সম্রাট আকবরের দরবারে দু’জন সভাগায়ক ছিল। তাদের একজনের আদরের নাম লাল, অন্যজনের নাম নীল। গায়ক দুজনের প্রতি সম্রাট খুবই খুশি ছিলেন, এবং তাদের দুজনের গান শোনার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে প্রায়ই লোকজন আসত। আরও গায়ক ছিল, কিন্তু ওদের দু'জনের প্রতি সম্রাটের পক্ষপাতিত্ব ছিল একটু বেশি। এইভাবে দিন যায়। নিজেদের খ্যাতি, প্রতিপত্তি এবং সম্রাটের পক্ষপাতিত্ব দেখে লাল ও নীল দু’জনেই গর্ব বোধ করত। ক্রমশ আর সকলের চেয়ে তারা দুজনে নিজেদের অনেকটা যেন আলাদা মনে করতে লাগল। তারা মনে করল সম্রাট আকবরের রাজত্বে তাদের কোনও ভুল-ত্রুটি কিংবা অন্যায় অপরাধ ঘটলেও সাধারণ লোকের মতো তাদের বিচার হবে না।
তাই তারা কোনও সভাসদ বা গায়ককে গ্রাহ্য করত না। একদিন তারা সম্রাটের কাছে বসে এ-কথা ও-কথা বলতে বলতে রসিকতা করা হচ্ছে মনে করে সম্রাটকে হঠাৎ এমন একটা অপমানজনক কথা বোকার মতো বলে বসল যে, দেখতে দেখতে সম্রাটের মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেল। সম্রাট বললেন, “তোমাদের এই প্রকার অসংযমের কী কারণ ঘটল। তোমাদের এই আচরণের মানেই বা কী ?’
সম্রাটের গাম্ভীর্য দেখেও তারা ভাবল, তারা তো সম্রাটের খুব প্রিয়পাত্র, তাদের কি আর কোনও শাস্তি হবে ? এই ভেবে তারা ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, সেই কথাটাই আবার দাঁত বের করে কচলাতে লাগল—যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাবে।
ক্ষমা তারা পেতে পারত কিন্তু সেদিকে তারা কোনও ভুক্ষেপই করল না। তাদের এই স্পর্ধা দেখে সম্রাট এবার ভীষণ রাগতস্বরে বললেন, ‘এখনই এই মুহুর্তে তোমরা আমার রাজ্য ছেড়ে যেখানে খুশি দূর হয়ে যাও। তোমাদের মুখ দেখাও আমার পাপ। আমার রাজত্বে যেন আর কোনওদিন তোমাদের দেখতে না পাই, দেখতে পেলেই তোমাদের ফাঁসিকাঠে চড়ানো হবে।’
সম্রাটের অগ্নিশৰ্মা মূর্তি দেখে এবার লাল ও নীল দুজনে বুঝল, কী নির্বোধ তারা। সম্রাটকে শান্ত করবার আর কোনও পথ না পেয়ে অবশেষে তারা সভা ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হল। না গেলে উপায় যখন নেই—কিন্তু এখন কোথায় থাকবে? এমন নিশ্চিন্ত অন্নবস্ত্র আর বিশাল-বৈভব ছেড়ে তারা যাবে কোথায়? সুতরাং দিল্লির বাইরে না গিয়ে তারা এক জঙ্গলে গিয়ে ভয়ে ভয়ে আশ্রয় নিল। দিনের বেলায় থাকত জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে, আর রাত্রে বেরিয়ে শহরে এসে খাদ্যদ্রব্য কিনে নিয়ে যেত মাঝে মাঝে। বড় কষ্টে কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু ছ'মাস ধরে তারা এইভাবেই কাটাতে বাধ্য হল এমনি করে। নিজেদের বোকামির জন্যই তাদের এই অবস্থা। অনেক দুঃখকষ্টের পর একদিন রাত্রে আর কোনও উপায় না পেয়ে তারা এসে বীরবলের পায়ে কেঁদে পড়ল। ‘হুজুর আপনি আমাদের মা-বাপ, আপনি আমাদের রক্ষা করুন।’ তাদের কান্না আর দুরবস্থা দেখে বীরবলের মনে করুণার উদয় হল। বীরবল অনেক ভেবেচিন্তে একটা মতলব বাতলে দিলেন তাদের কানে কানে।
পরদিন দিনের বেলায় লাল আর নীল শহরের পথে পথে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাদের চিনত বহু লোক, এবং তাদের গানের ভক্তও ছিল অনেক। সুতরাং হঠাৎ দেখতে পেয়ে লোকজনের ভিড় জমে গেল তাদের আশেপাশে। সম্রাটের শোভাযাত্রা আসছিল সেই পথ দিয়ে। তিনি কাছাকাছি এসেই গায়ক দু’জনকে দেখতে পেলেন। বলা বাহুল্য, লোকলশকর তাড়া করে গেল লাল আর নীলের পেছনে তাদের ধরবার জন্য। সম্রাটের আদেশ অমান্য! এবার মৃত্যুদণ্ড । ভগবানেরও হাত নেই সম্রাটের আদেশ অমান্য করার। সকলে ওদের গান শুনে ভালবাসত। দুর্জনরা বলল, ওদের শূলে দিলেই উপযুক্ত শান্তি আর যারা ওদেরকে ভালবাসত তারা মনে মনে হায় হায় করতে লাগল। অবশেষে ওদের দু'জনের
কী হয়, কী হয়! লাল আর নীল কাছে একটি বড় গাছ দেখতে পেয়ে ছুটতে ছুটতে গাছে উঠে বসল। সম্রাট প্রশ্ন করলেন, ‘কেন দূর হওনি আমার রাজ্য থেকে এখনও ? তোমাদের কি মরণের ভয় নেই? নেমে এসো, ফাঁসিকাঠে অথবা শূলে চড়তে হবে।’ দুজন বলল, জাঁহাপনা, আপনার হুকুম না মানা কারও কি ক্ষমতা আছে? আপনার হুকুম তামিল করব বলে ছ'মাস ধরে দেশ-দেশান্তরে কত ঘুরে বেড়ালুম। কিন্তু যেখানেই যাই আপনার রাজ্যের সীমানা আর শেষ হয় না—এমন বিরাট বিশাল এবং সীমাহীন আপনার সাম্রাজ্য।
জাঁহাপনা, তাই আবার এখানে ফিরে এসেছি। এবার যদি যেতে পারি শূন্যলোকে, তাই গাছে চড়েছি, সম্রাট। নইলে পৃথিবীময় আপনার রাজরাজত্ব। আমরা যাই কোথা? যেখানেই যাব সেখানেই আপনার সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের যেন শেষ নেই সম্রাট।’ সম্রাট খুশি হয়ে তাদের ক্ষমা করলেন, এবং আবার তাদের নিয়ে গিয়ে সভাগায়কের আসনে বসিয়ে দিলেন এবং মনে মনে খানিকটা হেসে চিন্তা করলেন, এই বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই বীরবলের। বীরবলের বুদ্ধি ছাড়া এমন কথা ওরা বলতেই পারে না! তবে এই ভেবে মনে শাস্তি পেলেন যে, বীরবলের জন্য আজ এই দু'জন লোক ফাঁসি থেকে রেহাই পেল।
0 coment�rios: