সুখে থাকতে ভূতে কিল মারে বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। মানে সংসারে বেশ কিছু মানুষ আছে তারা সুখে-শাস্তিতে থাকতে চায় না। যেভাবেই হোক কোনো একটা অশান্তিকর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বেই। কথাটা আমাদের বন্ধুপটলার বেলাতে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। নিজে তো অশান্তিতে জড়াবেই, আর সেই সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডব ক্লাবের আমাদের বাকি চারজনকেও জড়াবে।
বেশ ছবির মতো সুন্দরই সবকিছু ছিল। আমরা অর্থাৎ আমি, পটলা, হোঁৎকা, ফটিক মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। গোবরা এত করেও টেস্টে অ্যালাউ হল না। হবে কী করে মামার বিরাট কুমড়োর ব্যবসা।
এবার নাকি বিদেশেও কুমড়ো এক্সপোর্ট করছে। গোবরাও সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে কুমড়ো কালেকশন করে জোগান দিতে ব্যস্ত ছিল। কুমড়োর জন্যই অ্যালাউ হয়নি। লাউ-কুমড়োর মধ্যে নাকি মিল নেই। তাই অ্যালাউ হয়নি গোবরা। আমরা তাকে সাস্তুনা দিই, তুই পাকা হয়ে অ্যালাউ হবি, সামনের বছর।পটলা এর মধ্যে প্রোগ্রামও করে ফেলেছে, এবার সে অরণ্যভ্রমণে যাবে। আর ইদানীং পটলা বন-জঙ্গল নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা শুরু করেছে। অরণ্যই হল আজকের গ্রিন হাউস ব্যাঙ্ক, উষ্ণায়ন থেকে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে পারে এই বনজঙ্গল, গাছই মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু একদল শয়তান নিজেদের হীন উদ্দেশ্যের জন্য এই অরণ্যকে ধ্বংস করছে-এই সব নিয়ে রীতিমতো ভাষণ দিতে শুরু করেছে পটলা। আমরা পটলার সেসব কথা মন দিয়ে না হোক কান দিয়ে অন্তত শোনার ভান করি। কারণ পটলাই আমাদের পঞ্চ পাণ্ডব ক্লাবের ক্যাশিয়ার। ক্যাশও নেই, ক্যাশবাক্সও নেই। তবু সেই-ই ক্যাশিয়ার। এতদিনের চা-টোস্ট, সিঙ্গাড়া, আইসক্রিম, এসব খরচা ওই-ই জোগায়। বিরাট বনেদি বাড়ির একমাত্র বংশধর। ওর বাবা-কাকার দুটো কারখানা, ওর ঠাকুমার নামে এই এলাকায় বিরাট বাজার। বাড়িতে নিত্যপূজা হয়। ওর ঠাকুমা রোজ ডেকে পাঠিয়ে আমাদের গোপালের ভোগ খাওয়ান। লুচি, কিশমিশ দেওয়া ছোলার ডাল, ছানার কালিয়া, পায়েস। তাঁর দয়াতেই পটলার হাতে ক্যাশ আসে। তাই পটলাকেই আমরা ক্যাশিয়ার বানিয়েছি।
বেশ চলছিল আমাদের প্রসাদ সেবা, খেলাধুলো। ফটিক আমাদের ক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। পড়াশোনার পাশাপাশি কোন ওস্তাদজির কাছে গানও শিখছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে। আর ক্লাবে-বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে তা-না-নানা করে। ওর ওস্তাদ ওকে শিখিয়েছে-কাহা গ্যায়ে ঘনশ্যাম'। সেই তিনটে কথাই নানা সুরে, নানা তালে সে রেওয়াজ করে। আমরা বলি-তারপর কী রে? ঘনশ্যাম গেল কোথায়? ফটিক বলে-পরের লাইন রেওয়াজ করাবে ছমাস পর। আগে এটাই রপ্ত করি। তারপর আবার ইনিয়ে-বিনিয়ে শুঁড় তোলে-কাহা গ্যায়ে--
হোঁৎকা বলে-তর দেশ ভারতবর্ষে। ঘনশ্যামরে যেখানে মন চায় যেতে দে। তুই থাম! আর গাওনের দরকার নাই। ফটিক বলে-পরের লাইনটা পাব এবার।
এমনি দিনে সব শান্তি নষ্ট করে পটলা বলে, পিসেমশাইকে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনিও লিখেছেন, চলে আয়। বন-পাহাড় ঘুরে যাবি। দেখবি কেমন বন, চোখ-জুড়োনো সবুজ। আর সাতশো পাহাড়ের দেশ সারান্দা। সেই বন-পাহাড় দেখে যা। এখনও অব্দি একটা পাহাড়ই দেখিনি, তায় একসঙ্গে সাতশো পাহাড় দেখব ভেবে রীতিমতো ভয়ই পাই। সেবার দেওঘরের ত্রিকূট পাহাড়ে গিয়ে পালকি নিয়ে যা ফ্যাসাদে পড়েছিলাম, এবার সাতশো পাহাড় আর গহন বন! কী যে হবে জানি না!
হোঁৎকা যেন আগুনে ঘি ফোড়ন দেয়। বলে সে, ফরেস্ট তো যাইবি! তর পিসেমশায়ের ত শহরে খুব নামড়াক, তায় বনবাংলোতেই যাইমু। বনকে যদি দেখতেই হয় ফরেস্ট বাংলোতেই থাকার লাগব।
একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ পটলা বলে, কথাটা মন্দ বলিসনি। সারান্দার গহন অরণ্যেও অনেক ভালো ফরেস্ট বাংলো আছে। আজই বাংলোর পারমিশানের জন্য বনকর্তাদের চিঠি দিচ্ছি।
পটলার মাথার সুপ্ত পোকাটা নড়ে ওঠে। বলে, পটলা, দারুণ হবে। হোঁৎকা আর আমি ওই বনবাংলোয় চলে যাব। পিসেমশাই ওই সারান্দার গহন বনের মধ্যে ফরেস্ট বাংলোয় থাকতে দেবেন না। তিনি বলবেন-সকালে বনে যাও-দিনভোর বনে ঘুরে সন্ধার মুখে শহরে ফিরে এসো। খুব সাবধানী লোক তিনি। তাই ভাবছি আমরা বন ঘুরে তবে শহরে আসব।
আমি বলি-তোরা তো ফরেস্ট বাংলোয় থেকে বন দেখবি ঠিক করেছিস, শুনেছি সারান্দায় বাঘ-হাতির পাল, বাইসনের দল, ভালুক, হরিণ, সম্বর সবই আছে?
পটলা বলে-আছে তো দলে দলে আছে নানা প্রাণী। ওদের দেখতে গেলে রাতের অন্ধকারে জিপ নিয়ে স্পটলাইট নিয়ে বের হতে হয়। বনবাংলোয় না থাকলে রাতে বের হওয়া যায় না।
হোঁৎকা বলে বেশ বীরদর্পে-তোগোর মুরগির কলজে বাঘ-হাতির পাল দেখলে প্যান্ট বাসন্তী কালার কইরয়া ফেলবি তাই তগোর রাতে বনে লই যামু না। পটলা আর আমিই যামু। তারপর কি দাখলাম, কি করলাম সব কমু পরে পিসেমশাই-এর বাড়ি আইস্যা--
এর মধ্যেও হোঁৎকা যে এমন ডেয়ার ডেভিল হয়ে উঠবে তা ভাবিনি। পটলা বলে, ঘাবড়াস না। পরে তোদেরও বনে নিয়ে যাব। আমরা ব্যাপারটা দেখে-বুঝে আসি। গোবরা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে এবার বলে, কোনো প্রবলেম হবে না তো হোঁৎকা এখন পটলার সাপোর্টার সে বলে, না-না, কুন প্রবলেম হইব না
হোৎকার কথাটা ভালো লাগেনি। তাও বলি, গোবরা, আমরা তো ভিতুর ডিম ওদের দুজনকে যেতে দে- ওরাই সামলাক। আমাদের ভেবে লাভ কি?
পটলা বলে-না-না, তোরাও তো যাচ্ছিস বনে ঠিক সাতদিন পর সমী, ইংরাজিটা তো তুই ভালো জানিস। বনবিভাগের কর্তাদের লিখে দে, ওই ফরেস্ট বাংলো বুক করার জন্য। একটা ঘর চাই সাতদিনের জন্য। তারিখটাও লিখে দে।
অর্থাৎ পটলার ওসব হিসাবও হয়ে গেছে। গোবরা বিজনেস বোঝে। সে বলে, ক্লাবের ক্যাশ তো খালি। বেড়ানোর খরচ-?
পটলা বলে, ওর জন্য ভাবিস না। ঠাকুমাকে বলে রেখেছি। ক্যাশ ম্যানেজ হয়ে যাবে। একটা লিস্ট করতে হবে ওখানে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই ইস্টিশানে নেমে লোকাল বাজার থেকে সবকিছু নিয়ে নেব। ফর্দ করে নিবি।
টিকিট কাটা হয়ে গেছে। এর মধ্যে পটলা অরণ্যজগৎ বনাপ্রাণীজগৎ নিয়ে বেশ কিছু বইও জোগাড় করেছে বলে-বনে যাবি, বন্যপ্রাণীদের সম্বন্ধেকিছু পড়াশোনা করে নে। সারান্দার শালবন সারা এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ।
গোবরা বলে-কেন? তরাই-এর শালও খুব ভালো।
পটলা বলে-সারান্দাতেই রয়েছে সবচেয়ে প্রাচীন শালগাছ। এর এক-একটার পরিধি বারো ফিটেরও বেশি। আর মানেও সেরা। তাছাড়া সেগুন, নিমশাল, গামহার, আরও অনেক ভালো গাছ আছে। আর বন্যজন্তুর তো অভাব নেই। পাল পাল হরিণ, হাতি, সম্বর, ভালুক তো আছেই। এমনকী চিতা, বাইসনও আছে।
গোবরা বলে-এত দামি গাছ, এত প্রাণী ওখানে-তাহলে চোরাশিকারিও আছে ওখানে। বনের মধ্যে শুনেছি তাদেরও দাপট কম নয়!
পটলা বলে-তা হতেও পারে। আমাদের তাতে কী। আমাদের বন আর বন্যপ্রাণী দেখা নিয়ে কথা।
হোঁৎকা বলে-আর কয়দিন বনে গিয়ে ফ্রেশ অক্সিজেন লইয়া আসুম। মনি-ঋষিরা একশো বছর কেন বাঁচে জানস? ওই অক্সিজেন আর পিওর ফ্রুটস-
হোঁৎকাও আমাদের বন সম্বন্ধেজ্ঞান দিতে শুরু করেছে।
এর মধ্যে বনবিভাগ থেকে দুজনের জন্য ফরেস্ট বাংলোর ঘর বুকিং-এর চিঠি ও এসে গেছে। পটলা আর হোঁৎকা কালই চলে যাবে। আমরা যাব সাতদিন পর। বড়বিল স্টেশনে নামব। পটলার পিসেমশাই-এর ওখানে কাঠের গোলা, করাতকল। আর ওখানের পাহাড়ে রয়েছে অফুরান খনিজ লোহা, অর্থাৎ আয়রন ওর। সেই আয়রন ওর তুলে চলে যায় নামী কারখানায়। তাঁর বন-পাহাড়ের এদিকে-ওদিকে নাকি দু-তিনটে বাংলো। তারই একটাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পটলারা যাবে বনপাহাড়ের শেষ স্টেশন অবধি। বন থেকে কাঠ বোঝাই ট্রাক বাইরে আসে, সেইসব ফেরত ট্রাক ধরে ওরা বনের মধ্যে গিয়ে ফরেস্ট বাংলোয় থাকবে সাতদিন। তারপর আবার বন থেকে বেরিয়ে ট্রাক ধরে পিসেমশাই-এর বাংলোতে পৌঁছাবে। আর আমরাও সেদিন সকাল ন’টার গিয়ে নামব। একসঙ্গেই যাব পিসেমশাই-এর বাড়ি। পিসেমশাইও জানবে আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে আসছি।
আমরা পটলা আর হোঁৎকাকে টেনে তুলে দিই। উপর-নীচ দুটো বার্থ। দুজনে বেশ গুছিয়ে বসেছে। এবার নজর পড়ে সহযাত্রীদের দিকে। ওদিকে বার্থে বসে আছে মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক৷ কপালে রক্তচন্দনের তিলক। বেশ ভক্তি ভক্তি ভাব। নিরীহ গোছের চেহারা। পাশে আরও কয়েকজন। ভদ্রলোক এর মধ্যে প্রকৃতির মহাশক্তির সম্বন্ধেঅনেক গুঢ়তত্ত্ব নাকি প্রকাশ করা শুরু করেছে। হিন্দি দেহাতি টানের সঙ্গে বাংলা মেশানো। কথা শুনে মনে হয় ভদ্রলোক অবাঙালিই। তবে বাঙালিদের সঙ্গে ওঠা-বসা আছে। বাংলা ভাষাটাও ভাঙা ভাঙা বলার চেষ্টা করে। ভক্তিমাগই একদম সচমাৰ্গ-সতাপথ। ভক্তিভরে ঈশ্বরকা ভজনা করো জরুর দর্শন মিলেগা।"
পটলা বলে-মহারাজ, আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?
অবশ্য ভদ্রলোকের পরনে সাদা ধুতি, শার্ট। সঙ্গে একজন বছর বাইশের ছেলে। মহারাজের বেশও নয়। তবু পটলা তাকে মহারাত্জ বলে।
ভদ্রলোক বলে, কৌশিশ করছি বেটা সব তাঁরই লীলা জয় সীয়ারাম
ট্রেন তখন ছুটে চলেছে। খড়গপুর ছাড়িয়ে শালবনের সীমা শুরু হয়েছে। রাতের অন্ধকারে বন কালো রখার মতো দেখায়। ওদিকে বসে আছে আর এক ভদ্রলোক। জীর্ণ লম্বাটে চেহারা। টিকালো নাক, চোখ দুটোও বড় বড়। সব দেখছে সে। আর কান খাড়া করে মহারাজের মূল্যবান ভাষণ শুনছে। সঙ্গে তার স্ত্রী আর ছোট ছেলে। ওরা যে ঈশ্বরের কথায় তত বিশ্বাসী নয় তা বোঝা গেল।
এবার মহারাজ তার পোটলা থেকে একটা বড় সাইজের টিফিন বাক্স বের করে। তাতে দেখা যায় কড়াইশুটির কচুরি, আলুভাজা, নতুন গুড়ের পায়েস আর বেশ বড় সাইজের কালাকাঁদ। হোঁৎকা একটু বেশি পেটুক। সে এবার এইসব খাবার দেখে মহারাজের শ্রীচরণে মণপ্রাণ ঢেলে দেয়। বলে, আপনি সাক্ষাৎ দেবতা, মহারাজ
ভদ্রলোক ঈষৎ হেসে বলে-নেহি নেহি, আরে আমি তো সেবক আছি। এ তিওয়ারি, ইন লোগোকো প্রসাদ দো
তিওয়ারিও এক টুকরো খবরের কাগজে দুটো কচুরি, আলুভাজা, এক হাতা পায়েস আর দুটো কালাকাঁদ দেয়। মহারাজ বলে, বাবাজিকা প্রসাদ, লেও বেটা
বেশ তৃপ্তিভরে এবং ভক্তিভরে হোঁৎকা সেই খাবার খায়।
ট্রেন তখন বক্সার পার করে ঘড়িবাড়ির দিকে চলেছে। অন্ধকারের বুক চিরে ট্রেন ছুটেছে। আশপাশের যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পটলা স্বপ্ন দেখছে সারান্দার গভীর বনে সে আর হোঁৎকা চলেছে। ছায়াঘন অরণ্য-পাহাড় বেষ্টিত পথ। সাবধানে পা ফেলে চলেছে তারা বনের পথে। হঠাৎ গা-ছমছম করা স্তব্ধ তা ভেদ করে ওঠে হাতির চিৎকার। একপাল হাতি এদিকেই আসছে ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে। ওরা দুজনে সামনের দিকে জঙ্গল ভেঙে ছোটার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। ছিটকে পড়ে। পায়ে কাঁটা ফুটেছে। এদিকে সামনে হাতির পাল। পটলা চিৎকার করে উঠে বসে। তারপরই সদ্য ঘুমভাঙা চোখে দেখছে আশপাশ।
ট্রেনের বার্থে শুয়েছিল সে। রাতের অন্ধকারও আর নেই। ট্রেনটা প্রায় খালি হয়ে গেছে। সেই শীর্ণকায় লম্বা লোকটা ওর পা ধরে নাড়া দিচ্ছে। পটলা চোখ চাইতে বলে, লাস্ট স্টেশন এসে গেল! বলছিলে এখানে নামবো গাড়ি তো এখানেই থেমে যাবে। আবার একঘণ্টা পর ফিরে যাবে।
পটলার খেয়াল হয়। এত ঘুম ঘুমিয়েছিল টেরই পায়নি। হোঁৎকা এখনও ঘুমোচ্ছে। পটলা হোঁৎকাকে ডাকে, আই হোঁৎকা, আর কত ঘুমোবি? ওঠ-এবার নামতে হবে। ওঠ।
ঠেলাঠেলি করেও হোঁৎকাকে জাগানো যায় না। তারপর জোরে ধাক্কা দিতে হোঁৎকা এবার ধড়মড় করে উঠে বসে। গাড়ি তখন শেষ স্টেশনে ইন করছে। ওরা মালপত্র নামাতে গিয়ে দেখে যেখানে তাদের ব্যাগপত্র রেখেছিল সেই জায়গাটা খালি। চারটে ছোট-বড় ব্যাগের একটাও নেই। যে ব্যাগটা মাথায় দিয়েছিল, মাত্র সেটাই আছে।
পটলা চমকে ওঠে-আমাদের ব্যাগ?
সেই লোকটা নামতে নামতে বলে-তোমাদের ব্যাগ? ওসব তো ওই মহারাজের বাগ? ওরা তো সব নিয়ে টাটানগরে নেমে চলে গেছে।
হোঁৎকা বলে-বুঝেছি! ক্যান এত ঘুমাইছি। মাদক মেশানো খাবার খাইয়াই ক্যামন ঘুম আইল এহনও যাইত্যাছে না-- পটলা বলে-এখন কী হবে?
ওরা প্লাটফর্মে নেমেছে। এবার ভালো করে দেখে স্টেশনটাকে। উঁচু প্লাটফর্মও নেই। ওদিকেই একটা পাহাড়। পাহাড়টা যেন এখানেই শেষ হয়ে গেছে। তাতে শাল, মহুয়া নানান গাছে ভরা। নির্জন স্টেশনে ট্রেনটা দম নিচ্ছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে এই জায়গা থেকে সে পালাবে।
চারদিক পাহাড় আর সবুজের কলরব। বনভূমি। ওদিকে স্টেশনের বাইরে দু-একটা ঝুপড়ির দোকান। ওদিকে কাঠের স্তুপ। দু-একটা ট্রাকও দেখা যায়। হোঁৎকা বলে, সবই তো গেছে গিয়া, চল, আমরাও ফিইরইয়া যাই। পকেটে যা আছে তাতে ফেরার ভাড়া হই যাবে।
কিন্তু ওই বনভূমি, রহস্যভরা পাহাড় যেন পটলাকে টানে। সে বলে, আমার কাছে কিছু টাকা আরও আছে। দুখানা জামা-প্যাস্টও। এসেছি যখন বনবাংলোতে চল। ফিরে গেলে ওরা সবাই হাসবে।
তা সত্যি প্রসাদ খেয়ে এমনভাবে সব হারাতে হবে তা ভাবিনি হোঁৎকা। হোঁৎকা বলে-মহারাজ নয়, ও ব্যাটা মহাচোর কান মইল্যা সব লইয়া গেছে গিয়া। পটলা বলে-তবু আমাদের থামাতে পারবে না দেখি বনবাংলো যাবার কোনো কিছু পাই কিনা! হোঁৎকা বলে-ওই ঝুপড়ির দোকানে চল। বনে কী পাবি কে জানে কিছু খাই লইতে হইব যাবার আগে।
স্টেশনের বাইরে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। দূরে একটা আলোর মতো দেখা যায়।
পাহাড় এখানে চারদিকে। মধ্যে একটু উপত্যকার মতো। নিচু জায়গাতে সামান্য চাষবাস হয়। ছোট্ট নদীটা ওই পাহাড়ের দিক থেকে এসে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ঘুরে আবার এদিকে পাহাড়শ্রেণির কোন গলিপথে হারিয়ে গেছে। এই নদীর ধারে গড়ে উঠেছে ঝুপড়িগুলো। ওদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে নানা সাইজের কাঠের গুঁড়ির টাল। বন থেকে নানা ধরনের কাঠ আসে। এখান থেকে ট্রেনে, ট্রাকে উঠে শহরে, কল-কারখানায় চলে যায়। বন থেকে কাঠ এনে এখানে ড্রাইভাররা মাল খালাস করে আবার বনের গভীরে ফিরে যায় কাঠ আনার জন্য। নদীর জলে ড্রাইভাররা গাড়িগুলিকে ধুয়ে নেয়। নিজেরা জিরিয়ে নিয়ে রুটি-তড়কা খেয়ে আবার বনে ফেরে। তাই দু-চারটে ঝুপড়ির দোকানও গড়ে উঠেছে। হোঁৎকা-পটলার খিদেও পেয়েছে। তার আগে ফরেস্ট বাংলোয় যাবার জন্য কোনো ট্রাকের সন্ধান করতে একজন বলে, ওদিকে যাও। বন-বাংলোতে যাবার ট্রাকগুলো ওখানের গেটেই থামে। ওখানে গেলে সর্দারজিকে পাবে।
পটলা-হোঁৎকা খুঁজে খুঁজে সেই গেটেই পৌছয়। কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে খাটে বসে ড্রাইভাররা রুটি-তড়কা খাচ্ছে। পটলা-হোঁৎকা ওদেরই জিজ্ঞাসা করে, থলকোবাদ ফরেস্ট বাংলোয় যাব আমরা। কোনো ট্রাক মিলবে?
সর্দারজি তখন তড়কার মধ্যে থাকা একটা কাঁচালঙ্কা চিবিয়েছে। আর বুনো কাঁচালঙ্কা তেমনি ঝাল। ঝালের চোটে তখন তার অবস্থা কাহিল। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই সে হুস হাস করছে। লালা ঝরছে ঝালের চোটে । ওর হেল্পার খালাসিরা বেগতিক দেখে পটলাদের বলে, ওস্তাদকো তন মত করো? চলো হামিসে বাত করবে।
ওকে থলকোবাদে নিয়ে যাবার কথা বলতে খালাসিটা জানায়, দো আদমি তিস রুপেয়া লাগবে।
পটলা বলে-অনেক বেশি বলছ তুমি।
দুসরা কোই ট্রাকসে যাইয়ো খালাসি নির্বিকার চিত্তে জবাব দেয়। কারণ সে জানে ওখানে যবার আর অন্য কোনো গাড়ি নেই। ওদেরও যেতে হবে। শেষে দরদস্তুর করে দুজনের পাচিশ টাকায় রফা হয়। এবার ড্রাইভারও লঙ্কার ঝাল সামলে নিয়ে বলে, কাহা রুপেয়া? অর্থাৎ ভাড়াটা আগামই দিতে হবে। টাকা দিয়ে দেয় পটলা।
খালাসি বলে-আধাঘণ্টার মধ্যে তৈয়ার হো যাইয়ে, গাড়ি ছেড়ে দেবে।
বেলা তখন বারোটা প্রায়। বনে কী জুটবে জানা নেই। তাই ওই তড়কা-রুটি খেয়ে নিয়ে ট্রাকে ওঠে। আর ট্রাকও চলতে শুরু করে। ফাঁকা প্রান্তর ছাড়িয়ে ট্রাকটা এবার বন-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাস্তা বলতে মোরাম ফেলা বনবিভাগের অস্থায়ী রাস্তার মতো কিছুটা। শীতের মরশুমে বনে পারমিট দিয়ে গাছ কাটানো হয়। সেইসব লগ বের করার জন্য অস্থায়ী পথও চাই। বর্ষার জলে তা মুছে যায়। সেই এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে ট্রাকটি চলেছে। আর পটলা-হোঁৎকা যেন ট্রাকের পিছনে ফুটন্ত কড়াই-এর জলে আলু পটল সিদ্ধ করার মতো লাফালাফি করছে। এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছে। আর সেই কষ্টকে ভোলার জন্য পটলা গান শুরু করেছে, আমাদের যাত্রা শুরু হল এবার ওগো কর্ণধার।
হোঁৎকা একটা রড ধরে কোনোমতে স্থির হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করছে। দুদিকে গভীর বন। পুরুষ্টু শাল-গামহার-শিয়াশাল, আরও নানা গাছের ঘন সমাবেশ। বন ক্রমশ গভীরতর হয়েছে। রোদ এখানে একচিলতে কোনোমতে আসে। ঘন সন্নিবেশিত গাছগুলো। সবাই এখানে ভিড় ঠেলে মাথা আকাশের দিকে তুলে সূর্যের আলোর প্রত্যাশী। প্রতিযোগিতা চলছে সবার মধ্যে। হটাৎ গাছের ঘন ডালে কিসের শব্দ শুনে হোঁৎকা গাছের উপরের দিকে চাইল। দেখে একটা বিরাট ময়ূর এদের ট্রাকের আওয়াজ শুনে ভারী দেহ নিয়ে উড়ে গেল আড়ালে। হোঁৎকা বলে ওঠে-দেখছিস এখানকার ময়ুর।
ট্রাকের সামনের রাস্তায় দুটো হরিণ নিমেষের মধ্যে লাফ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে বনের গভীরে হারিয়ে যায়। পিছনে শোনা যায় একটা চাপা গর্জন। কোনো লোভী হায়না শিকার হারাবার রাগে গরগর করছে। আতঙ্ক জাগে ওদের মনে। এই বন যেন কেমন রহস্যে।
ট্রাকটা পাহাড়ের নীচে একদিকে এসেছে। সামনেই একটা পাহাড়ি নদী। জল বেশী না। তার চেয়ে বেশি রয়েছে পাক-কাদা। দুটো পাহাড়শ্রেণির মাঝে একটা জলনিকাশি ঝোরা। গাড়িটা কাদায় নেমেই আটকে গেছে। গিয়ার দিয়ে গাড়ি তোলার চেষ্টা করছে। গাড়ি নড়ে না। ড্রাইভার চেষ্টা করে। গাড়ি যেন জগদ্দল পাথরের মত বসে গেছে। পটলা তখনও প্রকৃতির প্রেমে মশগুল হয়ে গাইছে-"আমি চঞ্চল হে, সুদূরের পিয়াসী।
হঠাৎ খালাসির তীব্র কষ্ঠে গর্জন শুনে থামল সে। খালাসি চিৎকার করে,- আবে কিশোরকা বাচ্চা গানা ছোড়কে হাত লাগাও।
ওদের হাক-ডাকে পটলা নামে ট্রাক থেকে। আর ড্রাইভারও গাড়ি তোলার চেষ্টা করছে। এরাও ঠেলে প্রাণপণে। সকলের ঠেলায় গাড়ি একটু এগোচ্ছে তারপর আবার পিছনে গড়িয়ে আসছে। আর কাদা-জল ছিটকে আসছে। এ জলের রং লালচে। আর সেই জল-কাদা সারা গায়ে-মুখে লাগে পটলা আর হোঁৎকার। ওদের আর চেনা যায় না। ঠেলেঠলে গাড়ি স্টার্ট হল। ঝোরার জলে কাদা-মাটি ধুয়ে ভিজে শার্ট-প্যাস্ট পরেই ট্রাকে উঠল।
পটলা বলে-আর কাদা মেখে গাড়ি ঠেলব না।
হোঁৎকা বলে-টাকা দিচ্ছি, গাড়ি ঠেলুম ক্যান
খালাসি বলে-তব উতর যাও। পায়দল যাও!
এই গভীর গহন বনে সেটা সম্ভব নয়। তাই কাদা মুছে আবার ট্রাকে ওঠে পরবর্তী কোনো ঝোরার বুক থেকে গাড়ি তোলার জন্য
বেলাও বাড়ছে। টুকি চলেছে গুড় গুড় করে বনের পথে। এই পথের যেন শেষ নেই। হোঁৎকা শুধোয়, থলকোবাদ আর কদুর?
হঠাৎ শান্ত বনের মধ্যে ওঠে ঝড়ের শব্দ। মড়মড় করে ডালপালা ভাঙছে। ওদিক থেকে একটা তীক্ষ ডাক আসে। সামনের পথটায় দেখা যায় বনের একটা অংশ। চাতাল মতো। গাছপালা এখানে কম। দুদিকেই বনভূমি। মাঝের জায়গাটায় দেখা যায় বনের ওদিক থেকে একপাল হাতি আসছে। হোঁৎকা অস্ফুট আর্তনাদ করে, পালা, হাতি।
খালাসি ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে। আর ড্রাইভারও ইঞ্জিন বন্ধকরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাতির পাল প্রায় চল্লিশ গজ দূরে। একটা বিরাট দাতাল হাতি ট্রাকটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গর্জন করে তীব্ৰকণ্ঠে আর থামের মতো পা ঠুকতে থাকে। যেন শাসাচ্ছে এদের। তবে কেউ এসে আক্রমন করে না। ওদিকে হাতির পাল একে একে পার হয়ে এদিকের বনে যেতে সেই দাতাল হাতিও এবার পিছু পিছু বনে যায়।
পটলা-হোঁৎকা এতক্ষণ দম বন্ধকরে ছিল। হাতিগুলো চলে যেতে খালাসি বলে, ওদের কোনো লুকসান না করলে ওরাও
কোনো লুকসান করে না।
হোঁৎকা বলে-ই কোথায় আইছিস রে, পটলা? বন দেইখা কাম নাই। চল, ফিরে চল।
ফেরার পথও আর নেই। এখন বনবাংলোতেই যেতে হবে। তারপরে ওখানে গিয়ে ফেরার কথা ভাবা যাবে।
থলকোবাদ বনবাংলো বনের গভীরে গড়ে উঠেছে ব্রিটিশদের আমল থেকেই বনের মধ্যে এত বড় বনবিভাগের নানা ধরনের কাজ চালাবার জন্য, নতুন বনাঞ্চল তৈরির জন্য, পথঘাট তৈরির জন্য এবং বনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেশ বড় একটা ফরেস্ট কলোনিও আছে। রেঞ্জার, অন্য স্টাফদের কোয়ার্টার, অফিস, পশু চিকিৎসালয় সবই আছে। আর এখানেই গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের বড়সড় জনপদ। প্রাইমারি স্কুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই আছে। আর সপ্তাহে দু'দিন এই বনের গহনেও হাট বসে। এই সবকিছু থেকে একটু দূরে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে সুন্দর বাংলো। বেশ কয়েকটা ঘর রয়েছে। লাগোয়া বাথ-রুম। পাহাড়টা ঘিরে বয়ে গেছে একটা ছোট পাহাড়ি ঝোরা। হাঁটুভোর জল থাকে। তার উপর একটা কাঠের ব্রিজমতো আছে। সেই ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ের গায়ে চড়াই ভেঙে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। গাড়ি উঠে যায় উপরে। বাংলোর সামনে এদিকে-ওদিক সুন্দর সজানো বাগান। আর পাহাড়ের গায়ে কার্নিশ বের করে কাঠের তক্তা দিয়ে বসার ব্যবস্থাও আছে। দীর্ঘ শাল গাছ-গুলোর মাথা এসে পায়ে ঠেকে। আর কানে আসে প্রবাহমান ঝোরার কলকল শব্দ।
মাঝে মাঝেই তাই অরণ্যপ্রেমীদের অনেকেই পারমিট নিয়ে চলে আসে এখানে। বনের গভীরে রয়েছে লিগিবদা ওয়াচ টাওয়ার। গহন বনের মধ্যে ঝোরার জল বইছে। ঝোরার ধারে গাছের ডালে চটের থলেতে নুন টাঙানো। বনবিভাগ থেকে ওগুলো টাঙিয়ে রাখা হয়। বন্যপ্রাণীরা এসে নুন খায়। জল খায়। কাদায়-ঘাসে লুটোপুটি খায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে তাদের দেখা যায়। প্রথমে আসে রাতের অন্ধকারে তৃণভোজী প্রাণীরা। হাতি, বাইসন, হরিণ, সম্বর ইত্যাদি। আর বনের রাজা বাঘ যখন আসে তখন এরা সরে যায়। নীলাভ চোখের দৃষ্টি নিয়ে বনের ভিতর থেকে বের হয়। বাতাসে ওঠে উৎকট গন্ধ শিকারের সন্ধানে ঘোরে।
বন্য জীবনের বহু বৈচিত্র্যও দেখা যায় এখানে।
ভূধর বিশ্বাস কলকাতায় থাকে। তার কাঠের ব্যবসা রয়েছে নিমতলার ওদিকে। ভূধরের কাঠের ব্যবসা ওর বাবা তাঁর বন্ধু অজয় সেনের সঙ্গে শুরু করেছিলেন। আজ আজয়বাবুর বয়স হয়েছে। স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ওঁদের কোনো ছেলেপুলে নেই। বালিগঞ্জ এলাকায় বিশাল বাগানঘেরা বাড়ি। আরও কীসব ব্যবসা আছে। অজয়বাবু, তাঁর স্ত্রী মানসী দেবী ওঁদের বন্ধুর ছেলে ভূধরকে ছেলেবেলা থেকেই দেখছেন। তাকে স্নেহ করেন। তবে অজয় সেন ঠিক করেছেন কাঠের ব্যবসাটা ভূধরকে দিয়ে যাবেন, আর বালিগঞ্জের বাড়ি ও অন্যসব ব্যবসা কোনো ধর্মীয় সংস্থাকে দান করে দেবেন। তাঁর ইচ্ছা মিশনকে এসব দান করলে এই অর্থ সংকাজেই লাগবে।
ভূধর এসব শোনে মাত্র। সে এখন কাঠের ব্যবসা চালাচ্ছে। বাইরে থেকে বন ইজারা নিয়ে শাল, সেগুন, আরও নানা কাঠ আমদানি করে। তবে ভূধরের নজর অজয়বাবুর সাম্রাজ্যের দিকে। যেভাবে হোক এসব সেই-ই দখল করবে। তবে ভূধর খুবই সাবধানী আর চতুর। তাই এসব মনের কথা ভুলেও অজয়বাবুর কাছে প্রকাশ করে না। বরং বলে, তাই ভালো কাকাবাবু, মিশনের হাতে এসব তুলে দিলে সৎকাজে লাগবে।
অজয়বাবুর বয়স হয়েছে। স্ত্রী মানসী দেবীও সংসার ছেড়ে দূরে গিয়ে ঠাকুরের নাম করতে চান। তাই ভূধর বলে, কাকাবাবু, আমি তো বনে যাই কাঠের ব্যবসার জন্য। চলুন, বনে সুন্দর ফরেস্ট বাংলো আছে। সেখানে থেকে নিরিবিলিতে ঈশ্বরকে ডাকবেন। মুনি-ঋষিরা তো বনে থেকেই ঈশ্বর সাধনা করেন।
কথাটা অজয়বাবুর মনে ধরে। মানসীও বলেন, তাই চলো, কিছুদিন বনবাসেই থেকে আসা যাক।
ভূধর মনস্থির করেছে বনে গিয়ে কোনোমতে এদের দিয়ে বিষয়-সম্পত্তি লিখিয়ে নেবার একটা মরিয়া চেষ্টাই করবে।
ভূধর বনে-পাহাড়ে আসে। শহরের মানুষ। বন সম্বন্ধে বন্যপ্রাণী সম্বন্ধেবিশেষ করে বাঘ-হাতি সম্বন্ধে তার ভয় আছে। তবে টাকার জন্য সে সবই করতে পারে। বনজগতেও সাধারণ সহজ-সরল আদিবাসীদের মধ্যে থেকে সে বেশকিছু অন্য প্রকৃতির মানুষকে খুঁজে বের করেছে। তাদের টাকা দিয়ে সে তার কাজগুলো করায়। গাছ কাটার জন্য বনবিভাগকে টাকা দিয়ে পারমিট নিতে হয়।
বনবিভাগের কর্মীরা কোন গাছ কাটা হবে তার নির্দেশ দিয়ে সেইসব গাছে হলুদ রং-এর ছাপ দিয়ে দেয়। কী পরিমাণ গাছ কাটা হবে তারও নির্দেশ থাকে। ভূধরদের খেলা শুরু হয় এরপর। বনবিভাগের কর্মীকের ম্যানেজ করে আরও বেশি পরিমাণ গাছ কাটাই করে। একই পারমিট তিনবার-চারবার দেখিয়ে তিন-চার গুণ কাঠ কাটাই করেন। বনকে ধ্বংস করে। আর কিছু আদিবাসী চোরাশিকারিদের টাকা দিয়ে রেখেছে। যারা বন্যপ্রানী মেরে হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, হরিণের শিং এসব সংগ্রহ করে। ভূধর তার কাঠের চালানের সঙ্গে এসব কলকাতায় পাচার করে, যা থেকে তার লাখ লাখ টাকা আমদানি। তবে বাইরে থেকে ভূধরকে দেখলে কিচ্ছটি বোঝা যাবে না।
0 coment�rios: