছুটতে হল সঙ্গে সঙ্গে ।
সন্ধ্যেবেলা গেছি বল্টুদার বাড়িতে। গায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে পড়ে আছে বল্টুদা। ঝাঁটার ঘায়ে বল্টুদাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ক্ষেমঙ্কর পিসিমা । উৎসাহ দেবার পালা আমার এবার।
বললুম, কিছু ভেবে না বল্টুদা ঝাঁটার ঘায়ে যদি সারা গা সেপটিক হয়ে যায়— যদি তুমি মারাই যাও তা হলেও কিছু চিন্তা কোরো না । অভিলায়ের দোকানে তোমার যে চুয়াল্লিশ টাকা চার আন পাওনা আছে—সেটা আমিই খেয়ে আসব এখন।
কিন্তু ৰল্টুদা একদম উৎসাহ পেল না। চেঁচিয়ে আমায় গাল দিতে লাগল : বেরো —বেরো এখান থেকে । উল্লুক—ভলুক—শল্লৰ্কী—পক্কবিশ-অম্লজান কোথাকার—
কী ছোটলোক—দেখেছ ?
0 coment�rios: