ভর সন্ধেবেলার ইস্কুল। ছাত্র এক এক করে বেড়ে তিন মাসে দাঁড়িয়েছে দশে। এরা সাধারণ গৃহস্থবাড়ির ছেলে। যে বয়সে লেখাপড়া শেখার কথা তখন কোনো কারণে তা করা হয়নি, খেয়াল হয়েছে পরে। মাস কয়েক হল গ্রামের দু-চারজন মাতধ্বর মিলে সরকারি সাহায্য জুটিয়ে এই সব ছেলেদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। ঝাপড়দার তেঁতুলতলার পাঠ-ঘর’ এমনি এক রাত-ইস্কুল।
ছাত্র দশজন হলেও মাস্টার কিন্তু একজনই-বংকিম রায় বা বাঁকাবাবু। তিনিই বাংলা, ইংরেজি পড়ান, অংক কষান। পড়ানোর মধ্যে বাংলার ওপরই জোর বেশি, ইংরেজি কেবল অক্ষর চিনিয়ে দেওয়া। দশটি ছাত্র মাটিতে চাটাই পেতে ধারাপাত মুখস্ত করে কি বর্ণপরিচয় পড়ে আর বংকিম-স্যার তেঁতুলগাছের ডালে ব্ল্যাক-বোর্ড ঝুলিয়ে চেয়ারের ওপর বসে থাকেন এক পায়ের ওপর আর এক পা তুলে। তার হাতে বেত, নজর সব ছেলের ওপর।
দশটি ছেলের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু হল ভোম্বল। ছেলের যে পড়ায় মাথা নেই এমন নয় কিন্তু বেশি ঝোঁক তার খেলায়। একবার ফুটবল খেলায় ডাক পড়লে আর রক্ষে নেই-অমনি সব কাজ ফেলে ছুটবে মাঠে। তাই মাঝে মাঝেই স্কুলের কাজ করে নিয়ে আসতে ভুল হয়ে যায় তার। বংকিম-স্যার তাই একটু চোখে চোখে রাখেন ভোম্বলকে! স্যারের চেহারা ছিপছিপে, মাথায় বাবরি চুল, নাকের নিচে তরোয়ালের মতো সরু গোঁফ। হাতে একটি বেত রাখেন, তা দিয়ে মারেন না। কিন্তু সপাং সপাং আওয়াজে তটস্থ রাখেন সবাইকে। বংকিমবাবুর গান-বাজনার শখ আছে। আর আছে ভূতের ভয় । মাসখানেক ধরে একটা দেড়ে ভূত নাকি তাঁকে বেজায় ভোগাচ্ছে। এ ঘটনা বংকিমবাবু গোপনে তার বন্ধু রাজেন কবিরাজকে বলেছেন। কিন্তু সে খবর সে আর কেউ জানে না, এমন নয়।ভোম্বল যে দুষ্টুমিতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট তাতে সন্দেহ নেই। কার বাগানের ফলে পাক ধরেছে, কাদেরপুকুরে নতুন রাজহাঁসের জোড়া ছাড়া হয়েছে—এসব খবর পৌছে যায় তার কাছে সবার আগে তারপর দেখা যায় যে হিমসাগর গাছে পাকা আম আর একটি নেই আর মল্লিকদের হাঁসের জোড়া আলো করে আছে চৌধুরীদের পুকুর। তবে তার একটি গুণের কথা না বললে সব কথা বলা হয় না। সেটি হলো তার ছবি আঁকার হাত । রঙিন খড়ি দিয়ে মেঝের ওপর, কি কাগজ-কলম দিয়ে-—যারা ছবি বোঝে তারাই বলে, ‘বাঃ, ছেলেটির আঁকার হাত তো দারুণ। ভোম্বলের এক কাকা আমতা স্কুলের ড্রইং মাস্টার, তিনিই ভেম্বরকে এ কাজে খুব উৎসাহ দিয়ে যান। ভোম্বলের বাবা হারাধনের কিন্তু ডোম্বলকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। সে ছেলেকে বোঝায়, মাস্টার-স্যার যখন যা কাজ দেবে তা করে নিয়ে যেতে ভুলিস না যেন । যদি লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে পারিস তবে সুখে থাকবি। আমার মতো রেলস্টেশনে ঘণ্টা বাজানোর কাজ করতে হবে না।’
ভোম্বল মাথা নেড়ে বলে, “সে তুমি কিছুই ভেবে না বাবা। কিন্তু যেই বাপ কাজে বের হয়ে যায় অমনি ভোম্বলও পড়া ফেলে হাজির গড়পুকুরের মাঠে । আজ বড় ম্যাচ খেলা হবে। কলকাতার সেরা খেলোয়াড়রা সকালে প্রাকটিস করবে, ভোম্বল কি তা না দেখে থাকতে পারে! সন্ধেবেলা তাই বাড়ির কাজ না করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বংকিম-স্যারের কাছে বকুনি খায় সে। স্যার হয়তো তার কানটাই মলে দিতেন যদি না সে সময় তার বন্ধু রাজেন কবিরাজ এসে বাইরে থেকে হ্কঁ দিতেন, ‘বংকু আছে নাকি হে? বাঁকাবিহারী--
ডাক শুনে বংকিমবাবু ভোম্বলকে ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, ‘এই যে রাজু, ফিরছ? তোমার বেশ, ঝাঁপ বন্ধ করতে পারলেই ছুটি। আমার তো সবে শুরু।
তেঁতুলগাছের নীচে একটি তেঁতুলকাঠেরই বেঞ্চ, তার ওপরেই বসেন দুজনে । দু’বন্ধু এক ক্লাসের পোড়েছিলেন ঝাঁপড়দা হাইস্কুলে। আরও যারা ছিল এদিকে-ওদিকে ছিটকে গেছে। কেউ কেউ বিলেত-আমেরিকাও পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু এঁরা দুজন রয়ে গেছেন সাবেক ঝাঁপড়দায়। ভোম্বলও এখনও বংকিম-স্যারের পিছু পিছু এসে দাঁড়িয়েছে। রাজেনবাবুর মাথা জোড়া টাক, গালভরা হাসি, বুকের ওপর মোট পৈতে, গায়ে সাদা সুতির চাদর। ভোম্বলকে দেখে একগাল হেসে বলেন, ‘কে ও ? ভোম্বল না? আজ আমাদের টিম কেমন খেলল, বল । মোহনবাগানকে কেমন ঠেসে ধরেছিল-এ্যাঁ! এক এক নয়, ওটা আমাদেরই জেতা গেম। দ্বিতীয় গোলটা রেফারী যে অফসাইড বলে দিল না ওটা স্রেফ বড় টিমের মান বাঁচানোর জন্যে। সত্যি কিনা বল ?’
ভোম্বল মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ জেঠু, মাঠেও অনেকে তাই বলছিল যাই হোক, মোহনবাগানের সঙ্গে ড্র করাও কম কথা নয়। হঠাৎ তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে, জানেন জেঠু, আজ ভোরে আমি
গড়পুকুরের মাঠে সুব্রত ভটচাজ আর বাবু মানিকে প্রাকটিস করতে দেখেছি। উঃ আমার যেন গায় কাঁটা দিচ্ছিল!’
‘বলিস কি রে!” রাজেন কবিরাজের চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। ভেম্বলের মতো তিনিও ফুটবল-পাগল। এককালে ঝাঁপড়দা স্পোটিংয়ের হয়ে বিস্তর গোল করেছেন। খেলতেন হাফ-ব্যাকে কিন্তু বল পেলে তেড়েফুড়ে এগিয়ে আসতেন বিপক্ষের পেনাল্টি সীমানা পর্যন্ত । দুটো-একটা গোল ঠুসে দিয়ে তবে ফিরে যাওয়া নিজের জায়গায়।
ভোম্বলের আরও কিছুক্ষণ গল্প করার ইচ্ছে ছিল। রাজেন ভট্টচাজকে দেখলেই তার সারা শরীর চনমনিয়ে ওঠে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলতেন উনি। শৈলেন মান্না নাকি ওঁর শট দেখে বলেছিলেন, ‘বাবা, এ যে দেখি বোমারু বিমান!”
কিন্তু বংকিম-স্যারের তাড়া খেয়ে চলে আসতে হয় তাকে। প্রাকটিস দেখার ঝোঁকে বাড়ির কাজ করে আনেনি সে, তিনি তাই দাঁতখিচুনি দিয়ে বলেছেন, যা শিগগির অংকগুলো কর গিয়ে ?
বংকিমবাবু বেরিয়ে আসতে রাজেন শুধোন, “কি হল হে! আজি বাজারে দেখলুম না কেন তোমায়?”
'না, আজ বাজারে যাওয়া হয়নি, বেঞ্চে বন্ধুর পাশে বসতে বসতে বংকিম-স্যার বলেন, ‘আজ সকলে হঠাৎ আমার সেই বনগীর মাসি এসে হাজির। তা তার সঙ্গে গল্প করতে করতে এত বেলা হয়ে গেল যে তখন আর বাজারে যাওয়ার সময় নেই। মাসিও বারণ করল, বলল, তোকে এখন আর মাছের জন্য বাজারে ছুটতে হবে না। ঘরে মোচা আছে দেখছি, আমি নারকেল নিয়ে এসেছি ! ঘণ্ট রাঁধি, দেখবি খেতে কোন অসুবিধে হবে না?
রাজেনবাবু খাইয়ে লোক। বিয়েবাড়িতে ভিয়েনের দায়িত্ব নেন, মিষ্টির ভঁড়ারে চৌকিদারি করেন। হেসে জিজ্ঞেস করেন, তা হল মোচার ঘণ্ট?'
‘হ্যাঁ। তোফা হয়েছিল। সেই সঙ্গে পোস্তর বডাঁ। মনে হল যেন অমৃত খাচ্ছি। আমার ধিনিকেষ্ট যা রাধে না যে ফাঁসির আসামীকে দিলে সে দড়ি ধরে ঝুলে পড়তে চাইবে।”
হা হা করে হেসে ওঠেন রাজেন ভটচাজ। বংকিম-স্যারও হাসেন মিটমিটি। অংক কষতে কষতে ওদের ওই হাসিমুখ দেখতে দেখতে ভোম্বলের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি ভর করে। পা টিপে টিপে ব্ল্যাকবোর্ডটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সে হাতে তুলে নেয় স্যারের চকখড়ি। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দু বন্ধু খোসগল্পে মশগুল ?
সবে বোর্ডে একটা আঁচড় টেনেছে এমন সময় চক্কোতিপাড়ার বিম্ব বলে ওঠে, এই কি করছিস?’ চাপা গলায় ধমক দেয় তাকে ভোম্বল, ‘তুই চুপ কর। হাতের লেখা কর মন দিয়ে।' দু বন্ধুর আলোচনা তখন একটু অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, সঙ্গে ঝড়। এখন বৃষ্টি থেমে গেলেও মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বইছে।
রাজেন জিজ্ঞেস করেন, আজ কটায় উঠবে তুমি ? আজ অমাবস্যা জানো তো? আকাশের অবস্থাও সুবিধের নয়। এমন দিনেই তো ওঁদের- বলেই ঢোঁক গেলেন তিনি।
বংকিম-স্যার তাড়াতাড়ি রাজেন ভটচাজের কাছে সরে আসেন। বড় বড় চোখ করে প্রশ্ন করেন, ‘বলছ কি রাজু? নতুন কিছু দেখলে নাকি?
এই এক জায়গায় দুই বন্ধুর ভারি মিল। দুজনেরই বেজায় ভূতের ভয় । রাজেন ডাকসাইটে হাফব্যাক ছিলেন কিন্তু অন্ধকার রাস্তায় যদি পেছন থেকে ওঁর পিঠে কেউ হাত রাখে তবে উনি পেছনে না তাকিয়ে সোজা সামনে দৌড় মারেন।
ড়াহনে-বায়ে দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে রাজেন বলেন, এই তো একটু আগে, রায়েদের বাঁশঝাড়ে পাশ দিয়ে আসছি—’
‘কি ? কি দেখলে ?” বংকুবাবুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় যেন, সেই তালগাছের সমান উচু? যেটি তোমাকে প্রায়ই ধাওয়া করে?
রাজেন মাথা নাড়েন, “না হে সে না। এর অন্য একজন। আগে কখনও মোলাকাত হয়নি। মনে হয় বেপাড়ার ; কেমন করে এ গাঁয়ে চলে এসেছে। ঘোমটা মাথায়, আসশেওড়া গাছটার নিচে দাড়িয়ে আছে যেন ভদ্রঘরের বৌটি । যেই আমি সামনে এসেছি আমনি খোলা গলায় বলে ওঠে, কি তাস খেলতে যাওয়া হয়েছিল? শোনামাত্তর আমি তো পাঁই পাঁই করে ছুট দিয়েছি। পেছনে শুনতে পাচ্ছি খিল খিল হাসি .এই দ্যোখো, এখনও গায়ে ঘাম দিচ্ছে।"
বংকিমবাবু দেখবেন কি, তার হাত-পা পেটের ভেতর সেধিয়ে গেছে। কঁদো কাঁদো গলায় বলে একি উৎপাত বল দিকি? আমাদের গ্রামের কটি ভূত নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি আমরা তার ওপর অন্য গাঁয়ের ভূত। এখন তো বেঁচে থাকাই দায় হয়ে গিয়েছে দেখছি।
‘সেই কথাই তো বলছি, এক রামে রক্ষা নেই, সুগ্ৰীব দোসর, রাজেন ডিবে খুলে এক টিপ নস্যি নেন, তো তোমার সেই দেড়েবুড়ে? তার দেখা পচ্ছে ইদানীং?
‘রোজ রোজ, একদিনও বাদ নেই, বংকিম-স্যার ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন একটা, এই যে ছাত্র পড়িয়ে ফিরব, দেখব তিনি ঠিক বসে আছেন পাঁচিলের ওপর—’
‘ওটি কে জানো তো? রাজেন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়েন, ‘তুমি যেমন বর্ণনা দিচ্ছ তাতে আমার ঘোরতর সন্দেহ ইনি স্বয়ং ব্রহ্মদৈত্য। ওঁকে দেখে বুড়ো বলে অশ্রদ্ধা করা ঠিক নয়। দুটি হাত জোড়া করে ভক্তিভরে কপালে ঠেকান রাজেন ।
বলছ কি তুমি? বংকিম-স্যারের মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। বলছি কি সাধে। লক্ষণ যে সব মিলে যাচ্ছে। লম্বা দাঁড়ি, পাঁচিলের ওপর বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকানো ; রাম রাম।” .
লাঠিগাছাটা টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ান রাজেন ভট্টচার্জ, চলি হে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ভূতেদের আবির্ভাবের পক্ষে বড় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। আর তোমাকেও বলি, বেশি রাত কোরো না। যা হওয়ার সন্ধে সন্ধে হয়ে যাওয়া ভাল। বেশি রাত হলে তাদের ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে । আপনি বাঁচলে বাপের নাম। দুর্গা দুৰ্গা!
মেজাজ রীতিমতো খারাপ হয়ে যায় বংকুবাবুর। কিন্তু তারপর ক্লাসে ফিরে এসে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি বোমার মতো ফেটে পড়েন। গোটা ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে তার ব্যঙ্গচিত্র। যেমন গোঁফ, তেমনি চুল, আর খাঁড়া নাক। হাতে বেতটিও গুঁজে দিতে ভুল হয়নি।
‘কে? কে? এ কার কাজ? কে এঁকেছে এ ছবি এমন চেঁচিয়ে ওঠেন বংকুবাবু যে তেঁতুলগাছের মগডাল থেকে দুটো বাদুড় ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায় কোনদিকে কে জানে!
ক্লাসের নটি ছেলে মুখ নিচু করে ফিকফিক করে হাসে। একজনই কেবল উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি স্যার '
‘দাঁড়া, আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন।' ভোম্বলের আঁকার হাত যেমন ভাল, তেমনি দৌড়াতেও সে মিলখা সিং । বংকিম-স্যার বেত নিয়ে এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে একলাফে রাস্তায় নেমে দে ছুট।
ছুটতে ছুটতে একেবারে পুবপাড়া নিজের বাড়ি যাওয়ার কোনো মানে হয় না। বাপ তাহলে সন্দেহ করবে, নিশ্চয় তুই পড়া ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছিস। চল স্যারের কাছে। তার চেয়ে স্যারের বাড়ির দিকে যাওয়াই ভাল! স্যারের চাকর কেষ্টধনের সঙ্গে ভোম্বলের খাতির আছে। তাকে গিয়ে ধরলে নিশ্চয় সে একটা উপায় বাতলে দেবে। আর এতটা দৌড়ঝাঁপ করার পর স্যারের রাগ নিশ্চয় একটু পড়ে যাবে। তখন হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিলেই চলবে। সেই সঙ্গে স্যারের দেড়েবুড়োকেও দেখা যাবে। অবশ্য যদি আজ সে হাজির থাকে ভাঙা পাঁচিলের ওপর। ভোম্বল ভূতে বিশ্বাস করে না, ভূতের ভয়ও তার নেই।
এই তো পুবপাড়া এসে গিয়েছে। মস্ত বাগানের মাঝখানে ছোট চালাঘর একটা—স্যারের বাড়ি। বাগানে গাছ যত না, ঝোপ তার চেয়ে বেশি। স্যার একা থাকেন বলে মজুর ডাকিয়ে সাফ-সুরুত করার খোয়াল থাকে না তাঁর।
অনেকটা ছুটে এসে হাঁপিয়ে গিয়েছে ভোম্বল! কেষ্টদা এখন কোথায় কে জানে। বাগানের গেট পেরিয়ে এদিকে-ওদিকে তাকায় ভোম্বল। হঠাৎ ভাঙা পাচিলটার ওপর চোখ পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে যেন কঁটা দিয়ে ওঠে। ওই তো, পেয়ারা গাছের ডালটা যেখানে পাঁচিলের গম্বুজটা ছুয়েছে সেখানে অন্ধকারে মিশে ও কে বসে? ভোম্বল সঙ্গে সঙ্গে গাবগাছটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ভাল করে দেখার জন্যে। ওই তো বুকসমান সাদা দাঁড়ি,পরনে কালো আলখাল্লা। এই তবে স্যারের দেড়েবুড়াঁ? রাজেন জেঠুর ব্রহ্মদৈত্য ? হঠাৎ দেখলে সত্যিই বুকের ভেতর ছাৎ করে ওঠে। অবশ্য ভূতের ঘাড়ে মশা কামড়ালে চাপড় মারে কিনা ভোম্বলের জানা নেই। ভাল করে দেখবে বলে একটু এগুতে গেছে এমন সময় পেছন থেকে ক্যাক করে কে তার ঘাড়টি চেপে ধরে। ভোম্বল দেখে বংকিম-স্যার। মুখে নিষ্ঠুর হাসি, এইবার তোমায় আমি ব্যঙ্গচিত্র বানাচ্ছি, দাঁড়াও। ডোম্বল পাঁচিলের দিকে আঙুল তুলে বলে, স্যার দেখুন।
স্যার পাঁচিলের দিকে তাকান। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজে কার্টুন হয়ে যান। এমন গো-গো আওয়াজ করে হাত-পা ছরকুটে পড়েন যে ডোম্বল তো ভোম্বল, পাঁচিলের হুতুম থুমোটা পর্যন্ত ঘাবড়ে যায়। ‘কেষ্টদা কেষ্টাদা ভোম্বলের পরিত্রাহি ডাক শুনে কেষ্টধন পড়ি কি মরি করে ছুটে আসে লণ্ঠন হতে । দুজনে মিলে তোল্লাতুল্লি করে স্যারকে ঘাসজমির ওপর শুইয়ে দেয়। স্যারের শখের বাবরি, ফিনফিনে পাঞ্জাবি সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। মুখে-চোখে জলের ছিটে দিতে তিনি চোখ মেলে তাকান, আমি কোথায়?’ তারপরেই ডোঁক গেলেন, ‘বুঝেছি। দেরে থুড়ি ব্রহ্মদেত্য আমার ঘাড় মটকাতে
চেয়েছিল...’ হয়তো ফের অজ্ঞান হতেন। কিন্তু হঠাৎই ভোম্বলের হাতের দিকে নজর পড়ে, এ কি দাড়ি? হা করে তাকান তিনি ভোম্বলের মুখের দিকে।
হেসে ভোম্বল বলে, ‘হ্যাঁ স্যার। আর ওই যে দেখুন। স্যার দেখেন গাবগাছের কাছে একটি মাঝবয়সী, রোগাপীনা, গালে-আঁচিল লোক কঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে, কেষ্টধন লণ্ঠন তুলে যেন তার মুখে ‘ফোকাস করছে এমনি ভঙ্গিতে দাঁত বার করে হাসছে পাশে দাঁড়িয়ে।
এসব কি? বংকিম-স্যার কৈফিয়ত তলব করার ভঙ্গিতে বলেন, 'এ দাড়ি কেথেকে এল? আর এ লোকটাই বা কে? আমার যে নাড়ি ছেড়ে যাবার উপক্রম!
‘ও তো জটাোঁ স্যার, ভোম্বল জবাব দেয়, ‘চিনতে পারছেন না? কালীপুরের জটাই বহুরূপী । রাসের মেলায় যার সাজ দেখার জন্যে লোক ভেঙে পড়ে। রায়বাবুদের বাড়ি ভাসানের সময়ও ওকে দেখে থাকবেন আপনি ।’
ও তাই বুঝি’, ঠাহর করে দেখে বংকিম-স্যার বলেন। তারপর মাটি থেকে বেতটা তুলে নিয়ে বলেন, তা আমার সঙ্গে এসব করার মানে কি? আজ তিন মাস আমি অনিদ্রারোগে ভুগছি। বাঁশগাছে প্যাঁচা ডাকলে আমার হেঁচকি ওঠে। আমাকে এমন বিপদগ্রস্ত করার অর্থ কি আমি— স্যার রাগলে যে সাধুভাষা বলেন তা ভোম্বল জানে।
সে বলে, স্যার, আপনাকে ভয় দেখাতে জটাইদা মোটেই চায়নি। আসলে ঘটনা যদি শোনেন তবে খুব অবাক হবেন। আমাকে জটাইাঁ সব বলেছে। হয়েছে কি, জটাইদারও ভারি লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো পুঁচকেদের পাশে বসে অ, আ, ক, খ পড়তে ভারি লজ্জা—তাই না জাটাইদা?
জটাই ঘট ঘট করে মাথা নেড়ে বোঝাতে চায় যে ভোম্বল ঠিক কথাই বলেছে।
অ তাই বুঝি’ বংকিম স্যারের মনটা একটু ভিজেছে কিন্তু নিজের ছাত্রের সামনে এমন নাকাল হওয়াটা তিনি ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। বেতের আগা দিয়ে আলখাল্লাটা শূন্যে তুলে বলেন, তা এসবের কি দরকার ছিল—এ্যাঁ?”
ছিল তো নাই, ভোম্বলের জবাবও তৈরি, কিন্তু জটাইদাকে কে বোঝায় বলুন! পাছে নিজের চেহারা দেখলে লোকে চিনে ফেলে, দুয়ো দেয় বুড়ে বয়সে পড়তে আসছে, তাই একটা সাজ গায়ে চাপিয়ে হাজির হতো উন্টে রাস্তা ধরে.যদি একটুও বুঝত যে ওকে এইভাবে দেখলে কেউ ভূত ভাববে তাহলে কি ভুলেও এমন কাজ...কি জটাইদা, সত্যি কিনা?
জটাই জিভ কাটে, মাথা নাড়ে। অর্থাৎ রাম বল, ছিছি। কেষ্টধন সমানে দাঁত মেলে হেসে চলেছে। ও এই ব্যাপার, এবার ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান বংকিম-স্যার। আমি বলি কি না কি, তা অনেক ধকল গিয়েছে। কেষ্টধন, একটু চা খাওয়াবে বাবা?
এখুনি আনছি বাবু, বলে লণ্ঠন মাটিতে রেখে কেষ্টধন ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ভোম্বল ভাবে ঢ়ের হয়েছে। এবার মানে মানে কেটে পড়া যাক। কী ভাগ্যি, এই গোলমালের মধ্যে স্যার তার ছবির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। ‘চলো জটাইদা’, সে জটাইকে ইশারা করে, তুমি তো আমাদের পাড়া হয়েই যাবে—’
জটাই শুকনো মুখে মাথা নাড়ে। সে বুঝতে পারে না বংকা-স্যার (জটাইয়ের গ্রাম এই নামটাই চালু) এখনও তার ওপর খাপ্পা রইলেন কিনা!
চললি কোথা?" ডাক শুনে ভোম্বল দেখে স্যার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে। ভাবে এই রে, স্যার দেখছি ছবির কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।
‘বলি জটাই লেখাপড়া শিখবে কি শূন্যে গোল্লা এঁকে? স্যার দাঁত কিড়মিড় করেন, সরকার থেকে যে আমায় গাদা গাদা বর্ণপরিচয় দিয়েছে, সে কি গুদামজাত করে রাখার জনো ? দাঁড়া, এক মিনিট, বলে স্যার চালাঘরের ভেতর ঢুকে যান, ফিরে আসেন বই, শ্লেট আরও কি সব জিনিস নিয়ে।
‘এই ধরো বই, শ্লেট-পেন্সিল আর বনগাঁর মাসি আমায় যে এক বাণ্ডিল আমসত্ত্ব দিয়েছিল তার খানিক, স্যার এক এক করে সব ভোম্বলের হাতে তুলে দেন, ‘নে জটাই, তুই এগো। ভেম্বলের সঙ্গে আমার কিছু বোঝাপড়া আছে।...কাল থেকে ঠিক ছটার সময় চলে আসিস পাঠঘরে। কোনো ছদ্মবেশ নয় কিন্তু— আঙুল মেড়ে সাবধান করে দেন তিনি।
জটাই মাথা নেড়ে এগিয়ে যায়। ডোম্বল ভাবে, এই রে, এবার ঠিক পালে বাঘ পড়বে। স্যার দেখে নেন জটাই কতটা তফাতে গিয়েছে, তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘হ্যা রে ভোমলা, একটা কথা বল দিকি তুই ধরলি কি করে যে ও ইয়ে নয়, ইয়ে...’
"এ তো সোজা স্যার, তার বিপদ কেটে গেছে বুঝে খুব ফুর্তি ভোম্বলের, ভূতকে কি মশা কামড়ায় ? বলুন আপনি। আর ব্রহামদৈত্য বলুন আর ইয়েই বলুন ওরা কেউ খৈনি খায় না। আমি জানতুম জটাইদার ওই নেশাটি আছে। তাই যেই দেখলুম খৈনি ভুলতে ডলতে ঘাড়ের ওপর মশা মারতে হাত তুলেছে ভূত। আমনি বুঝলুম হি হি- ভোম্বল হেসেই সারা হয়।
না, স্যার কিন্তু অত গোলমালের মধ্যেও তার সেই ব্যঙ্গচিত্রের কথা ভোলেননি। তাহলে চলি স্যার', বলে ভোম্বল যেই পেছন ফিরবে, বংকিম-স্যার অমনি তার কাঁধ চেপে ধরেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলেন, “তুই তো অনেক কথা শোনালি, কাণ্ডও করলি বিস্তর। আমি তোকে একটা কথা বলি? ছবিটা আমার যা এঁকেছিলি না বোর্ডে-যাকে বলে দারুণ!”
ডোম্বল অবাক! স্যার হা হা করে হাসছেন। পাশে কেষ্টধন চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তারও বত্ৰিশপাটি বিকশিত ।
0 coment�rios: