পঞ্চমরাত্রে বাদশাহ শারিয়ার-এর আগ্রহে বেগম শাহরাজাদ আবার গল্প বলা শুরু করলেন—জাঁহাপনা, সেই সুলতান উনান তার উজিরকে নানা ভাষায় গালমন্দ করতে লাগলেন। “বাদশাহ সিনবাদ যেমন তাঁর প্রাণপ্রিয় বাজপাখিটাকে হত্যা করে অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছিলেন। আপনিও কি চান আমিও তেমনি জ্বলে পুড়ে মরি?”
সুলতান বললেন—বলছি তবে শুনুন,-কোন এক সময়ে কার নগরে এক বাদশাহ রাজত্ব করতেন । তার নাম ছিল বাদশাহ সিনবাদ। ঘোড়ায় চড়া, মাছ ধরা, শিকার আর খেলাধুলা প্রভৃতিতে তিনি খুবই উৎসাহী ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর একটা পোষা বাজপাখি ছিল। প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন তাকে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা সেটাকে কাছে কাছে রাখতেন। এমন কি শিকারে যাওয়ার সময়ও পাখিটা তার সঙ্গে থাকত। পানি খাওয়ার জন্য একটা সোনার বাটি, সোনার শিকল দিয়ে তার গলায় বেঁধে রাখা হত।
বাজপাখিটার যে দেখভাল করে সে একদিন দরবারে বাদশাহকে এসে বলল—‘হুজুর, আজকের রাত্রিটা শিকারের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ! মন চাইলে চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।কাছের বন্ধুদের নিয়ে বাদশাহ সিনবাদ শিকারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
এক পাহাড়ের গায়ে প্রশস্ত এবং প্রায় সমতল এক জায়গা দেখে তাবু ফেলা হ’ল।শিকারের জন্য জাল পাতা হল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একটা বুনো-ছাগল ছাড়া জালে কিছুই আটকালো না।
বাদশাহ সিনবাদ সবাইকে সতর্ক করে দিলেন—’বুনো-ছাগলটাকে যেন পালাতে দেওয়া না হয়। যার কাছ থেকে ওটা পালাবে তার গর্দান নিয়ে ছাড়ব ।
খুবই সতর্কতার সঙ্গে জাল গুটিয়ে বুনো-ছাগলটাকে বাদশাহের কাছাকাছি নিয়ে আসা হ’ল। সেটা পিছনের পা দুটোতে ভর দিয়ে প্রায় সোজ হয়ে বিচিত্র এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সামনের পা দুটো জোড়া করে বাদশাহের দিকে তুলে ধরল। ব্যাপারটা এমন, সে যেন তাকে সালাম জানাচ্ছে। এতে বাদশাহসহ সবাই করতালি দিয়ে উঠল। তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করল বুনোছাগলটা । আচমক এক লাফ দিয়ে বাদশাহকে ডিঙিয়ে একেবারে জঙ্গলের দিকে দৌড় দিল। মুহুর্তে বাদশাহ নিজেকে সামলে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বুনো-ছাগলটার পিছু নিলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর গভীর জঙ্গলে বুনো-ছাগলটার দেখা মিলল বটে কিন্তু কিছুতেই তাকে নাগালের মধ্যে পেলেন না। বাদশার কাজটি করে দিল তাঁর প্রাণ প্রিয় বাজপাখিটি। সে বাতাসের বেগে উড়ে গিয়ে সুতীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে বুনো ছাগলটার চোখের মণি দুটো গেলে দিল। বিকট আর্তনাদ করে সেটা হুমড়ি খেয়ে ঝোপের মধ্যে পড়ে গেল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ছাগলটি মরে পড়ে রইল মাটিতে।
বাদশাহ সিনবাদ বহুকষ্ট করে বুনো-ছাগলটাল গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে ঘোড়ার জিনের তলায় আটকে দিলেন। এবার তাবুর দিকে যাত্রা করলেন। কিছুদূর এসে বাদশা ও তাঁর ঘোড়ার খুব পানির পিপাসা লাগল। আশেপাশে কোথাও পানির দেখা নেই। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সিনবাদ একটু বড় গাছের নিচে ছোট জলাশয়ের মতো কিছু একটা দেখতে পেলেন। কাছে যেতেই তিনি অবাক মানলেন। ছোট জলাশয়টা পানিতে ভরে আছে তবে সমস্ত পানি কেমন জানি থকথকে আর আঠালো হয়ে আছে। অনেকটা আটা গোলা প্রসাদের মতো।
বাদশাহ সিনবাদ তার প্রাণ প্রিয় বাজপাখির গলা থেকে সোনার বাটিটা খুলে ওই থকথকে পানি নিয়ে এলেন। বাজপাখিটার সামনে ধরলেন পানিভর্তি বাটিটাকে । সে পানি তো পান করলই না, তার উপর ঠোঁট দিয়ে সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে বাটিটাকে দূরে ফেলে দিল। সিনবাদ তার আচরণে খুব বিরক্ত হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার গিয়ে একবাটি পানি নিয়ে এলেন। এবার ঘোড়াটার মুখে বাটিটা ধরতেই বাজপাখিটা উড়ে গিয়ে বাটিটাকে ফেলে দিল ।রাগে গসগস করতে করতে বাদশাহ কোমড় থেকে তরবারি টেনে নিয়ে দিলেন সজোরে এক কোপ বসিয়ে। ব্যস, চোখের পলকে বাজপাখির একটা ডানা কেটে গেল। ঝরঝর করে ডানা দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল।। বাদশাহ আপন মনে বলে উঠলেন—এর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিজে তো খেলই না, অন্য কাউকেও পানি খেতে দেবে না! বাঃ চমৎকার মতলব !
বাজপাখিটার কিন্তু নিজের যন্ত্রণাকাতর দেহের দিকে কিছুমাত্রও নজর নেই। ঘাড় তুলে সে মাথার ওপরের গাছটাকে দেখতে লাগল। বাদশাহ সিনবাদ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে গাছটার দিকে চোখ ফেরাতেই চমকে উঠলেন। দেখলেন, গাছের ডালে অসংখ্য ময়াল সাপ ঝুলছে। তাদের মুখ থেকে অনবরত লাল জাতীয় তরল পদার্থ বেরিয়ে জলাশয়ে পড়ছে। এ্ক দৃশ্য দেখে বাদশাহ সিনবাদ তার অপরাধের জন্য অনুশোচনা করতে লাগলেন। নিরবে বলতে লাগলেন, হায়! আমি একি করলাম।
মন ভার করে বাদশাহ সিনবাদ প্রাসাদে ফিরে এলেন। ছালছাড়ানো বুনো ছাগলটাকে রান্না করার জন্য রাধুনীকে নিদের্শ দিলেন। আহত বাজপাখিটা এতক্ষণ জীবিত ছিল। এবার মাথা কাৎ করে পড়ে গেল। মরে গেল বাজপাখিটি।
বাদশা সিনবাদ কেঁদে কেঁদে বললেন: হে বন্ধু, আমি তোমাকে নিজের হাতে হত্যা করেছি। আমার এই অপরাধ আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না।’
গল্প শেষ করে বাদশাহ উনান এবার থামলেন। বৃদ্ধ উজির এবার সবিস্ময়ে বললেন—হজুর, আপনার এ গল্পটার সঙ্গে আমার কথার সম্পর্ক কি, বুঝতে পারলাম না তো!
আপনি হয়তো বলতে চাইছেন, বাদশাহ সিনবাদ তাঁর প্রাণপ্রিয়, তাঁর সবচেয়ে আপন বাজপাখিকে নিজে হাতে খুন করার জন্য অনুশোচনায় জ্বলে পুরে মরেছেন, ঠিক কিনা? কিন্তু হেকিম রায়ান কি আপনার সত্যিকারের প্রাণের বন্ধু? অবশ্যই না। লোকটা ধান্দাবাজ, জাঁহাপনা, আপনি এখন বুড়ো হেকিমের মোহে অন্ধ। তার দোষ-গুণ সম্বন্ধে বিচার করার মত বিবেচনাবোধ আপনার লোপ পেয়েছে। আপনি কি সেই উজির আর বাদশাহের ছেলের গল্পটা জানেন ?
বাদশাহের ছেলেকে হত্যা করতে গিয়ে উজির নিজেই জীবন দিয়েছিলেন। আপনি নিজের কবর নিজেই খুড়তে চলেছেন।
বাদশাহ রায়ান গল্পটি শোনানোর জন্য উজিরকে অনুরোধ করলেন। উজির তার গল্প শুরু করলেন...
0 coment�rios: