সম্রাটের ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনার শখ বরাবরই ছিল। একবার দু'জন গায়ককে নিয়ে আসা হল রাজদরবারে। তাদের গান-বাজনা শুনে সম্রাট মুগ্ধ হলেন। কিন্তু টাকাকড়ি ধনদৌলত উপহার দিলে প্রতিভার সমাদর ঠিকমতো হয় না ভেবে সম্রাট অনেক ভেবেচিন্তে গায়ক দু’জনকে দুটি হাতি দান করলেন। বড় বড় দুটি হাতির দিকে তাকিয়ে গরিব গায়ক দু’জন একটু যেন ভড়কে গেল। বিত্তহীন ও ভাগ্যহীন তারা, দুটি হাতি পুষবে কেমন করে? খাওয়াবেই বা কোথা থেকে, রাখবেই বা কোথায়? নিজেদেরই থাকার জায়গা নেই। কিন্তু সম্রাটের দেওয়া উপহার গ্রহণ না করলে সম্রাট রাগ করবেন? আর সম্রাটের রাগ মানে তাদের নিজ নিজ গর্দন দুটি যাওয়া। অগত্যা হাতি দুটিকে বাড়ি নিয়ে এসে তারা সমস্ত দুঃখের কথা স্ত্রী-পুত্রকে জানাল। এরপর তারা হাতি দুটিকে কোনওরকমে পুষতে লাগল।
যাই হোক, তাদের যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তাই দিয়ে তারা হাতিকে খাওয়ায় আর মাঠের ধারে বেঁধে রাখে। যথাসর্বস্ব তাদের গেল, তারা হল দেনা দায়গ্ৰস্ত পথের ভিখিরি। স্ত্রী-পুত্র না খেতে পেয়ে পথে পথে ঘুরছে, এখন উপায়? সম্রাটকে গান শোনাতে গিয়ে এ তাদের কী দুর্দশা হল? হাতির হাত থেকে কেমন করে রেহাই পাওয়া যায়? তাছাড়া এ আবার স্বয়ং সম্রাটের দেওয়া উপহার। না পারবে বিক্রি করতে, না পারবে বিলিয়ে দিতে! হায় ভগবান! একদিন দু’জনে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বীরবলের খ্যাতির কথা তাদের মনে পড়ল। ‘একমাত্র বীরবল ছাড়া আমাদের বাঁচার কোনও উপায় নেই’–ওরা ভাবল,‘দেখি একবার বীরবলকে বলে, কী করা যায়!"
একদিন বীরবলের বাড়ি গিয়ে ওঁরা কেঁদে পড়ল বীরবলের পায়ের কাছে। ঠাকুর, তুমি আমাদের বাঁচাও, আমাদের বড় বিপদ। তুমি আমাদের বাপ-মা!' - বীরবল ওদের মুখে সব ঘটনা শুনে কী উপায়ে দু’জনকে বাঁচানো যায় সেই কথাই ভাবতে লাগলেন। বীরবল অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘বেশ, এক কাজ করো। হাতি দুটোর গলায় এমন কায়দায় একটা মস্ত ঘণ্টা ও জয়ঢাক বেঁধে দাও, যাতে ওরা হাঁটতে গেলেই জোর বাজনা হয়। তারপর ওদেরকে কিছু খেতে না দিয়ে পথে ছেড়ে দাও। যাতে হাঁটলে ঢং ঢং করে ঘণ্টা জোরে বেজে উঠে শব্দ হয়।’
তারপর সেই গায়ক দু’জন বীরবলের কথা মতো ব্যবস্থা করে উপবাসী হাতি দুটোকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে এল। হাতি দুটো ছাড়া পেয়ে ছুটল একেবারে শহরের মাঝখান দিয়ে। চারদিকে লুটপাট করে খেতে লাগল ওঁরা। আর ওরই সঙ্গে সঙ্গে তাদের গলায় বাঁধা জয়ঢাক আর ঘণ্টা ভীষণ জোরে বাজতে বাজতে সমস্ত দিল্লি শহরকে মাতিয়ে তুলল। লোকজন সব যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে যেতে লাগল। খবর গিয়ে পৌছল সম্রাটের কানে। শহরে এখন দুই পাগলা হাতির মারাত্মক উৎপাত, যা পারছে তাই করছে। সম্রাট হুকুম করলেন, ওদের মালিককে ধরে আনো। কেন সে হাতিকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে।" তৎক্ষণাৎ সেই গায়ক দু’জনকে ধরে এনে সম্রাটের কাছে হাজির করা হল। সম্রাট প্রশ্ন করলেন, "হাতিকে তোমরা এভাবে শহরে ছেড়ে দিয়েছ কেন? এখনই জবাব দাও?’
তারা বলল, ‘হুজুর, বহুদিন ধরে ওদেরকে প্রতিপালন করেছি এবং বাদ্যযন্ত্রে শিক্ষাদান করিয়েছি। যখন ওরা বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে দেখলুম, তখন ওদের ছেড়ে দিয়েছি। ওরা এবার জনসাধারণকে বাদ্যি বাজনা শুনিয়ে রোজগার করে পেট চালাক! আমরা ওদেরকে বেশ ভাল বাজনা শিখিয়েছি হুজুর।
বাদশা আর হাসি চাপতে পারলেন না। দূর থেকে বীরবলও মুখ টিপে হাসলেন। তারপর বাদশা নিজের ভুল বুঝে ওদের দু’জনকে দুখানি জমি দান করলেন। সেই হল তাদের পুরস্কার। গায়ক দুজন খুশি মনে সেলাম করতে করতে বাড়ির পথে রওনা দিল ও সুখে-স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে লাগল।
0 coment�rios: