এক সময় গ্রেথেল নামে এক রাঁধুনি-মেয়ে ছিল । তার জুতোর গোড়ালি দুটো লাল রঙের । সেই জুতো-জোড়া পরে বাইরে বেরুলেই মনের আনন্দে ঘুরে ঘুরে সে নাচত আর মনে মনে বলে উঠত, “আমার মতো সুন্দরী আর হয় না ’ বাড়ি ফিরেই এক ঢোক করে আঙুর-রস সে খেত তার পর চেখে চেখে দেখত নিজের রান্না ভালো-ভালো খাবারগুলো । মনে মনে বলত, “রান্নাবান্না ভালো হয়েছে কি না সেটা তো রাধুনির চেখে দেখা দরকার।’
একদিন বাড়ির কর্তা তাকে বললেন, “আজি সন্ধেয় একজনকে খেতে বলেছি। খুব ভালো করে দুটো মুরগি রেঁধো ।”
গ্রেথেল বলল, “নিশ্চয়ই, কর্তামশাই ।” এই-না বলে মুরগি দুটোর -পালক ছাড়িয়ে সেগুলোয় তেল মাখিয়ে ঝলসাবার জন্য শিক দিয়ে সে গাঁথল। সন্ধেয় সে দুটোকে রাখল উনুনের উপর । আগুনে ঝলসে মুরগি দুটোর রঙ হয়ে উঠতে লাগল বাদামী । কিন্তু অতিথি এসে পৌছল না ।
গ্রেথেল বলল, “অতিথি না এলে আমি কিন্তু মুরগি দুটো উনুন থেকে নামিয়ে নেব । গরম-গরম সেগুলো না খেলে নস্ট হয়ে যাবে । আর খাবার নষ্ট করা পাপ ।”
তার কথা শুনে বাড়ির কর্তা বললেন, “আমি এক্ষুনি গিয়ে অতিথিকে ডেকে আনছি ।”বাড়ি থেকে কর্তা বেরুতেই উনুনের উপর থেকে শিকে-গাথা মুরগি দুটো নামিয়ে গ্রেথেল আপন মনে বলে উঠল, "উনুন-তাতে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে তেষ্টা তো পাবেই ! ওরা আসার আগে মাটির তলার ঘর থেকে এক চুমুক আঙুর-রস খেয়ে গলা ভিজিয়ে আসি গে। এইনা বলে দৌড়ে মাটির তলার ঘরে গিয়ে এক মগ আঙুর-রস সে খেল ৷ তার পর গিলল আরো এক মগ । আর তার পর রান্নাঘরে ফিরে এসে মুরগি দুটোয় ভালো করে মাখন মাখিয়ে উনুনে চড়িয়ে মনের আনন্দে শিকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেগুলো সে ঝলসাতে লাগল ।
ঝলসান মুরগি দুটোর গন্ধে চার দিক ভুরভুর করে উঠল । তাই আপন মনে গ্রেথেল না বলে পারল না, কেমন খেতে হল চেখে দেখা দরকার।’ এই-না বলে এক টুকরো মাংস ছিড়ে সে বলে উঠল, “ভারি সুন্দর ঝলসান হয়েছে। এক্ষুনি না খেলে খুব অন্যায় করা হবে ।”
এই-না বলে ছুটে গেল সে জানলার কাছে । কিন্তু বাড়ির কর্তা বা তাঁর অতিথির দেখা সে পেল না । তাই সে আবার মুরগি দুটোর কাছে ফিরে এসে আপন মনে বলে উঠল, “ঐ মুরগির একটা ডানার দিক পুড়তে শুরু করেছে । ওখানটা নষ্ট হতে না দিয়ে খেয়ে ফেলাই ভালো।’ এই-না বলে সেখানটা কেটে খেয়ে ফেলে মনে মনে বলে উঠল, ‘অন্য ডানার দিকটাও খেয়ে ফেলা যাক। তা হলে মুরগিটাকে আর বেখাপ্পা দেখাবে না আর কর্তামশাইও কিছু টের পাবেন না।’
মুরগিটার দু পাশের ডানার দিকটা খেয়ে আবার সে ছুটে গেল জানলার কাছে । কিন্তু তখনো বাড়ির কর্তা বা তার বন্ধুর দেখা নেই । তাই তার মনে হল আরো খানিকটা আঙুর-রস খেলে মন্দ হয় না । মাটির তলার ঘরে গিয়ে আর-এক মগ আঙুর-রস সে খেল আর তার পর স্থির করল ভালো খাবার নস্ট করা খুব অন্যায় হবে । তাই যে-মুরগিটার দু দিকের ডানার অংশটা সে খেয়েছিল সেই মুরগির বাকি অংশটাও সে খেয়ে শেষ করল ।
তখনো একটা মুরগি বাকি । কিন্তু বাড়ির কর্তার তখনো দেখা নেই । গ্রেথেল তাই ভাবল, “মনে হয় দুটো মুরগি খাওয়া আমার পক্ষে শক্ত হবে না। আর একটু আঙুর-রস খেলে অনায়াসে দ্বিতীয় মুরগিটাও, খেতে পারব। এই-না ভেবে আরো খানিকটা আঙুর-রস গিলে দ্বিতীয় মুরগিটাও সে সাবাড় করল।
সবে তার খাওয়া শেষ হয়েছে এমন সময় বাড়ির কর্তা ফিরে হাক দিলেন, “গ্রেথেল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার বন্ধু এসে পৌছবে ।”
এই না বলে খাবার টেবিল সাজানো হয়েছে কি না দেখার আর মাংস কাটার ছুরিটা শানাবার জন্য তিনি ভেতরে গেলেন । আর ঠিক সেই মুহুর্তে তার অতিথি এসে সদর দরজায় টোকা দিল ।
গ্রেথেল সদর দরজায় ছুটে গিয়ে অতিথিকে বলল, “চুপ ? তুপ ! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালান ৷ কর্তামশাই আপনাকে ডিনারে নেমতন্ন করেছিলেন আপনার কানদুটো কাটার জন্যে । ঐ শুনুন, তার ছুরি শানাবার শব্দ ।”
শব্দটা শুনে অতিথি পড়ি-মরি করে ছুট দিল । আর গ্রেথেল দৌড়ে গিয়ে বাড়ির কর্তাকে বলল, “বেশ অতিথিকে নেমস্তন্ন করেছিলেন যা হোক ৷”
বাড়ির কর্তা প্রশ্ন করলেন, “মানে ?”
“আমি মুরগি দুটো ডিশে সাজিয়ে আনছিলাম। চক্ষের নিমেষে ডিশ থেকে সে-দুটো তুলে নিয়ে তিনি চম্পট দিলেন ।”
নধর মুরগি দুটোর কথা ভেবে মনে মনে হায় হায় করে বাড়ির কর্তা বললেন, “আচ্ছা লোক তো ! আমার জন্যে অন্তত একটা রেখে যাওয়া উচিত ছিল ।” ছুরিটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে বেরিয়ে তিনি চেঁচাতে লাগলেন, “অন্তত একটা ! অন্তত একটা ।” অতিথি ভাবল, তিনি চাইছেন তার অন্তত একটা কান কাটতে । তাই নিরাপদে বাড়িতে পৌছবার জন্য সে উর্ধ্ব শ্বাসে ছুটতে লাগল।
0 coment�rios: