কোন এক সময়ে এক নদীর ধারে ঘর তৈরী করে এক পশুপালক বাস করত। তার বাড়ির চারদিকে পশু চড়ানোর জন্য অনেক জায়গা পড়ে ছিল। তার ঘরের সাথেই ছিল বলদ আর গাধার গোয়াল। ঘরটা ছিল মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরী।
একদিন সন্ধার কিছু আগে বলদটা গোয়ালে ঢুকে দেখে গাধাটা সব খাবার খেয়ে উজার করে, খড়ের বিছানায় নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
গাধাটার কাজ ছিল প্রতিদিন মালিককে পিঠে করে নিয়ে খামার ঘুরে আসা। ব্যাস তারপরই ছুটি, আর কোন কাজ নেই। এরপর খাও আর ঘুমাও।
বলদের গোয়ালে ঢ়োকাতে গাধার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বলদটা তখন আক্ষেপ করে বলল,‘ভাই তুমি তো মস্ত সুখে আছো। তোমার কি সুন্দর সুখের জীবন! তুমি যে খাবার খাও আমি তা স্বপ্নে ভাবতে পারি না। আর অন্য সব আরামের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তুমি ভাগ্যে সুখ নিয়েই জন্মেছ!’
এই সময় মালিক গোয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় বলদের কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর কান পেতে রইল... আর কি কি কথা শোনা যায়।
বলদটা বলে চলল,‘ আমার মতো ভাগ্য তো আর তোমার নয় যে সকাল-সন্ধা খেটে মরবে। খেটে খেটে আমার শরীর আর চলে না, চেয়ে দেখ? আর ভালমন্দ খাবার খেয়ে খেয়ে তোমার শরীর দিনে দিনে কেমন নাদুস নুদুস হয়ে উঠেছে, চেয়ে দেখ? আমাকে ভোর হবার আগেই জোয়াল কাঁধে নিতে হয়। আর রেহাই পাই সেই সন্ধার সময়।’
বলদের কষ্টের কথা শুনে গাধার মন গলে গেল। এ এবার বলল,--‘ভাই, তোমার দুঃখের আমার মন বারবার কেঁদে উঠছে। তুমি যদি চাও তবে তোমাকে একটি চমৎকার বুদ্ধি দিতে পারি। কাল ভোরে যখন চাকর তোমাকে নিতে আসবে তখন তুমি চুপটি করে পড়ে থাকবে। কিছুতেই উঠে দাঁড়াবে না। তারপর বদমাস চাকরটা পিটিয়ে পিটিয়ে যে করেই হোক তোমাকে মাঠে নিয়ে যাবেই। তারপর কাঁধে জোয়াল চাপানোর চেষ্টা করবে। কিছুতেই তুমি জোয়াল কাঁধে নিবে না। যদি জোর করে জোয়াল তোমার কাঁধে তুলেও দেয় তবে তুমি মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়বে। দেখবে তোমাকে দিয়ে আর কাজ করাবে না।
মালিক সব কথা শুনল। সকালে গোয়ালে দিয়ে দেখে গত রাতে গাধাটা যা যা শিখিয়ে দিয়েছিল বলদটা তাই তাই করেছে।
মালিক তখন চাকরকে বলল,--‘এক কাজ কর বলদটাকে গোয়ালে রেখে গাধাটার কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দে।’
মালিকের আদেশে চাকর গাধাটার কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে দিল আর সূর্য ডোবার আগে পর্যন্ত গাধাকে দিয়ে কাজ করাল। দিন শেষে ক্লান্ত গাধা গোয়ালে ফিরলে বলদ বলল, --‘ভাই, আজ একটু বিশ্রাম পেয়ে অনেক দিনের ক্লান্তি একটু জুড়লো। আল্লাহ তায়া’লা তোমায় দোয়া করবেন। এসো, আমরা মনে সুখে একটু গল্প করি।’
গাধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, --‘গল্প আর আমার মধ্য থেকে বেরোচ্ছে না ভাই। তোমার দুঃখের কথা ভেবে ভেবেই আমার মনটা শুকিয়ে গেছে! মালিকের কথায় যা বুঝলাম, তোমাকে বোধ হয় আর রাখবেন না।’
বলদটা চমকে উঠে বলল,--‘রাখবেন না! রাখবেন না মানে? তবে কি আমায় জবাই করবে নাকি?’
‘-- না। কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেবে তোমাকে। চাকরটাকে বলছিল, বলদটা যদি মরে যায় তবে অনেক টাকা লোকসান হবে। তার চেয়ে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেই, তুই কি বলিস?’ মালিকের কথা শোনার পর ভয়ে দুঃখে আমি একেবারে কুঁকড়ে ছিলাম। তোমায় যদি কসাইয়ের হাতে তুলেই দেয় তবে আমি এত বড় গোয়ালে একা একা কি করে থাকব তাই ভেবে পাচ্ছি না।
ব্যস, বলদটা এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। গামলা থেকে খড় খেতে লাগল। শরীরে শক্তি না বাড়ালে সে নাঙল টানবে কি করে। খড় খেতে খেতে গাধাকে বলল, ‘ভাই, আগে খবরটা দিয়ে তুমি আমার কী উপকারই যে করলে তা আর ভাষায় বলে বোঝাতে পারব না। কাল থেকে আমি এমন আচরণ করব যে, আমি একেবারে সুস্থ।’
মালিক গোয়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে, গাধা আর বলদের সব কথাই শুনল।
পরদিন সকালে চাকরটা গোয়ালে ঢুকে দেখে বলদটা একেবারে সুস্থ। স্বাভাবিক। এবার সে গাধাটার বদলে বলদটাকে নিয়েই মাঠের দিকে রওনা দিল। বলদটাকে নিয়ে চলে যাবার পর গাধা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
মনিব তার স্ত্রীকে একটা মজা দেখাবার কথা বলে মাঠে নিয়ে গেল। চাকর বলদের কাঁধে জোয়াল তুলে দিতেই সে এমন ভাব দেখাল যেন আর তর সহ্য হচ্ছে না। নাঙল জুড়তেই সে লম্বা লম্বা পায়ে পুরোমাঠ ঘুরে জমি চাষ করতে শুরু করল।
ব্যপার দেখে মালিক যেন হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দেবার উপক্রম হল। মালিকের স্ত্রী কিছু বুঝতে না পেরে বলল,--‘কি গো, কি হলো তোমার? এমন করে হাসছ কেন! হয়েছে কি বলবে তো? আমায় দেখেই কি তবে তোমার এমন হাসি পাচ্ছে?’ আমাকে বলতেই হবে তুমি কেন হাসলে।
--‘কী যে বল বিবিজান, নিজেই জান না। তোমায় দেখে হাসতে যাব কেন। তোমায় নিয়ে কি আজ থেকে ঘর করছি যে, এতদিন, এত বছর পরে তোমাকে দেখে আমার হাসি পাবে? আজ থেকে এক’শ বিশ বছর আগে তোমায় নিয়ে ঘর বেঁধেছি। আর এখন আমার বয়স কত হবে তা জানা নেই। একদিন তুমি ছিলে আমার চাচার মেয়ে। তারপর তা থেকে বিবিজান হয়ে পাশে রয়েছ, ঘর করছ। কেন আমি হাসছি সবই খুলে বলব, তবে এখন নয়। হাসির কথা বলতে গিয়ে যদি আমার মৃত্যুও হয় তবুও আমি বলব। তুমি এক কাজ কর, বাড়ি গিয়ে আমার ছেলে -মেয়েদের ডাক, গ্রামের মাতব্বরদের ডাক। জমি-জমা সব তোমাদের মাঝে ভাগ করে দেবার পর কথাটা খুলে বলব। কথা বলার পর যদি আমার মৃত্যুও হয় তবুও কোন আক্ষেপ থাকবে না।
মালিকের বিবির অনুরোধে ছেলে-মেয়ে, গ্রামের মাতব্বর আর বয়ষ্ক সব মানুষ হাজির হল। তারা সব শুনে মালিকের বিবিকে বলল, ‘দেখ, তোমরা অনেক দিন ধরে সংসার করছ। বয়সের ভারে এখন তোমরা বৃদ্ধ। তুমি যদি এমন জেদ ধরে তার কাছে হাসির কারনটা জানতে চাও আর যে যদি তা বলতে গিয়ে মারা যায় তবে তোমার কি হবে। এতগুলো সন্তান আর নাতীপুতি নিয়ে তুমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’
কিন্তু মালিকের বিবি দমবার পাত্র নন। তিনি যে করেই হোক শুনবেন।
আর কোন উপায় না দেখে মালিক কোঁদাল নিয়ে গোয়ালের পিছনে গেল আর নিজের কবর নিজেই খুঁড়তে লাগল। এমন সময় মালিক তার বাড়ির মোরগ আর কুকুরের কথা শুনতে পেল।
কুকুর মোরগকে বলছিল, ‘তোর কি কোন বুদ্ধি-সুদ্ধি নাই! আমাদের মালিক মরতে বসেছে, আর তুই কিনা নাচানাচি করছিস!’
মোরগ বলল, ‘কি হয়েছে খুলে বল?’
কুকুর তখন সব কথা মোরগকে খুলে বলল। কুকুরের সব কথা শোনার পর মোরগ বলল, আমি একাই পঞ্চাশটা মুরগিকে সামলে রাখি আর মালিক কিনা একজন বিবিকে সামলে রাখতে পারে না! আমি হলে জামের ডাল দিয়ে পিঠে দু’ঘা বসিয়ে দিতাম।
মালিক পাশে থেকে সব শুনে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। বিবির কাছে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,--‘আমার শোবার ঘরে চল। গোপন রহস্যের কথা ওখানেই তোমাকে বলব।’
মালিক এবার বাগানে গিয়ে একটা জামের ডাল ভেঙে আনল আর সেটা দিয়ে অচমকা বিবির পিঠে বসিয়ে দিল চড়। মালিকের বিবি কেঁদে কেঁদে বলল, আমি আর তোমার হাসির কথা শুনতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমাকে আর মেরো না।
মালিকের বিবি ঘরের বাহিরে এসে সবাইকে চলে যেতে বলল এবং মালিক ও তার বিবি আরও বহুকাল সুখে দিন কাটাতে লাগল।
গল্প শেষ করে বৃদ্ধ উজিড় মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।
শাহারাজাদ বলল, ‘বাবা, আমার ইচ্ছা তো তোমার কাছে আগেই বলেছি।’
বৃদ্ধ উজির আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েকে বিয়ের জন্য সাজতে বললেন। আর বাদশাহের কাছে খবর দিতে ছুটলেন যে তার আজকের রাতের জন্য একজন কুমারী মেয়ে পাওয়া গিয়েছে।
এদিকে শাহরাজাদ তার ছোট বোন দুনিয়াজাদকে বলল, --‘শোন, আমি এক রাত্রের জন্য বাদশাহের বেগম হতে চলেছি। আমি সময়মতো তোকে ডেকে পাঠাব। তুই কিন্তু যাবি। বিয়ে হলে গেলে বাদশা যখন আমারকে শোবার ঘরে নিয়ে যাবেন তখন তুই আবদার করবি ---দিদি গল্প শোনাও--- দিদি গল্প শোনাও। না হলে যে আমার ঘুম আসবে না। প্রয়োজন হলে একটুি আধটু কান্নাকাটি করবি । আমি তখন গল্প বলা শুরু করব। ব্যস, এতেই হবে। দেখবি যেন কোন ভুল না হয়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃদ্ধ উজির ফিরে এলেন। বউবেশে সেজে থাকা বড় মেয়ে শাহজাদকে নিয়ে শারিয়ার প্রাসাদের দিকে পা বাড়ালেন।
রাতে বিয়ের পর বাদশা শারিয়ার শোবার ঘরে দিয়ে দেখলেন শাহরাজাদ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তা দেখে বাদশা বললেন, তুমি কাঁদছ কেন? তুমি আজ থেকে আমার বিবি। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। বল তোমার কান্নার কারন?
শাহরাজাদ চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘জাঁহাপনা, আমার একটা ছোট বোন আছে। আমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও সে থাকতে পারে না। আমাকে ছাড়া সে হয়তো ঘুমাতেও পারবে না। সে সারারাত না ঘুমিয়ে শুধুই কান্নকাটি করবে। তাকে একটিবার দেখার জন্য আমার মনটা অস্থির হয়ে আছে।
বাদশাহ হেসে বললেন, --‘ব্যাস, এটুকুই তোমার কান্নার কারন! তুমি এখনই চোখের পানি মুছে ফেল। আমি এক্ষুনি আমার চাকরদের পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার বোনকে এখানে আনার জন্য।
কিছুক্ষন পরে চাকরেরা শাহরাজাদের ছোট বোন দুনিয়াজাদকে নিয়ে আসল। ঘরে ঢুকেই দুনিয়াজাদ তার দিদিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাও করে কেঁদে উঠল। সে কি কান্না। কে বলবে যে, এগুলো সবই অভিনয়।
শাহরাজাদ তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে শান্ত করল এবং বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দুনিয়াজাদ তখন শাহরাজাদকে বলল, ‘দিদি, আজ আমাকে গল্প শোনাবে না? তোমার গল্প না শুনলে আমার যে ঘুম আসে না। তুমি কি সুন্দর করে গল্প বল! বনের হিংস্র পশু-পাখিও তোমার গল্প শান্ত হয়ে শোনে।
দু’বোনের কথা শুনে শারিয়ারের আগ্রহ হল। তিনি বললেন, ‘শোনাও বেগম তোমার গল্প। দেখি তোমার গল্প আমাকে মুগ্ধ করতে পারে কিনা। কিন্তু খেয়াল থাকে যেন, ভোর হবার আগেই যেন গল্প শেষ হয়।
সূচিপত্রে যাও...
সূচিপত্রে যাও...
0 coment�rios: