Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

বহু দূরে সাগরপারের এক শীতের দেশ। অনেক দিন আগে জ্যাক নামে এক ছেলে থাকত সেখানে। সংসারে তার আপনজন বলতে ছিল শুধুমা। ওদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল ন...

হাঁদা জ্যাক -- ইংল্যান্ডের রূপকথা

বহু দূরে সাগরপারের এক শীতের দেশ। অনেক দিন আগে জ্যাক নামে এক ছেলে থাকত সেখানে। সংসারে তার আপনজন বলতে ছিল শুধুমা। ওদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। বুড়ি মা চরকায় সুতো কেটে সামান্য যা আয় করত তা দিয়েই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলত।
জ্যাক কিন্তু ছিল ভারী অলস। সারা শীতকাল সে কাটাত ঘরের ভেতর আগুনের পাশে বসে থেকে। আর শীত ফুরোলে ঘুরে বেড়াত বনে-বাদাড়ে, হাত-পা ছড়িয়ে রোদে শুয়ে থাকত। মায়ের সাধ্য ছিল না বলে-কয়ে তাকে দিয়ে কোন কাজ করায়। শেষে একদিন মায়ের ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে গেল। ‘এখন থেকে কাজ করে খাবি, নয়তো বাড়ি ছেড়ে যেখানে ইচ্ছে চলে যাবি, পরিষ্কার বলে দিল মা !
জ্যাক দেখল এরপর আর বসে থাকা যায় না। সেদিন ছিল সোমবার। পরদিন মঙ্গলবার সে কাজ খুঁজতে বেরোল।
কাছেই এক কৃষকের বাড়িতে মজুরের কাজ পাওয়া গেল। সারাদিন খেটে জ্যাক মজুরি পেল এক পয়সা। কিন্তু সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে পয়সাটা সে হারিয়ে ফেলল ।
'হাঁদা ছেলে, মা বলল ব্যাপার শুনে, পয়সাটা রাখা উচিত ছিল পকেটে ।
"এর পর থেকে তা-ই করব, মা, জ্যাক জবাব দিল । পরদিন বুধবার আবার কাজের সন্ধানে বেরোল সে । এবার কাজ জুটল এক গোয়ালার বাড়িতে। সারাদিনের খাটুনির পর গোয়ালা তাকে মজুরি হিসেবে দিল ছোট এক কলসি দুধ।
দুধের কলসি প্রথমে হাতে করে বয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছিল জ্যাক। কিন্তু কিছুদূর যেতেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল তার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দুধভর্তি কলসিটা নিজের জামার মস্ত পকেটে ঢোকাল। তারপর আবার এগিয়ে চলল পথ বেয়ে। বাড়ি পৌছবার অনেক আগেই সবটুকু দুধ ছলকে পড়ে কলসি শূন্য হয়ে গেল।
বোকার হদ্দ!’ কাণ্ড দেখে তিরস্কার করল মা, মাথায় করে সাবধানে বয়ে আনতে পারলি না?’
ঠিক আছে, তা-ই করব এরপর, জ্যাক বলল । বৃহস্পতিবার আবারও এক কৃষকের বাড়িতে কাজ নিল জ্যাক । সন্ধেয় পারিশ্রমিক হিসেবে কৃষক তাকে মস্ত এক তাল নরম পনির দিল। জ্যাকের খুশি আর ধরে না। পনিরের তাল মাথায় চাপিয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ির পথ ধরল। বেশির ভাগ পনির ছড়িয়ে এল রাস্তায়, বাকিটুকু মাখামাখি হয়ে রইল তার চুলের জঙ্গলে।
'হাদা আর কাকে বলে!” ছেলের বোকামি দেখে মা বিরক্ত হয়ে বলল, উচিত ছিল খুব সাবধানে হাতে করে বয়ে আনা ।
আচ্ছা, মা, দেখো এরপর তা-ই করব, জ্যাক সঙ্গে সঙ্গে বলল । শুক্রবার জ্যাককে কাজে খাটাল এক রুটিওয়ালা । এবার পারিশ্রমিক হিসেবে পয়সা বা খাবার কোনটাই পেল না জ্যাক, পেল একটা বড়সড় বেড়াল। খুশিমনেই সেটাকে নিল সে, খুব সাবধানে দুহাতে আঁকড়ে ধরে বয়ে নিয়ে চলল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়ালটা ধারাল নখ দিয়ে এমনভাবে তার হাত আঁচড়াতে শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত সেটাকে ছেড়ে না দিয়ে আর উপায় রইল না। বাড়ি গিয়ে মাকে দুঃখের কথা বলল জ্যাক ।
'হাবা ছেলে, ওটার গলায় একটা রশি বেঁধে টেনে নিয়ে এলেই তো হতো!’ মা বলল ।
বেশ তো, তা-ই হবে এরপর, জ্যাকের উত্তর । শনিবার জ্যাক এক কসাইয়ের দোকানে কাজ করল। তার কাজে খুশি হয়ে কসাই তাকে ভেড়ার মাংসের মস্ত একটা টুকরো দিল মজুরি হিসেবে। মায়ের কথা জ্যাক ভোলেনি। মাংসের টুকরোটার এক মাথায় লম্বা একটা রশি বাঁধল সে, তারপর হড়হড়িয়ে টেনে নিয়ে চলল বাড়ির দিকে। যখন বাড়ি এসে পৌছল, কাদা-ময়লা মাখা মাংসের টুকরোটাকে তখন আর মাংস বলে চেনার উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ফেলে দিতে হলো সেটা ।
মা এবার ভারী রেগে গেল। পরদিন রোববার। কোন কাজকর্ম, রোজগারের উপায় নেই। অথচ ঘরে খাবার বলতে আছে শুধু বাঁধাকপি ।
'হাদা কোথাকার!” ছেলেকে বকতে লাগল মা, আমন চমৎকার মাংসের টুকরোটা নোংরা মেখে নষ্ট করলি? কাঁধের ওপর ফেলে বয়ে নিয়ে আসার মতো বুদ্ধি তোর হলো না?
আর ভুল হবে না, মা, জ্যাক কাচুমাচু মুখে বলল, তোমার কথামতোই কাজ করব।"
সে এক খামারে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করল। খামার-মালিক খুশি হয়ে মজুরি হিসেবে জ্যান্ত একটা গাধা দিয়ে দিল তাকে। জানোয়ারটার দুটাে করে পা একসঙ্গে বেঁধে সেটাকে অনেক কষ্টে কাঁধে চাপিয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে বাড়ির পথে যাত্রা করল জ্যাক ।
রাস্তাটা গিয়েছে এক ধনী সওদাগরের প্রাসাদের পাশ দিয়ে। সওদাগরের একটিমাত্র মেয়ে–অপরূপ সুন্দরী। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, সে কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। ছোটবেলায় আর দশটা ছেলেমেয়ের মতোই স্বাভাবিক আর হাসিখুশি উচ্ছল ছিল মেয়েটা। কিন্তু অল্প বয়সে হঠাৎ মাকে হারিয়ে চুপচাপ মন-মরা হয়ে যায়। এভাবে থাকতে থাকতে একসময় কথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় তার। তারপর ধীরে ধীরে কানে শোনার শক্তিও লোপ পায়। চেষ্টা-চরিত্রের কিছু বাকি রাখেননি সওদাগর, মেয়ের বহু রকম চিকিৎসা করিয়েছেন–কিন্তু কোন ফল হয়নি। কোনদিন আর একটাও কথা বলেনি মেয়েটা, একবারও হাসেনি। হাকিম-বৈদ্যরা বলেছেন, কেউ যদি তাকে হাসাতে না পারে তাহলে সে আর জীবনে কথা বলবেও না ।
হতভাগ্য সেই বোবা তরুণী প্রতিদিনের মতোই মলিন মুখে কত রকম লোকজন পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করে, যেতে যেতে কত গল্পগুজব করে তারা। সে শুধু নীরবে দাড়িয়ে চেয়ে থাকে, আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার চোখে চারপাশের সুন্দর জগৎ যেন নিঃশব্দ এক ছবিমাত্র।
হঠাৎ মেয়েটা দেখতে পেল, কোথাকার এক আজব ছেলে জলজ্যান্ত একটা গাধা কাঁধে চাপিয়ে জানোয়ারটার ভারে নুয়ে পড়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে। এমন অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য জীবনে তার চোখে পড়েনি। নিজের অজান্তেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। তারপরই আশ্চর্য হয়ে দেখল, দিব্যি কানে শুনতে পাচ্ছে আবার, কথাও বলতে পারছে অনায়াসে। আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল সে বাবার কাছে।
সাড়া পড়ে গেল প্রাসাদে, সওদাগর থেকে শুরু করে দাসদাসীদের পর্যন্ত খুশির সীমা রইল না। এমন আশ্চর্য সৌভাগ্যের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি ।
যার জন্যে এমন অসম্ভব কাণ্ড সম্ভব হলো সেই জ্যাককে সমাদর করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রাসাদে। পরিচ্ছন্ন হয়ে সওদাগরের উপহার দেয়া দামী পোশাক পরে সে যখন সওদাগরকন্যার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তখন তাকে দেখে মনে হতে লাগল ঠিক যেন এক সুদর্শন রাজপুত্র।
কৃতজ্ঞ সওদাগর জ্যাকের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিলেন। হাঁদা জ্যাক রাতারাতি প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে গেল।
কিছুদিন পর বউ নিয়ে জ্যাক তার নিজের বিরাট নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠল। সঙ্গে নিয়ে গেল মা-কে ।

0 coment�rios: