টপ টপ করিয়া জল পড়িতেছে, আমি ছাতা মাথায় গ্রাম্য পথ দিয়া হাঁটিতেছি। বৃষ্টিটা একটু চাপিয়া আসিল । তখন পথের ধারে একখানা আটচালা দেখিয়া তাহার পরচালার নিচে আশ্রয় লইলাম। দেখিলাম, ভিতরে কতগুলি ছেলে বসিয়া পড়িতেছে। একজন পণ্ডিতমহাশয় বাংলা পড়াইতেছেন। কান পাতিয়া একটু পড়ানোটা শুনিলাম। দেখিলাম পণ্ডিতমহাশয়ের ব্যাকরণের উপর বড়ো অনুরাগ । একটি উদাহরণ দিতেছি। পণ্ডিতমহাশয় একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বলো দেখি, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত প্রত্যয় করিলে কী হয়?
ছাত্রটি কিছু মোটা-বুদ্ধি, নাম শুনিলাম ভোদা। ভোদা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, আজ্ঞে, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে ভুক্ত হয়।
পণ্ডিতমহাশয় ছাত্রের মূর্খতা দেখিয়া চটিয়া উঠলেন এবং তাহাকে মূর্খ। গর্দভ। প্রভৃতি নানাবিধ সংস্কৃত বাক্যে অসংস্কৃত করিলেন। ছাত্রও কিছু গরম হইয়া উঠিল, বলিল কেন পণ্ডিত মশায়! ভুক্ত শব্দ কি নাই?পণ্ডিত। থাকিবে না কেন? ভুক্ত কীসে হয়, তা কি জানিস না?
ছাত্র। তা জানব না কেন?
ছাত্র। তা জানিব না কেন? ভালো করিয়া চিবাইয়া গিলিয়া ফেলিলেই ভুক্ত হয়।
পণ্ডিত । বেল্লিক! বানর! তাই কি জিজ্ঞাসা করছি?
তখন ভোদার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়া তিনি তাহার পার্শ্ববর্তী ছাত্র রামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভালো রাম, তুমিই বলো দেখি; ভুক্ত শব্দ কী প্রকারে হয়?
রাম বলিল, আজ্ঞে, ভুক্ত ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে ভুক্ত হয়।
পণ্ডিতমহাশয় ভোঁদাকে বললেন, শুনলি রে ভেদি? তোর কিছু হবে না!
ভোঁদা রাগিয়া বলিল, না হয় না হোক—আপনার যেমন পক্ষপাত!
পণ্ডিত। পক্ষপাত আবার কী রে, হনুমান!
ভোঁদাও । ওর কপালে ভূজো আর আমার কপালে ভূ?
ছাত্র যে সুচর্বণীয় ভুজো এবং অদৃষ্টের তারতম্য স্মরণ করিয়া অভিমান করিয়াছে, পণ্ডিতমহাশয় তাহা বুঝিলেন না। রাগ করিয়া ভোঁদাকে কে ঘা প্রহার করিলেন এবং আদেশ করিলেন, এখন বল, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে কী হয়?
ভোঁদা । (চোখে জল) আজ্ঞে, জানি না।
পণ্ডিত। জানিস নে? ভূত কীসে হয়, জানিসনে?
ভোঁদা। আজ্ঞে, তা জানি। মলেই ভূত হয়।
পণ্ডিত। শুয়ার! গাধা! ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করে ভূত হয়।
ভোঁদা এতক্ষণে বুঝিল । মনে মনে স্থির করিল, মরিলেও যা হয়, ভূ ধাতুর উত্ত ক্ত করিলেও তাই হয়। তখন সে বিনীতভাবে পণ্ডিতমহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিল, আজ্ঞে, ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত করিলে কি শ্ৰাদ্ধা করিত হয়?
পণ্ডিতমহাশয় আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বিরাশি সিক্কা ওজনে ছাত্রের গালে এক চপেটাঘাত করিলেন। ছাত্র পুস্তকাদি ফেলিয়া দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ি চলিয়া গেল। তখন বৃষ্টি ধরিয়া আসিয়াছিল, রঙ্গ দেখিবার জন্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। ভোঁদার মাতার গৃহ বিদ্যালয় থেকে বড়ো বেশি দূর নয়। ভোঁদা গৃহ-প্রবেশ কালে কান্নার স্বর দ্বিগুণ বাড়াইল, এবং আছাড়িয়া পড়িল । দেখিয়া ভোঁদার মা কাছে আসিয়া সাত্ত্বনায় প্রবৃত্ত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কী হয়েছে, বাবা?
ছেলে। আমি পড়া বলতে পারি নাই বলে পণ্ডিতমশাই আময় মেরেছে।
মা ! অধঃপেতে বুড়ো! আক্কেল নেই! আমার এই একরত্তি ছেলে! পড়া বলতে পারেনি বলে ছেলেকে মারে! আজ ওকে আমি একবার দেখব!
এই বলিয়া গাছকোমর বাঁধিয়া ভোঁদার মাতা পণ্ডিতমহাশয়ের দর্শনাকাঙ্খায় চলিলেন। আমিও পিছু পিছু চলিলাম। সেই সুপুত্রবর্তীকে অধিক দূর যাইতে হইল না। তখন পাঠশালা বন্ধ হইয়াছিল। পণ্ডিতমহাশয় গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন, পথিমধ্যেই উভয়ের সাক্ষাৎ হইল। তখন ভোদার মা বলিল, হ্যাঁ গা পণ্ডিতমহাশয়, আমার একরত্তি ছেলে পড়া বলতে পারেনি বলে কি এমনি মারতে হয়?
পণ্ডিত । ওগো এমন কিছু শক্ত কথা জিজ্ঞেস করি নাই। কেবল জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ভূত কেমন করে হয়।
ভোদার মা। ভূত হয় গঙ্গা না পেলেই। তা, ওসব কথা ও ছেলে মানুষ কেমন করে জানবে গা? ওসব কথা আমাদের জিজ্ঞাসা করো।
পণ্ডিত । ওগো সে—ভূত নয় গো ।
ভোঁদার মা। তবে কি গোভূত?
পণ্ডিত। সেসব কিছু নয় গো, তুমি মেয়েমানুষ কী বুঝবে? বলি একটা ভূত শব্দ আছে।
ভোঁদার মা। ভূতের শব্দ আমি অমন কত শুনেছি। তাও ও ছেলেমানুষ, ওকে কি ওসব কথা বলে ভয় দেখাতে আছে?
আমি দেখলাম যে, এ পণ্ডিতে পণ্ডিতে সমস্যা শীঘ্ৰ মিটিবে না। আমি এ রঙ্গের অংশ পাইবার আকাঙ্ক্ষায় অগ্রসর হইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে বলিলাম, মহাশয়, ও স্ত্রীলোকে, ওর সঙ্গে বিচার ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে বরং এ বিষয়ে কিছু বিচার
করুন |
পণ্ডিতমহাশয় আমাকে ব্ৰাক্ষ্মণ দেখিয়া একটু সম্ভ্রমের সহিত বলিলেন, আপনি প্রশ্ন করুন।
আমি বলিলাম, ভূত ভূত করিতেছেন, বলুন দেখি ভূত কয়টি?
পণ্ডিত সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, ভালো ভালো। পণ্ডিত পণ্ডিতের মতোই কথা কয়, শুনলি ভোঁদার মা? তারপর আমার দিকে ফিরিয়া এমনই মুখখানা করিলেন, যেন বিদ্যার বোঝা নামাইতেছেন। বলিলেন, ভূত পাঁচটি ।
তখন ভোঁদার মা গর্জিয়া উঠিয়া বলিল, তবে রে বুড়ো? তুই এই বিদ্যায় আমার ছেলে মারিস? ভূত পাচটা! পাঁচ ভূত, না বারো ভূত?
পণ্ডিত। সে কী বাছা, ও ঠাকুরটিকে জিজ্ঞাসা করো, ভূত পঞ্চ । ক্ষিত্যপ্—
ভোঁদার মা। বারো ভূত নয় তো আমার একটা বিষয় খেলে কে? আমি কি এমনই দুঃখী ছিলাম?
ভোঁদার মা তখন কাঁদিতে আরম্ভ করিল। আমি তখন তাহার পক্ষাবলম্বন পূর্বক বলিলাম, উনি যা বলিলেন তা হতে পারে। অনেক সময়েই শুনা যায়, অনেকের বিষয় লইয়া ভূতগণ আপনাদিগের পিতৃকৃত্য সম্পন্ন করে। কখনো শোনেন নাই, অমুকের টাকাটায় ভূতের বাপের শ্ৰাদ্ধা হইতেছে?
কথাটা শুনিয়া পণ্ডিত মহাশয় ঠিক বুঝিতে পারিলেন না আমি ব্যঙ্গ করিতেছি, কী সত্য বলিতেছি। কেননা বুদ্ধিটা কিছু স্থূলন। তাকে একটু ভেকাপনা দেখিয়া আমি বলিলাম, মহাশয়, এ বিষয়ে প্রমাণ প্রয়োগ তো সকলেই অবগত আছেন। মনু বলিয়াছেন—
কৃপণানাং ধনঞ্চৈব পোষ্যকুষ্মাণ্ডপালিনাম
ভূতনাং পিতৃশ্ৰাদ্ধেযু ভবেন্নষ্টংন সংশয়।।”
পণ্ডিতমহাশয়ের সংস্কৃত জ্ঞান ওই ভূ ধাতুর উত্তর ক্ত পর্যন্ত। কিন্তু এদিকে বড়ো ভয়, পাছে সেই শিষ্যমণ্ডলীর সম্মুখে, বিশেষত ভোঁদার মা-র সম্মুখে আমার কাছে পরাস্ত হয়েন। অতএব যেমন শুনিলেন—ভূতানাং পিতৃশ্ৰাদ্ধেযু ভবেন্নষ্টংন সংশয়ঃ অমনই উত্তর করিলেন, মহাশয়, যথার্থই আজ্ঞা করিয়াছেন। বেদেই তো আছে—
অস্তি গোদাবরীতীরে বিশালঃ সাল্মলীতরুঃ।
শুনিয়া ভোঁদার মা বড়ো তৃপ্ত হইল, এবং পণ্ডিতমহাশয়ের ভূসয়ী প্রশংসা করিয়া বলিল, তা, বাবা! তোমার এত বিদ্যা, তবু আমার ছেলে মার কেন?
পণ্ডিত । আরে বেটি, তোর ছেলেকে এমনই বিদ্বান করিব বলিয়াই তো মারি । না মারিলে কি বিদ্যা হয়?
ভোঁদার মা। বাবা! মারিলে যদি বিদ্যা হয়, তবে আমাদের বাড়ির কর্তাটির কিছু হল না কেন? ঝাঁটায় বল, কোঁস্তায় বল, তো কিছুতেই কসুর করি না!
পণ্ডিত। বাছা! ওসব কি তোমাদের হাতে হয়? আমাদের হাতে ।
ভোঁদার মা। বাবা! আমাদের হাতে কিছুই জোরের কসুর নাই। দেখিবে? এই বলিয়া ভোঁদার মা একগাছা বাকারি কুড়াইয়া লইল । পণ্ডিতমহাশয় এইরূপ হঠাৎ অধিক বিদ্যালাভের সম্ভাবনা দেখিয়া সেখান হইতে উর্ধ্বশ্বাসেস প্রস্থানন করিলেন।
শুনিয়াছি, সেই অবধি পণ্ডিতমহাশয় আর ভোঁদাকে কিছু বলেন নাই। ভূ ধাতু লইয়া পাঠশালায় আর গোলযোগ হয় নাই। ভোঁদা বলে, মা এক বাকারিতে পণ্ডিত মহাশয়কে ভূতছাড়া করিয়াছে।
0 coment�rios: