রহিম এক ঝাঁকা সুপারি লইয়া হাটে যাইতেছিল। মাঠের মধ্যে যেখানে তিন পথ একত্র হইয়াছে সেখানে শেয়ালে পায়খানা করিয়া রাখিয়াছে। এইখানে আসিয়া সে হঠাৎ আছাড় খাইয়া পড়িল। তাহার ঝাঁকার সুপারিগুলি কতক এধারে ওধারে পড়িয়া গেল। আর কতক সেই শেয়ালের বিষ্টার উপর পড়িল। রহিম তখন এধার ওধার হইতে সুপারিগুলি তুলিয়া লইল । শেয়ালের বিষ্টার উপর যেগুলি পড়িয়াছিল সেগুলি আর তুলিল না ; তারপর তাড়াতাড়ি হাটে চলিয়া গেল।
ইহার পরে সেই পথ দিয়া যাইতেছিল এক পানের ব্যাপারী। সে পথের মধ্যে কতকগুলি সুপারি পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া ভাবিল, নিশ্চয় জায়গাটিতে কোনো পীর আওলিয়া আছেন।
কেহ হয়তো জানিতে পারিয়া এই সুপারিগুলি সেই পীরকে দিয়া গিয়াছে। তখন সে মাথার ঝাঁকা হইতে কতকগুলি পান সেই সুপারির পাশে রাখিয়া অতি ভক্তিভরে সালাম করিয়া চলিয়া গেল। ইহার পরে পেয়াজের ব্যাপারী, রসুনের ব্যাপারী, মরিচের ব্যাপারী যে-ই এই পথ দিয়া যায় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সেই সুপারি-পানের উপর রাখিয়া যায়।হাট হইতে ফিরিবার পথে রহিম দেখে কি, পানে, পেয়াজে, উঠিয়াছে! সে তাড়াতাড়ি পানি, মরিচ, পেয়াজ, তরি-তরকারি যাহা পারিল ঝাকায় ভরিয়া লইয়া বাড়ি চলিল।
বাড়িতে গেলে রহিমের বউ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করে, “গেলে তো কয়েক পন সুপারি লইয়া। তার দাম দিয়া এত জিনিস আনিলে কেমন করিয়া?"
রহিম বলিল, “ও সব কথা পরে হইবে শীগগীর তোমার শাড়ীখানা দাও। আমাদের কপাল ফিরিয়াছে।" সে তাড়াতাড়ি বউ-এর শাড়ী আর নৌকার পাল লইয়া সেই তিন পথের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেখিয়া আশ্চর্য হইল, ব্যাপারীরা যে যে আজিকার হাটে লাভ করিয়াছে, প্রত্যেকে দু'আনা এক আনা করিয়া এই পথের উপরে রাখিয়া গিয়াছে রহিম তাড়াতাড়ি পয়সাগুলি গাটে বাঁধিয়া সেই জায়গাটির চারি ধারে বউ এর শাড়ী দিয়া ঘিরিয়া ফেলিল। উপরের চাঁদোয়ার মতো করিয়া নৌকার পালটি টানাইয়া দিল।
পরদিন গ্রামের লোকে অবাক হইয়া দেখিল, মাঠের মধ্যে পীরের আস্তানা। মাথায় কিস্তি টুপী পরিয়া, গলায় ফটিকের তসবী দোলাইয়া রহিম শেখ সেই আস্তানার সামনে চক্ষু মুদিয়া বসিয়া আছে। যখন সেখানে বহু লোক জড়ো হয়, রহিম চক্ষু মেলিয়া বলে, “আহা! শেয়ালসা পীরের কি কুদরৎ। যে এখানে এক আনা মানত করিবে, একশ আনার বরকত পাইবে। আজ রাতে শেয়ালসা পীর আমাকে স্বপ্নে দেখাইয়াছে, এখানকার ধূলি লইয়া গায়ে মাখিলে সকল অসুখ দূর হইবে। যার ছেলেপেলে হয় না তার কোলে সোনার যাদু হাসিবে।"
গ্রামের লোকেরা কেহ বিশ্বাস করিল, কেহ করিল না। কিন্তু কেহই ইহার আসল ইতিহাস খুঁজিয়া দেখিল না। বিশ্বাস করিয়া যাহারা এখানে রোগ-আপদের জন্য মানত করিল, কাহারও ফল হইল, কাহারও হইল না। যাহাদের ফল হইল তাহারা আরও বাড়াইয়া শেয়ালসা পীরের তেলেসমাতির কথা লোকের কাছে বলিল। রোগ হইলে আপনা হইতে তো কত লোক সারিয়া উঠে । আপদে বিপদেও তো আপনা হইতেই কত লোক উদ্ধার পায়। তাহারা ভাবে শেয়ালসা পীরের দোয়ায়-ই তাহাদের রোগ সারিতেছে—তাহাদের আপদ-বিপদ চলিয়া যাইতেছে। দিনের পর দিন পীরের নাম যেমন দেশ-বিদেশে ততই বাড়িতে থাকে। একবার একজন বড়লোক এখানে মানত করিয়া মামলায় জিতিল । সে বহু টাকা খরচ করিয়া শেয়ালসা পীরের দরগা পাকা করিয়া দিয়া গেল। রহিম শেখ এই দরগার খাদেম। সে চক্ষু বুজিয়া মনে মনে ভাবে, "দেশের লোকগুলি কি বোকা শেয়ালের বিষ্টার উপরে এই দরগা। এখানে আসিয়া কত আলেম-মৌলবী, পীরফকীর মাথা কুটিয়া সেজদা করে।"
0 coment�rios: