Search This Blog
চিংড়ি আর ফড়িং। দুই বোন! যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতী। আঁকের ক্লাসে আমরা বসে থাকতুম ‘থ’ হয়ে। বিদ্যুতের মতো আঁক কষে যেত দুবোন। গেল সন ও...
চিংড়ি-ফড়িংয়ের জন্মদিনে – সাজেদুল করিম
This website need javascript for better performance. Please enable javascript and enjoy your reading. Thanks Admin
Please Enable Javascript !!!
আমার বন্ধু বাপ্পা কী দারুণ ভাগ্যবান। তার কাকা লটারিতে এক কোটি টাকা পেয়ে গেলেন। বাপ্পা নিজে পায়নি, তাতে কী হয়েছে। ওর কাকা তো পেয়েছেন। এ...
বিশ্বমামার ভূত ধরা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমার বন্ধু বাপ্পা কী দারুণ ভাগ্যবান। তার কাকা লটারিতে এক কোটি টাকা পেয়ে গেলেন।
বাপ্পা নিজে পায়নি, তাতে কী হয়েছে। ওর কাকা তো পেয়েছেন। এক মাত্র কাকা।
এক কোটি টাকা মানে কত? একের পিঠে সাতটা শূন্য! ওরে বাবা, এত টাকা দিয়ে মানুষ কী করে! অত টাকার কথা ভাবতে আমারই মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
কেউ হঠাৎ বড়লোক হলে অমনি তার আশেপাশে ভিড় জমে যায়। বাপ্পাদের বাড়িতে এখন সব সময় অনেক লোক। তারা নানারকম পরামর্শ দেয়। কেউ বলে বোতলের জলের ব্যবসা করতে, কেউ বলে, আপনার মায়ের নামে একটা মন্দির বানিয়ে ফেলুন না। আর সবাই বললেন, আমাদের গ্রামে একটা রাস্তা বানিয়ে দিন।
বাপ্পার বীরুকাকা এইসব শুনে মুচকি মুচকি হাসেন। কারও-কে হা-ও বলেন না, -ও বলেন না। কত লোক চাঁদা চাইতে আসে। তাদের তিনি বলেন হবে, পরে হবে।
হঠাৎ একদিন বীরুকাকা উধাও হয়ে গেলেন।
একমাস বাদে তার খোঁজ পাওয়া গেল। বাপ্পার বাবাকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি টাকি নামে একটা জায়গায় একটা বাড়ি কিনেছেন, সেখানেই থাকবেন, কলকাতায় আর ফিরবেন না কখনো। ওখানে আর কেউ তাকে জ্বালাতন করতে পারবে না।।
প্রথমবার বাপ্পা টাকিতে গিয়ে সেই বাড়ি দেখে এসে আমাদের যা বলল, তা শুনে আমরা একেবারে হাঁ। সে যে কী দারুণ সুন্দর বাড়ি আর কী বিশাল বাগান, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না? সেটা আগে এক জমিদারের বাড়ি ছিল, তারা এখন খুব গরিব হয়ে গেছে, তাই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে।
বীরুকাকা সেই বাড়িটা কিনেছেন বিরাশি লক্ষ টাকা দিয়ে। জমিদারদের বংশে এখন তেইশ জন শরিক, তাদের মধ্যে টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমি মনে-মনে বিরাশিকে তেইশ দিয়ে ভাগ করার একবার চেষ্টা করলাম। তারপরই মনে হল, আমি তো টাকা পাচ্ছি না। আমার হিসেব করার দরকার কী?
অত টাকা দিয়ে শুধু-শুধু একটা বাড়ি কেনার কোনও মানে হয়?
বীরুকাকা বলেছেন, সারাজীবন তিনি ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন, তাই তার নিজস্ব একটা বাড়ির খুব শখ ছিল। লটারিতে জেতার খবরটা যেদিন পান, তার আগের রাত্তিরেই তিনি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন। পুরোনো আমলের সুন্দর দোতলা বাড়ি, সামনে মস্ত বড় পুকুর, দুপাশে বাগান। ওইরকম স্বপ্ন তিনি দেখলেন কেন? নিশ্চয়ই লটারির টাকা পাওয়ার সঙ্গে ওই রকম একটা বাড়ির সম্পর্ক আছে। অনেক খুঁজে-খুঁজে টাকিতে তিনি প্রায় স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যাওয়া বাড়িটা দেখতে পেলেন আর অমনি কিনে নিলেন।
বাপ্পা আর ওর বোনেরা সেখানে প্রত্যেক শনিবারে যায়। সে বাড়ির পুকুর ভর্তি কত বড়-বড় মাছ, আর বাগানে কত ফুল, সেই গল্প করে।
আর একমাস পরেই জানা গেল, সেটা ভূতের বাড়ি। এক রবিবার বাপ্পা টাকি থেকে ফিরে এল, তার বাঁ-পায়ে মস্ত বড় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভূতে তার পা ভেঙে দিয়েছে।
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বাপ্পাই সবচেয়ে বেশি গুলবাজ! এমন সুন্দর ভাবে গল্প বলে যে বিশ্বাস করে ফেলতে হয়। টাকির ওই অতবড় বাড়ির গল্প কি তবে গুল। বলতে-বলতে একেবারে ভূত এনে ফেলেছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতে তোর পা ভাঙল কী করে রে? ঠেলা মারল? ঠিক দুকুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা।।
বাপ্পা বলল, নীলু তুই বিশ্বাস করিস না তো? তুই এই শনিবার চল আমার সঙ্গে। নিজের কানে শুনবি।
শুনেই আমি এক পায়ে খাড়া। আর কিছু না হোক, বেড়ানো তো হবে।
টাকি খুব দূর নয়। কলকাতা থেকে একটা বাসে যাওয়া যায় হাসনাবাদ। সেখান থেকে আর এক বাসে টাকি।।
পোঁছে দেখি, বাপ্পা তো একটুও মিথ্যে বলেনি। বিরাট লোহার গেট, তারপর লাল সুরকি বেছান রাস্তা, বাড়িটা প্রায় দুর্গের মতন। তার সামনে একটা চারকোণা মস্ত বড় পুকুর, সেটাকে দিঘিই বলা উচিত। টলটলে জল। অনেক মাছ থাকতেই পারে। দুপাশে বাগান, একদিকে সব ফুল গাছ। আর একদিকে ফলের গাছ। মস্ত-মস্ত সব গাছ, সে বাগানটা অনেকখানি ছড়ানো।
বাড়িটা বেশ পুরোনো, দেওয়ালে শ্যাওলা জমে গেছে। এরকম বাড়িতে ভূত থাকা স্বাভাবিক। সিমলায় এ রকম ভূতের বাড়ি দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, ছোটবেলা থেকেই আমি বিশ্বমামার চ্যালা। বিশ্বমামা যে বলে দিয়েছেন, ভূত বলে কিছু নেই। আজ পর্যন্ত কেউ সত্যি-সত্যি ভুত দেখেনি। অনেক মানুষ এমনি-এমনি ভয় পায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, ভূতটা কোথায় থাকে রে? এই বাড়ির ছাদে, চিলেকোঠায়? বাপ্পা বললে, না।
তারপর আঙুল দেখিয়ে বললে, থাকে ওই ফলের বাগানে। বোধহয় ব্রহ্মদৈত্য। ব্রহ্মদৈত্যরা বাড়িতে থাকে না। গাছে থাকে।
আবার জিগ্যেস করলুম, তুই নিজের চোখে দেখেছিস? বাপ্পা বলল, দেখা দেয় না। কথা শোনা যায়, ভয় দেখায়।
বীরুকাকা বসে আছেন বৈঠকখানায়। হাতে একখানা বই। সেই ঘর ভর্তি অনেক বই, পাশের ঘরে তিন চারখানা বই ভর্তি আলমারি। বীরুকাকা এখানে সর্বক্ষণ বই পড়েন।
এত বড় বাড়িতে এখন দুজন মাত্র কর্মচারী। এক জন দরোয়ান, আর একজন রান্নার ঠাকুর। দারোয়ানের আবার কাল থেকে জুর হয়েছে। আমি বীরুকাকাকে প্রণাম করতেই তিনি বাপ্পার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, এ কে?
বাপ্পা বললে, আমার বন্ধু নীলু, ও খুব আসতে চাইছিল—
বীরুকাকা বললেন, ওকে বুঝি ভূত দেখাতে এনেছিস? এবার সারা কলকাতায় রটে যাবে দলে-দলে লোক ছুটে আসবে।
বাপ্পা বলল, না, না, নীলু আর কারুকে বলবে না।
আমি ফস করে জিগ্যেস করলুম, বীরুকাকা, সত্যি এখানে ভূত আছে? বীরুকাকা বললেন, আছে তো বটে, কিন্তু সে তো কারুর ক্ষতি করে না। বাপ্পা বলেছিল, ওর কথা শুনে আমার যে পা ভাঙল। বীরুকাকা বললেন, তুই ভয় পেয়ে দৌড়েছিলি, তাই আছাড় খেয়ে পা ভেঙেছিস। বাপ্পা বলল, রান্নার ঠাকুর যে বমি করল?
বীরুকাকা বললেন, আমি কারুকে এখন ওই বাগানের দিকে যেতে বারণ করেছি, এখন ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। আমার এ বাড়িতে নতুন এলে তো, তাই ব্ৰহ্মদৈত্য ঠিক মেনে নিতে পারছে না। কিছুদিন কেটে যাক, আমরা যদি ওকে বিরক্ত না করি, তাহলে ও আর কিছু বলবে না।
সত্যিই তাহলে ব্রহ্মদৈত্য আছে? তবে তত একবার দেখতেই হয়। বীরুকাকা বারণ করলেও যেতে হবে। বাপ্পাও তো আমাকে সেই জন্যই নিয়ে এসেছে।
বীরুকাকা বিকেলের দিকে একবার বাজারে যান। এখানে বিকেলে বাজার বসে।
বীরুকাকা বেরিয়ে যেতেই আমরা দুজনে চলে গেলুম ফলের বাগানের দিকে। বাপ্পার এখনো সারেনি, লেংচে-লেংচে হাঁটছে।
বাপ্পা বলল, শোন নীলু, ভয় পাবি না কিন্তু। দৌড়বি না। তুই দৌড়লে আমি পিছিয়ে পড়ব। তখন যদি আমার গলা টিপে দেয়।
আমি মনে-মনে হাসলুম। বীরুকাকা যাই-ই বলুন, আমি অত সহজে ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য বিশ্বাস করতে রাজি নই। বিশ্বমামার চ্যালারা অত সহজে ভয় পায় না।
বাগানের প্রথম দিকেই অনেকগুলো আমগাছ। কচি-কচি আম হয়েছে। তারপর জাম, কাঁঠাল, লেবু, আরও কত রকম গাছ। আমি চিনি না। একটা গাছ ভর্তি বেল।
হাঁটতে-হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এলুম। বাগান তো নয়, যেন জঙ্গল। এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না। এপাশেও একটা ছোট পুকুর আছে। এমনিতেই বাগানের ভেতরটা ছায়া-ছায়া, এখন আবার সন্ধে হয়ে এসেছে। বেড়াতে ভালো লাগছে। ভয় করছে না একটুও। কোথায় ভূত কিংবা ব্রহ্মদৈত্য? তাহলে কি বাপ্পার মতন বীরুকাকাও গুল মারেন?
পুকুরটার ধার দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ গম্ভীর গলায় কে যেন ধমকে উঠল। ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। আওয়াজটা আসছে শেষ গাছের ওপর থেকে। এবার ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মারলুম টেনে একটা দৌড়। বাপ্পা কাতর গলায় বলতে লাগল, এই নীল, দাঁড়া, দাঁড়া, আমায় ফেলে যাস না!
আমি দৌড় থামালুম একেবারে বৈঠকখানার সিঁড়িতে পৌঁছে।
বাপ্পা এসে গেল একটু পরে। চোখ পাকিয়ে বলল, বিশ্বাসঘাতক, কাওয়ার্ড। আমাকে ফেলে পালাতে লজ্জা করল না? যদি আমার গলা টিপে দিত?
আমি একটু চুপ করে রইলুম। সত্যিই তো আমার দোষ!, তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করলুম, তুই ওকে দেখতে পেলি?
বাপ্পা বললে, ওরা অশরীরী? সবসময় কি দেখা যায়? মাঝে-মাঝে স্বরূপ ধরে এবার নিজের কানে শুনলি তো?
আমি বললুম, আমার কিন্তু পা ভাঙেনি, কোনও ক্ষতিও হয়নি। বাপ্পা বলল, দ্যাখ না কী হয়। ও ধমকালে একটা না একটা কিছু হবেই।
সত্যিই, সে রাতে আমার জ্বর এসে গেল। রাত্তিরবেলা খালি মনে হতে লাগল, মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ, মাথায় জটা, চোখ দুটো আগুনের ভাটার মতন, একটা ব্রহ্মদৈত্য জানলা দিয়ে আমাকে দেখছে।
পরদিন সকালে আমি জুর গায়েই পালিয়ে এলুম কলকাতা।
বিশ্বমামা কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ত। বিনা বিদ্যুতে ঘরের পাখা চালানো যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা করছেন। মন দিয়ে শুনলেন আমার কথা।
তারপর বললেন, আমার চ্যালা হয়ে তুই যখন ভয় পেয়েছিস, তখন তো ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তুই নিজের কানে শুনেছিস?
--হ্যাঁ।
--স্পষ্ট?
--স্পষ্ট মানুষের গলা। --কোনও লোককে দেখতে পাসনি।
--না। গাছের ওপর-ওপর লুকিয়ে থাকতে পারে।
--তাহলে তো এগিয়ে দেখতে হয়। চল কালকেই যাই।
--কিন্তু বীরুকাকা যদি রেগে যান? উনি এ নিয়ে বেশি হই-চই পছন্দ করেন। কলকাতা থেকে কেউ যাক, উনি চান না।
--আরে বীরুকাকা মানে বীরেশ্বর দত্ত তো? আমাকে উনি ভালোই চেনেন। লটারির টাকা পেয়ে বড়লোক হয়েছেন বলে তো আর আমাকে ভুলে যাবেন না!
পরদিন বিশ্বমামার গাড়িতে চেপে বসলুম আমি আর বাপ্পা। খানিকবাদে বিশ্বমামা বললেন, তোরা গাড়ি-ভূত দেখেছিস কখনো? আমি আর বাপ্পা চোখ বড়-বড় করে তাকালুম।
বিশ্বমামা বললেন, একটু চুপ করে থাক।
হঠাৎ মিষ্টি মেয়েলি গলায় কে যেন বলে উঠল আজ মঙ্গলবার, ৭ সেপ্টেম্বর, এখন বেশ ভালো রোদ উঠেছে। কিন্তু বিকেলের দিকে বৃষ্টি হবে। রাস্তাটা ভালো নয়, একটু সাবধানে চালাও!’
কথাটা থেমে যাওয়ার পর বিশ্বমামা বললেন, দেখলি আমার গাড়ি কীরকম কথা বলে।
আমি বললুম, এটা গাড়ি-ভূত তো নয়, গাড়ি-পেত্নী হতে পারে। মেয়ের গলা।
বিশামা বললেন, তা ঠিক গাড়ি-পেত্নী শুনতে ভালো না। গাড়ি-পরী বললে কেমন হয়?
বাপ্পা বললে, আপনি গাড়িতে কোনও যন্ত্র লাগিয়েছেন।
বিশ্বমামা বললেন, এটা আমার আবিষ্কার করা যন্ত্র। আবহাওয়া বলে দেবে, রাস্তার অবস্থা বলে দেবে।
বাপ্পা বললে, আমার কাকার বাগানবাড়িতে আমরা শুনেছি, তা কিন্তু কোনও যন্ত্র হতে পারে না। বাগানে কে যন্ত্র বসাবে? তাছাড়া যখনই ও ধমকে বলে, দেখাচ্ছি মজা, তারপরই কারুর জ্বর হয়, কারও পা মচকায়, কারুর বমি হয়।
বিশ্বমামা বললেন, হাঁ!
টাকির সেই বাগানবাড়িতে পৌঁছে বিশ্বমামা খুব খুশি। বারবার বলতে লাগলেন, দারুণ বাড়ি। চমৎকার বাড়ি। এত খোলামেলা। এখানে এসে মাঝে-মাঝে থাকতে হবে।
বীরুকাকার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি সেই কথা শুনে বললেন, বিশ্ব, তুমি এসেছ, বেশ করেছ। যতদিন ইচ্ছে থাকে। কিন্তু বাগানের দিকে গিয়ে গোলমাল করো না।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুকাকা আপনি ভূত পুষেছেন এখানে।
বীরুকাকা বললেন, আমি কুকুর পুষি না। বেড়াল পুষি না। ভূত পুষতে যাব কেন? ভূত কাকে বলে আমি জানিই না। তবে বাগানে কে একজন কথা বলে। আমরা কেউ ওদিকে যাই, সে পছন্দ করে না। তাই ধমকায়।
বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, আপনিও শুনেছেন?
বীরুকাকা বললেন, হ্যাঁ, একবার শুনেছি। আর ওদিকে যাই না। বিশ্বমামা বললেন, আপনার কোনও ক্ষতি হয়েছে? জ্বর কিংবা পেটের অসুখ?
বীরুকাকা বললেন, নাঃ, সেরকম কিছু হয়নি।
বিশ্বমামা বললেন, আপনি বাড়ির মালিক বলে আপনার কোনও ক্ষতি করেনি। কিন্তু আপনারই বাগান অথচ সেখানে আপনি যেতে পারবেন না, এটাই বা কেমন কথা!
বীরুকাকা বললেন, আমার ধারণা, আর কিছুদিন থাকলেই ওই ভূত আমাদের চিনে যাবে। তারপর কিছু বলবে না।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা আপনি লটারিতে বহু টাকা পেয়ে এমন দুর্দান্ত একটা বাড়ি কিনেছেন। ওই টাকা নিয়ে আপনি সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, বাড়িতে দশটা কাজের লোক রাখতে পারবেন, সারাজীবন রোজ রাবড়ি খেতে পারবেন। কিন্তু একটা কী জিনিস পারবেন না বলুন তো? এই যে বিশ্ব আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কান ধরে ওঠবোস করাতে পারবেন? এক কোটি টাকা পুরোটা দিয়ে দিলেও পারবেন না।
বীরুকাকা অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে আমি কান ধরে ওঠ-বোস করাতে যাব কেন?
বিশ্বমামা বললেন, ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রতিজ্ঞা আছে। আমাকে যদি কেউ ভূত দেখাতে পারে তার সামনে আমি দশবার কান ধরে ওঠ-বোস করব। সেই জন্যই আপনার বাগানে আমি দু-একবার যেতে চাই। ভূতকে আমি বিরক্ত করব না, তাড়াবারও চেষ্টা করব না। শুধু একবার দেখব।
বীরুকাকা বললেন, শুনেছি ভূত সবসময় চোখে দেখা যায় না। অশরীরী হয়ে থাকে। আমিও তো দেখিনি শুধু তার কথা শুনেছি।
বিশ্বমামা বললেন, কথা শুনলেও চলবে। কোনও মানুষ নেই, অথচ শূন্য থেকে কথা বলছে, তাও তো ভূতের কাণ্ডই বলতে হবে।
বীরুকাকা বললেন, যেতে চাও যাও, তবে সাবধানে থেকো। বেড়াতে এসেছ, তোমার কোনও ক্ষতি হোক, তা আমি চাই না।
তারপর চা-জলখাবার খেয়ে বিকেল বেলা বাগানের কাছে এসে বিশ্বমামা বললেন, নীলু, বাপ্পা, তোরা কোন জায়গায় ভূতের কথা শুনেছিস, সেই জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দে। তোদের সঙ্গে যেতে হবে না। আমি একা যাব।
আমার ইচ্ছে ছিল, বিশ্বমামার সঙ্গে গিয়ে ব্যাপারটা কী হয় তা দেখা। কিন্তু বিশ্বমামা দারুণ গোঁয়ার মানুষ, একবার যখন বলেছেন একা যাবেন, তখন আর ওলটানো যাবে না।
বিশ্বমামা চলে গেল বাগানে। আমরা বসে রইলুম পুকুরটার ধারে। ঘন-ঘন তাকাচ্ছি বাগানের দিকে। খালি মনে হচ্ছে, এই বুঝি বিশ্বমামা দৌড়ে বেরিয়ে আসবে।
বিশ্বমামা বাগান থেকে বেরিয়ে এল প্রায় এক ঘণ্টা পরে। দৌড়ে নয়, আস্তেআস্তে হেঁটে।
এই রে, বিশ্বমামা ভূতের কথা শুনতে পাননি নাকি? বিশ্বমামা এত বড় বিজ্ঞানী, তাকে দেখেই কি ভূত ভয় পেয়ে চুপ করে গেছে।
বিশ্বমামা তার লম্বা নাকটার ওপর হাত তুলেছেন। ওটা দেখেই বোঝা যায়, ওর মাথায় কিছু একটা নতুন আইডিয়া এসেছে।
আমাদের কাছে এসে বললেন, বেশ সুন্দর বাগানটা। পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ।
আমি কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিগ্যেস করলুম, বিশ্বমামা, তুমি কিছু শুনতে পাওনি?
সে আর উত্তর না দিয়ে বিশ্বমামা বললেন, বল তো, কোন গাছে বাজ পড়েছে, তা কী করে বোঝা যায়?
এখন এই সব কথা শুনতে কারুর ভালো লাগে?
আমি আবার জিগ্যেস করলুম, শুনতে পেয়েছ কিনা, সেটা আগে বলল।
বিশ্বমামা বললেন, হ্যা শুনেছি। খুবই স্পষ্ট। আমার ধারণা ছিল ভূতরা নাকি সুরে কথা বলে। তা কিন্তু নয়। অবিকল মানুষের মতন গলা।
বাপ্পা জিগ্যেস করল, সেখানে কোনও মানুষ ছিল?
বিশ্বমামা মাথা নেড়ে বললেন, না কোনও মানুষ ছিল না। আমি ভাললা করে দেখেছি। গাছের ওপরেও কেউ লুকিয়ে ছিল না।
বাপ্পা বলল, তবে?
বিশ্বমামা বললেন, মানুষ নেই, অথচ কথা বলছে। এতে রহস্যময় ব্যাপার বটেই। তবে কি এবার সত্যি সত্যি কান ধরে ওঠবোস করতে হবে? আর একটা দিন সময় দরকার। তোরা কথাটা কবার শুনেছিলি?
বাপ্পা বলল, আমি দুবার।।
আমি বললুম, আমি একবার শুনেই....
বিশ্বমামা বললেন, তারপর দৌড় মেরেছিলি, তাই তো? ঠিক আছে। রাত্তিরে বীরুদা কী খাওয়াবে? এইসব জায়গায় খুব ভালো কচি পাঁঠার মাংস পাওয়া যায়-মাংসের ঝােল আর লুচি যদি হয়।
আমরা ভেবেছিলুম, বিশ্বমামার জুর কিংবা বমি হবে। সেরকম কিন্তু কিছুই হল। দিব্যি লুচি মাংস খেলেন, তারপর ঘুমােত গেলেন তাড়াতাড়ি।
পরদিন সকালে উঠে ভূত বিষয়ে কোনও কথাই বললেন না। গাড়ি নিয়ে আমরা ঘুরলাম গ্রামে-গ্রামে। এখানকার নদীতে নৌকা চেপে বেড়ানোও হল। নদীর ধারেই একটা দোকানে গরম-গরম জিলিপি পাওয়া গেল, শিঙাড়া খেলুম প্রাণভরে। এক ঠোঙা নিয়েও আসা হল বীরুকাকার জন্য।
বীরুকাকা জিলিপি খেতে-খেতে জিগ্যেস করলেন, কী বিশ্ব, কিছু বুঝলে? তোমার মতন একজন বৈজ্ঞানিক, পৃথিবীতে কত দেশে বক্তৃতা দিতে যাও, তুমি কান ধরে ওঠবোস করবে, এটা ভাবতেই আমার মজা লাগছে।
কিছু না বলে বিশ্বমামা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।
বীরুকাকা বললেন, অবশ্য, তোমাকে যে ওরকম করতেই হবে, তার কোনও মানে নেই। আমি তো আর তোমার সঙ্গে বাজি ধরিনি। তুমি নিজেই ঠিক করেছ।
বিশ্বমামা বললেন, বীরুদা, আজ সন্ধেবেলা একবার আমার সঙ্গে বাগানে যাবেন?
বীরুকাকা বললেন, না, না, আমি তো বলেইছি ওসব অপদেবতাদের ঘাঁটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। সে তত আমাদের কোনও ক্ষতি করছে না। আমরাই বা তাকে ডিসটার্ব করতে যাব কেন? আর কথাটা বেশি রটে গেলে অনেক লোক ভিড় করে এসে ভূতের বাড়ি দেখতে চাইবে।
বিশ্বমামা বললেন, আমি ভূত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করব না। ডিসটার্বও করব না। একটা অন্য জিনিস দেখাব, নীলু আর বাপ্পাকে সঙ্গে নিতে পারি। কিন্তু ওদের ভয় পেয়ে দৌড়ানো চলবে না। না দৌড়ালে জ্বরও হবে না, পা-ও মচকাবে না।
সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর বেরিয়ে পড়লুম সদলবলে।
বাগানের মধ্যে ঢুকে বিশ্বমামা এমনভাবে এগোলেন, মনে হল উনি কোথায় যাবেন, আগে থেকেই ঠিক করা আছে।
একটা লম্বা গাছের কাছে গিয়ে তিনি থামলেন। সেটাকে গাছ বোঝাই যায় না। তালগাছ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ওপরের ডালপালা কিছু নেই।
বিশ্বমামা বললেন, এই গাছটার ওপর বাজ পড়েছিল অনেক দিন আগে। সাধারণত এরকম লম্বা গাছের ওপরই বাজ পড়ে।
বীরুকাকা বললেন, বাজ পড়া গাছের সঙ্গে ওই ব্যাপারটার কী সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না।
বিশ্বমামা বললেন, বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ কোনও কথা বলবেন না। একদম চুপ। ভূতের রং কুচকুচে কালো।
তারপর ভূতের গলার আওয়াজ শোনার আগেই বিশ্বমামা চেঁচিয়ে বললেন, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন শোনা গেল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
আর কেউ নেই সেখানে, তবু শোনা গেল সেই কথা।
বিশ্বমামা একগাল হেসে বললেন, বীরুদা, নীলু, বাপ্পা, তোমরা তিনজনেই এই একই কথা শুনেছ?
তিনজনেই মাথা নেড়ে বললুম, হ্যা। বিশ্বমামা বললেন, ভূত কি শুধু এই একটাই কথা জানে? আর কিছু বলতে পারে না?
বিশ্বমামা এবার চেঁচিয়ে বললেন, রাধাকৃষ্ণ।
আর কিছু শোনা গেল না। বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না, বলো রাধাকৃষ্ণ।
এবার শোনা গেল, রাধাকৃষ্ণ। বীরুকাকা চোখ বড়-বড় করে বললেন, ময়না?
বিশ্বমামা বললেন, নিশ্চয়ই। টকিং বার্ড। অবিকল মানুষের গলা নকল করতে পারে। কারুর বাড়ির পোষা ময়না, আগেকার মালিক ওই কথাটা শিখিয়েছিল, চোরটোরদের ভয় দেখাবার জন্য। আপনি রাধাকৃষ্ণ বলতে শেখান, তাই শিখবে। রামসীতাও শেখাতে পারেন। ভূত তো কখনো রামনাম উচ্চারণ করে না।
আমাদের তিনজনেরই চোখে তখনই অবিশ্বাসের ছাপ দেখে বিশ্বমামা আবার বললেন, ময়না পাখি সাধারণত নির্জন জায়গায় বাসা বাঁধে। এমন গাছের ভেতরে থাকে, যে গাছে সাধারণত মানুষ ওঠে না। এই জন্য ওরা বাজ-পড়া গাছ বেশি পছন্দ করে। দেখবেন পাখিটা?
পোড়া তালগাছটা ধরে খানিকটা ঝাকাতেই তার ডগা থেকে ঝটপট করে একটা কালো রঙের পাখি বেরিয়ে উড়তে লাগল, আর বলতে লাগল, ওখানে কে রে? ওখানে কে রে? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা! রাধাকৃষ্ণ।
বিশ্বমামা বললেন, আমি ইচ্ছে করলে ওকে ধরে খাঁচায় রাখতে পার, কিন্তু আগেই কথা দিয়েছি, ওকে ডিসটার্ব করব না। ও থাক নিজের মতন!
বীরুকাকা বললেন, বিশ্ব, তোমাকে আর কান ধরে ওঠ-বোস করতে হল না। তার বদলে তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। কী চাও, বলো?
বিশ্বমামা বললেন, গলদা চিংড়ি ভাজা।
অ- অ+ ঘরে ঢুকেই বিশ্বমামা বললেন, কীসের একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি। ছোটমাসি বললেন, সে কি তুই ফুলের গন্ধ চিনিস না? আমেরিকায় গিয়ে কি ...
বিশ্বমামা ও নকল ফুল - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ঘরে ঢুকেই বিশ্বমামা বললেন, কীসের একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি। ছোটমাসি বললেন, সে কি তুই ফুলের গন্ধ চিনিস না? আমেরিকায় গিয়ে কি ফুলের গন্ধও ভুলে গেলি?
ঘরের এক পাশে একটা নিচু টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল রাখা আছে। সাদ, আর গোলাপি রং মেশা। ফুলদানিটার গায়েও সুন্দর ছবি আঁকা।
বিশ্বমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, ফুলের এত তীব্র গন্ধ? তবে যে অনেকে বলে, আজকাল ফুলের গন্ধ খুব কমে গেছে। গোলাপ ফুলে গন্ধই থাকে না।
আমার দিকে ফিরে বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, এগুলো কী ফুল রে নীলু?
এই রে, আমি বিপদে পড়ে গেলুম। আমি তো অত ফুল চিনি না। গোলাপ, গাঁদা আর জবা চিনতে পারি বড়জোর। ‘ঘেঁটু’ বলে একটা ফুলের কথা গল্পের বইতে পড়েছি। কিন্তু সেটা কী রকম দেখতে, তা আমি জানি না।
আমার মুখের অবস্থা দেখেই বিশ্বমামা বুঝে গেলেন। এবার আমার দাদার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, বিলু, তুই বলতে পারবি? দাদা আমার থেকে অনেক চালাক।
সে বললে, ওগুলো কী ফুল নয়, তা আমি বলতে পারি। সূর্যমুখী নয়, রজনীগন্ধা নয়, চাপা ফুল নয়, কুমড়ো ফুল নয়।
ছোটমাসি বললেন, ধ্যাৎ! কুমড়ো ফুল কেউ ফুলদানিতে রাখে নাকি? দাদা বললে, রাখলেই হয়। কুমড়ো ফুল বুঝি ফুল নয়? ছোটমাসি বললেন, কুমড়ো ফুল ভাজা করে খায়। আজই খাওয়ার টেবিলে পাবি।
বিশ্বমামা বললেন, বাঃ, কুমড়ো ফুল ভাজা আমার খুব ফেভারিট। বিদেশে আজকাল এঁচোর আর পটল পর্যন্ত পাওয়া যায়। কিন্তু কুমড়ো ফুল কোত্থাও দেখিনি।
বিশ্বমামা তো সারা বিশ্ব টহল দিয়ে বেড়ান। অনেক দেশে তাঁকে বক্তৃতা দিতে হয়। প্রায়ই থাকেন না কলকাতায়। মাঝে-মাঝে যখন আসেন, তখন অনেক আত্মীয়দের বাড়িতে তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। ওঁর দুই ভাগ্নে হিসেবে নেমন্তন্ন জুটে যায় আমাদেরও।
আজ ছোটমাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন। সব চেনাশুনো বাড়ির মধ্যে ছোটমাসির বাড়ির নেমন্তন্নই সবচেয়ে বিখ্যাত।
পাঁচ রকমের মাছ আর তিন রকমের মাংস তো থাকবেই।
ছোটমাসি বললেন, আর কেউ এত সহজে গন্ধ পায় না, বিশ্ব ঠিক গন্ধ পাবেই। ছোটবেলা থেকেই ও এরকম। কত বড় নাক।
বিশ্বমামা নিজের লম্বা নাকটার ওপর হাত বুলিয়ে বললেন, আমি এক কিলোমিটার দূর থেকেও যে-কোনও জিনিসের গন্ধ পাই। এই গন্ধটা চেনা-চেনা লাগছে, কিন্তু এই ফুল আগে দেখিনি।
ফুলদানির পাশের সোফায় বসে পড়ে বিশ্বমামা ফুলের তোড়াটা ভালো করে দেখতে লাগলেন।
ছোটমেসো মুখের সামনে মেলে ধরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এবার কাগজটা সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ওটা বিদেশি ফুল। বিশ্ব, তুমি তো অষ্ট্রেলিয়া ঘুরে এসেছ, সেখানে দেখোনি?
বিশ্বমামা বললেন, কোনও দেশে গেলেই কি সেখানকার সব ফুল দেখা যায়? অনেক জায়গায় ফুল দেখার সময়ই পাই না। এ ফুল এখানে কোথায় ফোটে? বেশ টাটকা দেখছি, এখনও শিশির লেগে আছে।
ছোটমেসো বললেন, হর্টিকালচার বাগানে ফোটে। আমাদের বাড়ির ছাদের টবেও ফোটে।
ছোটমাসি বললেন, মানিকতলায় একটা কারখানাতেও হয়। বিশ্বমামা বললেন, কারখানায়? ভেতরে বাগান আছে বুঝি?
ছোটোমেসো হো-হো করে হেসে উঠলেন।
ছোটমাসিও হাসতে-হাসতে বললেন, আজ বিশ্বকে খুব ঠকানো গেছে। তুই বুঝতেই পারলি না, বিশ্ব, ওগুলো তো নকল ফুল।
আমি আর বিলুদা একসঙ্গে বলে উঠলুম, আঁ!
সত্যিই বোঝবার উপায় নেই। পরীক্ষা করার জন্য আমি একটা পাপড়ি নোখ দিয়ে চেপে ধরলুম। আসল ফুল হলে নোখের ধারে পাপড়িটা ছিঁড়ে যেত, এর কিছুই হল না।
জলের ফোটাগুলো পর্যন্ত নকল।
বিশ্বমামা তবু দমে না গিয়ে বললেন, ছোড়দি, তোমার এরকম অধঃপতন হয়েছে। তুমি নকল ফুল দিয়ে ঘর সাজাচ্ছ? ছি ছি!
ছোটমাসি বললেন, কেন, নকল ফুলের দোষ কী হল? আজকাল এমন চমৎকার ভাবে বানায়, আসল আর নকলের তফাৎ একটুও বোঝা যায় না।
তুই ও তো বুঝতে পারিসনি।
ছোটমেসো বললেন, ঘরের মধ্যে খানিকটা ফুল থাকলে ঘরটা বেশ উজ্জ্বল দেখায়। রোজ-রোজ আর টাটকা ফুল কোথায় পাচ্ছি বলো।
ছোটমাসি বললেন, টাটকা ফুল শুকিয়ে যায়, ফেলে দিতে হয়। ফুলদানির জল পালটাতে হয়, অনেক ঝামেলা। এ ফুলের তো জলও লাগে না। দেখতেও খুব সুন্দর।
আমি জিগ্যেস করলুম, নকল ফুলের তো গন্ধ থাকে না। এই ফুলে গন্ধ এল কী করে?
ছোটমাসি বললেন, আমার পারফিউমের শিশি থেকে রোজ দু-এক ছিটে দিয়ে দিই। সেই গন্ধই থাকে অনেকক্ষণ।
বিশ্বমামা বললেন, সেইজন্যই গন্ধটা চেনা-চেনা লাগছিল। শ্যানেল ফাইভ পারফিউম, তাই না?
ছোটমাসি বললেন আগে তো ধরতে পারিসনি।
কথা ঘোরাবার জন্য বিশ্বমামা বললেন, ছোটবেলায় আমরা বলতুম সেন্ট, এখন বলি পারফিউম। যেমন, আগে যাকে বলা হত, স্পোর্টস গেঞ্জি, এখন তাকেই বলি টি-শার্ট।
খাওয়ার টেবিলে বিশ্বমামাকে খুব মনমরা মনে হল।
বিশ্বমামাই সব জায়গায়, নানান জায়গায় কথা বলে সবাইকে জব্দ করে রাখেন, আজ নিজেই প্রথম জব্দ হয়ে গেছেন, তাই সেটা মেনে নিতে পারছেন না।
টেবিলে কত রকম খাবার, তবু বিশ্বমামা চুপচাপ। খাচ্ছেনও ফেলে ছড়িয়ে। ছোটমেসো তাকে কয়েকবার খুঁচিয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন। তাতেও কোনও ফল হল না। খাবার ঘরেও একটা ফুলদানিতে নকল ফুল।
এর দু-দিন পর আমরা বিশ্বমামার সঙ্গে বেড়াতে গেলুম মধ্যপ্রদেশে। আমাদের বেড়ানো, বিশ্বমামার কিছুটা কাজও আছে।
মধ্যপ্রদেশে বস্তার জেলার জপ্সল বিখ্যাত। এখানে ছোট-ছোট পাহাড় আর জপ্সলই বেশি।
আমরা উঠলুম একটা ডাকবাংলোতে। তার খুব কাছ থেকেই জঙ্গলের শুরু।
এই জঙ্গলে বাঘ আছে। ডাকবাংলোর চৌকিদার বলল, পরশুদিনই একজন কাঠুরেকে বাঘে মেরেছে। আর কয়েকজনের চোখের সামনেই বাঘটা সেই লোকটাকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে চলে গেল।
আর আছে ভালুক। সেগুলো বাঘের চেয়েও কম হিংস্র নয়। ভালুক নাকি দিনের বেলাতেও দেখতে পাওয়া যায়। জপ্সল ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। লোকজনদের পরোয়া করে না।।
এই জঙ্গলে আমাদের তিনদিন ঘুরে-ঘুরে খুঁজতে হবে একটা গাছের পাতা। বিশ্বমামা জিগ্যেস করলেন, কী রে, ভয় পাবি না তো?
বিলু বলল, ভয় না পেতেও পারি। কিন্তু বন্দুক-টন্দুক না নিয়ে খালি হাতে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের কামড়ে মরার কি খুব দরকার আছে?
বিশ্বমামা বললেন, একেবারে খালি হাতে তো নয়। আমার কাছে একটা রিভলবার আছে। সেটা তোর কাছে রাখবি।
রিভলভার। আমরা সিনেমায় দেখেছি, বাঘ শিকার করার জন্য বড়-বড় বন্দুক কিংবা রাইফেল লাগে। ছোট্ট একটা রিভলভার দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?
বিশ্বমামা বললেন, মারতে হবে কেন? আমি কোনও জানোয়ার মারা পছন্দ করি না।
মাঝে-মাঝে এমনিই এক-একটা গুলি ছুঁড়বি। এ রিভলভারটায় খুব জোর শব্দ হয়। সেই শব্দ শুনলে বাঘ বা ভালুক আর কাছে আসবে না। এই শব্দ শুনলেই ওরা ভয় পায়।
পরদিন বেরুনো হল সকালবেলা।
কোন গাছের পাতা খুঁজতে হবে?
বিশ্বমামা বললেন, তোরা কখনো চা গাছ দেখেছিস?
আমি বললুম, হ্যাঁ, অনেকবার। দার্জিলিং গেলেই দু-দিকে চা বাগান দেখা যায়। একবার কুচবিহার যেতে গিয়েও অনেক চা-বাগান দেখেছি।
বিশ্বমামা বললেন, তবে তো ভালোই। আমরা তিনজনেই জঙ্গলে গিয়ে চা-গাছ খুঁজব। দেখতে পেলে পাতা ছিড়তে হবে।
বিনু বলল চা গাছ? আমরা যে ভূগোল বইতে পড়েছি, ইন্ডিয়াতে শুধু বাংলা, অসম আর ত্রিপুরাতেই চা হয়। অন্য কোথাও হয় না।
বিশ্বমামা বললেন, তা ঠিকই পড়েছিস। বই-টইগুলো লেখা হয়ে যাওয়ার পরেও তো অনেক নতুন কিছু জানা যায়। কিছুদিন হল জানা গেছে যে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলেও কিছু চা-গাছ দেখা গেছে। সেগুলো বুনো চা-গাছ। সে গাছের পাতার নমুনা নিয়ে গিয়ে আমাদের বিসার্চ করে দেখতে হবে। যদি ভালো জাতের চা-গাছ হয়, তাহলে এখানেও চা-বাগান বসানো যাবে।
শুরু হল আমাদের অভিযান।
রিভলভারটা বিশ্বমামা বিলুর হাতে দিয়েছেন, কারণ সে আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমার হাতে শুধু একটা গাছের ডালভাঙা লাঠি। বিশ্বমামাও, হাতে ওইরকম একটা লাঠি রেখেছেন, কারণ বাঘ ভালুক ছাড়াও যদি সামনে একটা সাপ চলে আসে, সেটাকে ভয় দেখাতে হবে তো?
প্রথমে জপ্সলটা বেশ পাতলা। দু-একটা লম্বা গাছ আর কিছু ঝোপঝাড়। জন্তু-জানোয়ার কিছু নেই।
আমরা প্রথম দেখলুম দুটো খরগোশ। ছাই-ছাই গায়ের রং আর লাল রঙের চোখ। আমি উত্তেজিত ভাবে বললুম, ওই দ্যাখো, ওই দ্যাখো। বিশ্বমামা ফিরে তাকিয়ে বললেন, কী? কোথায়?
আমি বললুম, খরগোশ।
বিশ্বমামা বেশ চটে গিয়ে বললেন, খরগোশ কি একটা দেখার জিনিস? এসেছি চা-গাছ খুঁজতে আর তুই দেখছিস খরগোশ। আগে কখনো খরগোশ দেখিসনি?
আমি বললুম, খাঁচায় দেখেছি। জঙ্গলে দেখিনি।
বিশ্বমামা বললেন, নে। এবার শুধু চা দ্যাখ।
চা-গাছ তো খুব লম্বা হয় না। ঝোপেরই মতন। এখানকার কোনও ঝোপই চা গাছের মতন নয়।
একটু পরে জপ্সল বেশ ঘন হয়ে এল। অনেক বড়-বড় গাছ। হঠাৎ একটা জায়গায় হুড়মুড় শব্দ হতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। বাঘ না ভালুক?
তা নয়, এক দপ্সল বাঁদর। ছোট, বড়, মাঝারি।। এবারেও আমি চেঁচিয়ে কিছু বলে ফেলতে যাচ্ছিলুম। সামলে নিলুম কোনওরকমে। বাঁদর আগে থেকেই দেখেছি ঠিকই, কিন্তু এই বাঁদরগুলো তো জঙ্গলের প্রাণী।
বাঁদরগুলো সব গাছ থেকে নেমে আমাদের সামনে সামনে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ফিরে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। একটা বেশ বড় বাঁদর এমন ভেংচি কাটছে আমার দিকে,তা দেখলেও ভয় লাগে।
বিলু বলল, বিশ্বমামা, একবার শূন্যে গুলি ছুঁড়ব নাকি। তাহলে ওরা সামনে থেকে সরে যাবে।
বিশ্বমামা বললেন, খবরদার না। গুলির আওয়াজে ওরা ভয় পায় না, বরং তেড়ে আসতে পারে। জানিস তো বাঁদররাই আমাদের পূর্বপুরুষ। ওদের অশ্রদ্ধা করতে নেই।
আমি জিগ্যেস করলুম, ওই বাঁদরটা শুধু-শুধু আমার দিকে ভেংচি কাটছে কেন?
বিশ্বমামা বললেন, ওই গোদা বাঁদরটা বোধহয় নিজেকে ভাবছে আমাদের জ্যাঠামশাই! বুঝে গেছে যে তুই অতি দুরন্ত ছেলে, তাই তোকে বকুনি দিচ্ছে।
যদিও নিজের জ্যাঠামশাই বকুনি দিলেও তার মুখের ওপর কিছু বলা যায় না। কিন্তু এই বাঁদরটা তো আর সত্যি-সত্যি আমার নিজের জ্যাঠা নয়, তাই আমিও একবার ওর দিকে ভেংচি কেটে দিলুম।।
একটু পরে বাঁদরগুলো হুপ-হুপ করতে করতে অন্য দিকে চলে গেল। সেদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চা-গাছ দেখতে পাওয়া গেল না। দ্বিতীয় দিনেও কিছু হল না।
শেষ চেষ্টা করার জন্য তৃতীয় দিন আবার এলুম জঙ্গলে। সে রাত্তিরেই আমাদের ফিরে আসতে হবে। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বমামা আবিষ্কার করে ফেললেন একটা চা গাছ।
মস্ত বড় একটা ঝোপের মধ্যে অন্যান্য গাছ আর লতা-পাতা, তার ঠিক মাঝখানের গাছটাই চা-গাছ। এমনিতে বোঝায় উপায় নেই। বিশ্বমামা ঠিক চিনেছেন।
সে গাছের একটা পাতা ছিড়ে নিয়ে হাতে কচলে প্রথমে নিজের নাকের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর আমাদের দিকে হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দ্যাখ তো চায়ের গন্ধ পাস কি না।
সত্যি পাতাটায় একটু-একটু চায়ের গন্ধ। এরপর কাছাকাছি আরও কয়েকটা গাছ পাওয়া গেল।
বিশ্বমামা তার কাঁধের ঝোলা ব্যাগে অনেকগুলো পাতা ছিঁড়ে ভরে নিলেন। বললেন, আর বেশি দরকার নেই। এতেই কাজ হয়ে যাবে।
এবার ফিরলেই হয়। ফেরার পথে ভারি সুন্দর একটা ব্যাপার হল।
আমরা খানিকটা হেঁটে আসতেই একটা বড় গাছের আড়ালে দেখতে পেলুম একটা ময়ূর। পুরো পেখম মেলে আছে। ঠিক ছবির মতন।
বিশ্বমামা বললেন, ইস, কেন যে ক্যামেরা আনিনি। এরকম পেখম মেলা ময়ূর আর জীবনে ক-বার দেখা যায়।
ময়ূর মানুষ দেখে মোটেই লজ্জা পায় না, ভয়ও পায় না। সে সরে গেল না, এ অবস্থায় এক পা এক পা ফেলে হাঁটতে লাগল।
সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বিশ্বমামা হঠাৎ বললেন, আরে। কথাটা তাহলে সত্যি?
আমি বললুম, কী কথা?
বিশ্বমামা বললেন, সবাই বলে, আকাশে মেঘ করলে ময়ূর এরকম পেখম তুলে নাচে। এখন আকাশে মেঘ আছে? দ্যাখ না, পরিষ্কার নীল আকাশ। আরও একটা কারণে ময়ূর নাচে, যখন অপ্সরা ফুল ফোটে। এ ফুল মাত্র একবার ফোটে দু-বছরে। আঙুল দিয়ে বিশ্বমামা দেখালেন, ওই দ্যাখ।
একটা বড় গাছের গা থেকে বেরিয়েছে আর একটা ছোট গাছ, যাকে বলে পরগাছা। সেই পরগাছায় ফুটে আছে একটি মাত্র ফুল। লম্বা ভাটির ওপর গোল মতন ফুল, মাঝখানটা নীল আর পাশের দিকে সাদা। খুব সুন্দর দেখতে। বিশ্বমামা বললেন, এর গন্ধও খুব ভালো। কিন্তু ময়ূরটা না সরে গেলে ফুলের গন্ধ পাওয়া যাবে না। ময়ূরের গায়েও তো গন্ধ থাকে।
বিলু বলল, অপ্সরা ফুল, কখনো নাম শুনিনি।
বিশ্বমামা বললেন, ইংরেজিতে বলে হেভেনস্ মেইডেন। আমি বাংলায় নাম দিয়েছি অপ্সরা ফুল। এ ফুল আমাদের নদীর ধারে খুব দেখা যায়।
ময়ূরটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সরবার নাম নেই। ও কি ফুলটা পাহারা দিচ্ছে?
বিশ্বমামা বললেন, ফুলটা ছোড়দির জন্য নিয়ে যাব ভাবছি। এ ফুল অনেকদিন টাটকা থাকে।
আমি একটু এগিয়ে যেতেই বিশ্বমামা আমার হাত ধরে টেনে বললেন, দাঁড়া, দাঁড়া কাছে যাস না। ময়ূর দেখতে এত সুন্দর হলে কী হবে, খুব হিংস্রও হয়। ধরতে গেলে চোখ খুলে নিতে পারে।
বিলুকে বললেন, রিভলভার দিয়ে একবার আওয়াজ কর তো?
সেই শব্দ শুনেই ময়ূরটা পেখম গুটিয়ে ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দ করে ছুটে পালাবে। বিশ্বমামা খুব সাবধানে ডঁটিশুদ্ধ ফুলটা তুলে আনলেন।
সত্যিই বেশ সুন্দর, মিষ্টি গন্ধ আছে ফুলটার।
বিশ্বমামা বললেন, যাক, এখানে এসে আমার কাজও হল, আর ছোড়দির জন্য একটা উপহারও পাওয়া গেল।
পরদিন সকালে কলকাতায় ফেরার পরও দেখা গেল, ফুলটা একইরকম টাটকা আছে।
বিশ্বমামা ছোটমাসিকে ফোন করে বললেন দুপুর বেলা যাব তোমার বাড়ি,
ভালো-জিনিস রান্না করো, গলদা চিংড়ির মালাইকারী যেন থাকে, আর রাবড়ি। তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস এনেছি।
ছোটমাসি তখনি জিগ্যেস করলেন, কী এনেছিস রে? কী? কী? বিশ্বমামা বললেন, এখন বলব না। দেখতেই তো পাবে। দুপুরবেলা সদলবলে হাজির হলুম ছোটমাসির বাড়িতে।
ছোটমাসি ফুলটা পেয়ে খুবই খুশি। বারবার বলতে লাগলেন, বাঃ কী সুন্দর, কী সুন্দর। এমন ফুল কখনো দেখিনি।
বিশ্বমামা বললেন, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও ডেকে দেখাতে পারো, এ ফুল মাসের পর মাস ফুটবে না। তবে, বাড়িতে এই একটা ফুল রাখলে আর অন্য ফুল মানায় না। ওইসব নকল ফুল-টুলগুলো ফেলে দিতে হবে।
ছোটমেসো বললেন, আরে তা কেন? বেশি ফুল রাখলেই ঘরের শোভা বাড়ে। এটাও থাক, অন্যগুলোও থাক, লোকে বুঝতেই পারবে না, কোনটা আসল, কোনটা নকল।
বিশ্বমামা বললেন, এই অপ্সরা ফুল নিরিবিলিতে থাকতে ভালোবাসে। আশে-পাশে অন্য ফুল ফোটে না। একবার যা একটা ব্যাপার আমি দেখেছি..।
বিশ্বমামা বললেন, থাক, এখন বলব না। পরে তোমরা নিজেরাই দেখতে পাবে।
অপ্সরা ফুলটাকে রাখা হল নকল ফুলের তোড়াটার পাশেই। তারপর অনেকক্ষণ গল্পের পর ডাক এল খেতে বসার।
আজ বিশ্বমামার খাওয়ার কী উৎসাহ। খেয়ে ফেললেন চারখানা বড়-বড় চিংড়ি। চাটনি আর রাবড়ি খাওয়ার পরেও বললেন, আর একটা চিংড়ি দাও তো!
খাওয়া শেষ হলেও বিশ্বমামা গল্প জুড়ে দিলেন। পৃথিবীর কোন দেশে কেমন চিংড়ি পাওয়া যায়। নিকোবর দ্বীপে নাকি এমন চিংড়ি দেখেছেন, তার নাম টাইগার প্রান।
ওপরের খোসাটা বাঘের মতনই হলুদ কালো ডোরা কাটা আর এক-একটা দেড় হাত লম্বা।
গল্প শুনতে-শুনতে আমরা হাত ধুতে ভুলে গেলুম। আমাদের হাতে এঁটো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল।
এক সময় ছোটমাসি বললেন, এবার সবাই উঠে পড়ো। বসবার ঘরে গিয়ে বাকি গল্প হবে।
হাতটাত ধুয়ে আমরা সবাই এসে বসলুম বসবার ঘরে। বিশ্বমামা বললেন, ছোড়দি, মশলা নেই। খুব খাওয়া হয়ে গেছে আজ।
মশলা আনতে গিয়ে ছোটমাসি হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠলেন, এ কী?
এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
সত্যিই অদ্ভুত কাণ্ড।
অপ্সরা ফুলটা যেন হাসিতে ঝলমল করছে। আর তার পাশের নকল ফুলের তোড়াটা শুকিয়ে গেছে, খসে পড়েছে অনেকগুলো পাপড়ি!
বিশ্বমামা বললেন, এটাই তো তখন বলতে যাচ্ছিলাম। আমাজন নদীর ধারে একবার দেখেছিলুম এই কাণ্ড। এ রকম একটা অপ্সরা ফুল ফুটে আছে, আর আশেপাশের অন্য সব ফুলের পাপড়ি ঝরে যাচ্ছে। এ ফুল অন্য ফুলদের সহ্য করতে পারে না।
আমাদের চোখের সামনেই নকল ফুলের সব পাপড়ি খসে পড়ে গেল।
ছোটমেসো দারুণ অবাক হয়ে বললেন, নকল ফুলেরও পাঁপড়ি খসে পড়ে? এরকম কখনো শুনিনি!
বিশ্বমামা বললেন, তা হলেই বুঝুন, আসল আর নকলের তফাত। ছোটমেসো বললেন, কী করে এটা হল, সত্যি করে বলো তো, বিশ্ব! বিশ্বমামা বললেন, ম্যাজিক, ম্যাজিক!
—বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!... একটা ফুটাে শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস...
চামচিকে আর টিকিট চেকার - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
—বুঝলি প্যালা, চামচিকে ভীষণ ডেঞ্জারাস!...
একটা ফুটাে শাল পাতায় করে পটলডাঙার টেনিদা ঘুগনি খাচ্ছিল। শালপাতার তলা দিয়ে হাতে খানিক ঘুগনির রস পড়েছিল, চট করে সেটা চেটে নিয়ে পাতাটা তালগোল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলে ক্যাবলার নাকের ওপর। তারপর আবার বললে, হুঁ হুঁ, ভীষণ ডেঞ্জারাস চামচিকে।
—কী কইর্যা বোঝলা—কও দেখি?—
বিশুদ্ধ ঢাকাই ভাষায় জানতে চাইল হাবুল সেন।
—আচ্ছা, বল চামচিকের ইংরেজি কি?
আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
—বল না!
শেষকালে ভেবে-চিন্তে ক্যাবলা বললে, স্মল ব্যাট। মানে ছােট বাদুড়!
—তোর মুণ্ডু।
—আমি বললাম, তবে ব্যাটলেট। তা-ও নয়? তা হলে? ব্যাটস সান—মানে, বাদুড়ের ছেলে? হল না? আচ্ছা, ব্রিক ব্যাট কাকে বলে?
টেনিদা বললে থাম উল্লুক! ব্রিক ব্যাট হল থান ইট! এবার তাই একটা তোর মাথায় ভাঙব।
হাবুল সেন গভীর মুখে বললে, হইছে।
—কী হল?
—স্কিন মোল।
—স্কিন মোল?...টেনিদা খাঁড়ার মতো নাকটাকে মনুমেন্টের মতো উঁচু করে ধরল, সে আবার কী?
—স্কিন মনে হইল চাম— অর্থাৎ কিনা চামড়া। আর আমাগো দ্যাশে ছুঁচারে কয় চিকা— মোল। দুইটা মিলাইয়া স্কিন মোল।
টেনিদা খেপে গেল : দ্যাখা হাবুল, ইয়ার্কির একটা মাত্রা আছে, বুঝলি? স্কিন মোল। ইঃ—গবেষণার দৌড়টা দেখ একবার।
আমি বললাম, চামচিকের ইংরেজী কী তা নিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছ কেন? ডিক্সনারি দ্যাখো গে!
—ডিক্সনারিতেও নেই। —টেনিদা জয়ের হাসি হাসল।
—তা হলে?
—তা হলে এইটাই প্রমাণ হল চামচিকে কী ভীষণ জিনিস। অর্থাৎ এমন ভয়ানক যে চামচিকাকে সাহেবরাও ভয় পায়! মনে কর না— যারা আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে সিংহ আর গরিলা মারে, যারা যুদ্ধে গিয়ে দমদম বোমা আর কামান ছোড়ে, তারা সুদ্ধ চামচিকের নাম করতে ভয় পায়। আমি নিজের চোখেই সেই ভীষণ ব্যাপারটা দেখেছি।
কী ভীষণ ব্যাপার?—গল্পের গন্ধে আমরা তিনজনে টেনিদাকে চেপে ধরলাম: বলো এক্ষুনি।
—ক্যাবলা, তাহলে চটপট যা। গলির মোড় থেকে আরও দুআনার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়। রসদ না হলে গল্প জমবে না।
ব্যাজার মুখে ক্যাবলা ঘুগনি আনতে গেল। দু’আনার ঘুগনি একাই সবটা চেটেপুটে খেয়ে, মানে আমাদের এক ফোঁটাও ভাগ না দিয়ে, টেনিদা শুরু করলে : তবে শোন—
সেবার পাটনায় গেছি ছোটমামার ওখানে বেড়াতে। ছোটমামা রেলে চাকরি করে— আসার সময় আমাকে বিনা টিকিটেই তুলে দিলে দিল্লি এক্সপ্রেসে। বললে, গাড়িতে চ্যাটার্জি যাচ্ছে ইনচার্জ— আমার বন্ধু। কোনও ভাবনা নেই-সেই-ই তোকে হাওড়া স্টেশনের গেট পর্যন্ত পার করে দেবে!
নিশ্চিন্ত মনে আমি একটা ফাঁকা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়ে লম্বা হয়ে পড়লাম।
শীতের রাত। তার ওপর পশ্চিমের ঠাণ্ডা— হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরায়।
কিন্তু কে জানত— সেদিন হঠাৎ মাঝপথেই চ্যাটার্জির ডিউটি বদলে যাবে। আর তার জায়গায় আসবে—কী নাম ওর— মিস্টার রাইনোসেরাস।
ক্যাবলা বললে, রাইনোসেরাস মানে গণ্ডার।
—থাম, বেশি বিদ্যে ফলাসনি। ...টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, যেন ডিক্সনারি একেবারে। সায়েবের বাপ-মা যদি ছেলের নাম গণ্ডার রাখে— তাতে তোর কী র্যা? তোর নাম যে কিশলয় কুমার না হয়ে ক্যাবলা হয়েছে, তাতে করে কী ক্ষেতি হয়েছে শুনি?
হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও— ছাড়ান দাও। পোলাপান!
—হুঁ, পোলাপান! আবার যদি বকবক করে তো জলপান করে ছাড়ব! যাক— শোন। আমি তো বেশ করে গাড়ির দরজা-জানালা এঁটে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। একে দুখানা - কম্বলে শীত কাটছে না, তার ওপরে আবার খাওয়াটাও হয়ে গেছে বড্ড বেশি। মামাবাড়ির কালিয়ার পাঠাটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে গাড়ির তালে তালে পেটের ভেতর শিং দিয়ে ঢুঁ মারছে। লোভে পড়ে অতটা না খেয়ে ফেলেই চলত।
পেট গরম হয়ে গেলেই লোকে নানা রকম দুঃস্বপ্ন দেখে— জানিস তো? আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, আমার পেটের ভেতরে সেই যে বাতাপি না ইল্বল কে একটা ছিল— সেইটে পাঁঠা হয়ে ঢুকেছে। একটা রাক্ষস হিন্দি করে বলছে : এ ইল্বল— আভি ইসকো পেট ফাটাকে নিকাল আও—
—বাপরে— বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। চোখ চেয়ে দেখি, গাড়ির ভেতরে বাতাপি বা ইম্বল কেউ নেই-— শুধু ফর-ফর করে একটা চামচিকে উড়ছে। একেবারে বোঁ করে আমার মুখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল-নাকটাই খিমচে ধরে আর কি!
এ তো আচ্ছা উৎপাত।
কোন দিক দিয়ে এল কে জানে? চারিদিকে তো দরজা-জানালা সবই বন্ধ। তবে চামচিকের পক্ষে সবই সম্ভব। মানে অসাধ্য কিছু নেই।
একবার ভাবলাম, উঠে। ওটাকে তাড়াই। কিন্তু যা শীত—কম্বল ছেড়ে নড়ে কার সাধ্যি। তা ছাড়া উঠতে গেলে পেট ফুঁড়ে শিং-টিং সুদ্ধু পাঁঠাটাই বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। তারপর আবার যখন সাঁ করে নাকের কাছে এল, তখন বসে পড়ে আর কি। আমার খাড়া নাকটা দেখে মনুমেন্টের ডগাই ভাবল বোধ হয়।
আমি বিচ্ছিরি মুখ করে বললাম, ফর-র-ফুস! —মনে চামচিকেটিকে ভয় দেখলাম। তাইতেই আঁতকে গেল কি না কে জানে— সাঁ করে গিয়ে ঝুলে রইল একটা কোট-হ্যাঙ্গারের সঙ্গে। ঠিক মনে হল, ছােট একটা কালো পুটলি ছুলছে!
এত রাত্তিরে কে আবার জ্বালাতে এল? নিশ্চয় কোনও প্যাসেঞ্জার। প্রথমটায় ভাবলাম, পড়ে থাকি ঘাপটি মেরে। যতক্ষণ খুশি খটখটিয়ে কেটে পড়ুক লোকটা। আমি কম্বলের ভেতরে মুখ ঢোকালাম।
কিন্তু কী একটা যাচ্ছেতাই স্টেশনে যে গাড়িটা থেমেছে কে জানে! সেই যে দাঁড়িয়ে আছে—একদম নট নড়ন-চড়ন! যেন নেমন্তন্ন খেতে বসেছে! ওদিকে দরজায় খটখটানি সমানে চলতে লাগল। ভেঙে ফেলে আর কি!
এমন বেয়াক্কেলে লোক তো কখনও দেখিনি! ট্রেনে কি আর কামরা নেই যে এখানে এসে মাথা খুঁড়ে-মরছে! ভারি রাগ হল। দরজা না খুলেও উপায় নেই— রিজার্ভ গাড়ি তো নয় আর। খুব কড়া গলায় হিন্দীতে একটা গালাগাল দেব মনে করে উঠে পড়লাম।
ক্যাবলা হঠাৎ বাঁধা দিয়ে বললে, তুমি মোটেই হিন্দী জানো না টেনিদা!
—মানে।
—তুমি যা বলে তা একেবারেই হিন্দী হয় না। আমি ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমে ছিলাম—
—চুপ কর বলছি ক্যাবলা!—টেনিদা। হুঙ্কার ছাড়ল ; ফের যদি ভুল ধরতে এসেছিস তো এক চাঁটিতে তোকে চাপাটি বানিয়ে ফেলব! আমার হিন্দী শুনে বাড়ির ঠাকুর পর্যন্ত ছাপরায় পালিয়ে গেল, তা জানিস?
হাবুল বললে, ছাইড়্যা দাও— চ্যাংড়ার কথা কি ধরতে আছে?
—চ্যাংড়া! চিংড়িমাছের মতো ভেজে খেয়ে ফেলব! আমি বললাম, ওটা অখাদ্য জীব— খেলে পেট কামড়াবে, হজম করতে পারবে না। তার চেয়ে গল্পটা বলে যাও।
—হুঁ, শোন! —টেনিদা ক্যাবলার ছ্যাবলামি দমন করে আবার বলে চলল : উঠে দরজা খুলে যেই বলতে গেছি— এই আপ কেইসা আদমি। হ্যায়— সঙ্গে সঙ্গে গাঁক গাঁক করে আওয়াজ!
—গাঁক—গাঁক?
—মানে সায়েব। মানে টিকিট চেকার।
—সেই রাইনোসেরাস? বকুনি খেয়েও ক্যাবলা সামলাতে পারল না।
—আবার কে? একদম খাঁটি সায়েব-পা থেকে মাথা ইস্তক।
সেই যে একরকম সায়েব আছে না? গায়ের রং মোষের মতো কালো, ঘামলে গা দিয়ে কালি বেরোয়— তাদের দেখলে সায়েবের ওপরে ঘেন্না ধরে যায়— মোটেই সে-রকমটি নয়। চুনকাম করা ফর্সা রঙ— হাঁড়ির মতো মুখ, মোটা নাকের ছাঁদায় বড় বড় লালচে লোম— হাসলে মুখ ভর্তি মুলো দেখা যায়, আর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় ষাঁড় ডাকছে— একেবারে সেই জিনিসটি! ঢুকেই চোস্ত ইংরেজীতে আমাকে বললে, এই সন্ধেবেলাতেই এমন করে ঘুমোচ্ছ কেন? এইটেই সবচেয়ে বিচ্ছিরি হ্যাবিট।
—কী রকম চোস্ত ইংরেজী টেনিদা? আমি জানতে চাইলাম।
—সে-সব শুনে কী করবি?...টেনিদা উঁচু দরের হাসি হাসল! শুনেও কিছু বুঝতে পারবি না-সায়েবের ইংরেজী কিনা! সে যাক। সায়েবের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠল রাত বারোটাকে বলছে সন্ধেবেলা। তা হলে ওদের রাত্তির হয়। কখন? সকালে নাকি?
তারপরেই সায়েব বললে, তোমার টিকিট কই?
আমার তো তৈরী জবাব ছিলই। বললাম, আমি পাটনার বাঁড়ুজ্যে মশাইয়ের ভাগনে। আমার কথা ক্রু-ইন-চার্জ চাটুজ্যেকে বলা আছে।
তাই শুনে সায়েবটা এমনি দাঁত খিঁচোল যে, মনে হল মুলোর দোকান খুলে বসেছে। নাকের
লোমের ভেতরে যেন ঝড় উঠল, আর বেরিয়ে এল খানিকটা গর-গরে আওয়াজ!
যা বললে, শুনে তো আমার চোখ চড়ক গাছ।
—তােমার বাড়ুজ্যে মামাকে আমি থোরাই পরোয়া করি! এসব ডাবলুটিরা ও-রকম ঢের মামা পাতায়। তা ছাড়া চাটুজ্যের ডিউটি বদল হয়ে গেছে— আমিই এই ট্রেনের ক্রু-ইন-চার্জ। অতএব চালাকি রেখে পাটনা-টু-হাওড়া সেকেন্ড ক্লাস ফেয়ার আর বাড়তি জরিমানা বের করো।
পকেটে সব সুদ্ধ পাঁচটা টাকা আছে— সেকেন্ড ক্লাস দূরে থাক, থার্ড ক্লাসের ভাড়াও হয় না ; সর্ষের ফুল এর আগে দেখিনি— এবার দেখতে পেলাম! আর আমার গা দিয়ে সেই শীতেও দরদর করে সর্ষের তেল পড়তে লাগল।
আমি বলতে গেলাম, দ্যাখো সায়েব—
সায়েব সায়েব বোলো না—আমার নাম মিস্টার রাইনোসেরাস। আমার গণ্ডারের মতো গোঁ। ভাড়া যদি না দাও— হাওড়ায় নেমে তোমায় পুলিশে দেব। ততক্ষণে আমি গাড়িতে চাবি বন্ধ করে রেখে যাচ্ছি।
—কী বলব জানিস প্যালা— আমি পটলডাঙার টেনিরাম— অমন ঢের সায়েব দেখেছি। ইচ্ছে করলেই সায়েবকে ধরে চলতি গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা বোষ্টুম— জীবহিংসা করতে নেই, তাই অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম।
হাবুল সেন বলে বসল ; জীবহিংসা কর না, তবে পাঁঠা খাও ক্যান?
—আরে পাঠার কথা আলাদা। ওরা হল অবোলা জীব, বামুনের পেটে গেলে স্বর্গে যায়। পাঁঠা খাওয়া মানেই জীবে দয়া করা! সে যাক। কিন্তু সায়েবকে নিয়ে এখন আমি করি কী? এ তো আচ্ছা প্যাঁচ কষে বসেছে! শেষকালে সত্যিই জেলে যেতে না হয়!
কিন্তু ভগবান ভরসা!
পকেট থেকে একটা ছোট খাতা বের করে সায়েব কী লিখতে যাচ্ছিল পেনসিল দিয়ে হঠাৎ সেই শব্দ—ফর-ফর—ফরাৎ!
চামচিকেটা আবার উড়তে শুরু করেছে। আমার মতোই তো বিনাটিকিটের যাত্রী— চেকার দেখে ভয় পেয়েছে নিশ্চয়।
আর সঙ্গে সঙ্গেই সায়েব ভয়ানক চমকে উঠল। বললে, ওটা কী পাখি? জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, চামচিকে— কিন্তু তার আগেই সায়েব হাইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল। নাকের দিকে চামচিকের এত নজর কেন কে জানে— ঠিক সায়েবের নাকেই একটা ঝাপটা মেরে চলে গেল।
ওটা কী পাখি? কী বদখত দেখতে - সায়েব কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল! চুনকাম-করা মুখটা তার ভয়ে পানসে হয়ে গেছে।
আমি বুঝলাম এই মওক! বললাম, তুমি কি ও-পাখি। কখনও দ্যাখোনি?
—নো—নেভার! আমি মাত্ৰ ছমাস আগে আফ্রিকা থেকে ইণ্ডিয়ায় এসেছি। সিংহ দেখেছি— গণ্ডার দেখেছি— কিন্তু—
সায়েব শেষ করতে পারল না। চামচিকেটা আর একবার পাক খেয়ে গেল। একটু হলেই প্রায় খিমচে ধরেছিল সায়েবের মুখ। বোধহয় ভেবেছিল, ওটা চালকুমড়ো।
সায়েব বললে, মিস্টার— ও কি কামড়ায়?
আমি বললাম, মোক্ষম। ভীষণ বিষাক্ত! এক কামড়েই লোক মারা যায়। এক মিনিটের মধ্যেই।
—হােয়াট! —বলে সায়েব লাফিয়ে উঠল। তারপরে আমার কম্বল ধরে টানাটানি করতে লাগল।
—মিস্টার—প্লিজ—ফর গডস সেক— আমাকে একটা কম্বল দাও।
—তারপর আমি ওর কামড়ে মারা যাই আর কি ৷ ও সব চলবে না! —আমি শক্ত করে কম্বল চেপে রইলাম!
—অ্যাঁ? তা হলে!— বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল সায়েব। বোঁ করে একেবারে চেন ধরে ঝুলে পড়ল প্ৰাণপণে। তারপর জানলা খুলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল। : হেলপ—হেলপ—আর খোলা জানলা পেয়েই সাহেবের কাঁধের ওপর দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চামচিকে ভ্যানিস!
সায়েব খানিকক্ষণ। হতভম্ব হয়ে রইল। একটু দম নিয়ে মস্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, যাক— স্যামসিকেটা বাইরে চলে গেছে। এখন আর ভয় নেইকী বলে?
আমি বললাম, না, তা নেই। তবে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দেবার জন্য তৈরি থাকো।
সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেল : কেন?
—বিনা কারণে চেন টেনেছ— গাড়ি থামল বলে! আর শোনো সায়েব— চামচিকে খুব লক্ষ্মী পাখি। কাউকে কামড়ায় না—কাউকে কিছু বলে না। তুমি রেলের কর্মচারী হয়ে চামচিকে দেখে চেন টেনেছ— এ জন্যে তোমার শুধু ফাইন নয়— চাকুরিও যেতে পারে।
ওদিকে গাড়ি আস্তে আস্তে থেমে আসছে তখন। মিস্টার রাইনােসেরাস কেমন মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। ভয়ে এখন প্রায় মিস্টার হেয়ার—মানে খরগোশ হয়ে গেছে।
তারপরই আমার ডান হাত চেপে ধরল দুহাতে। —শোনো মিস্টার, আজ থেকে তুমি আমার বুজুম ফ্রেণ্ড! মানে প্ৰাণের বন্ধু। তোমাকে আমি ফাস্ট ক্লাস সেলুনে নিয়ে যাচ্ছি— দেখবে তোফা ঘুম দেবে। হাওড়ায় নিয়ে গিয়ে কোলনারের ওখানে তোমাকে পেট ভরে খাইয়ে দেব। শুধু গার্ড এলে বলতে হবে, গাড়িতে একটা গুণ্ডা পিস্তল নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আমরা চেন টেনেছি। বলো — রাজি?
রাজি না হয়ে আর কী করি! এত করে অনুরোধ করছে যখন।
বিজয়গর্বে হাসলে টেনিদা : যা ক্যাবলা— আর চার পয়সার পাঁঠার ঘুগনি নিয়ে আয়।
বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন?...
ভজহরি ফিল্ম কপোরেশন - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
বউবাজার দিয়ে আসতে আসতে ভীমনাগের দোকানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে গেল টেনিদা। আর নড়তে চায় না। আমি বললুম, রাস্তার মাঝখানে অমন করে দাঁড়ালে কেন? চলো।
—যেতে হবে? নিতান্তই যেতে হবে? —কাতর দৃষ্টিতে টেনিদা তাকাল আমার দিকে; প্যালা, তোর প্রাণ কি পাষাণে গড়া? ওই দ্যাখ, থরে-থরে সন্দেশ সাজানাে রয়েছে, থালার ওপর সোনালি রঙের রাজভোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে, রসের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটছে রসগোল্লা, পানতো। প্যালা রে—
আমি মাথা নেড়ে বললুম, চালাকি চলবে না। আমার পকেটে তিনটে টাকা আছে, ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ কিনতে হবে। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো এখন—
খিদে পেয়েছে রে! আচ্ছা, দুটো টাকা আমায় ধার দে, বিকেলে না হয় ছোটমামার জন্যে মকরধ্বজ—
কিন্তু ও সব কথায় ভােলবার বান্দা প্যালারাম বাড়ুজ্যে নয়। টেনিদাকে টাকা ধার দিলে সে-টাকাটা আদায় করতে পারে এমন খলিফা লোক দুনিয়ায় জন্মায়নি। পকেটটা শক্ত করে ঢেকে ধরে আমি বললুম, খাবারের দোকান চোখে পড়লেই তোমার পেট চাঁই-চাঁই করে ওঠে— ওতে আমার সিমপ্যাথি নেই। তা ছাড়া, এ-বেলা মকরধ্বজ না নিয়ে গেলে আমার ছেঁড়া কানটা সেলাই করে দেবে কে? তুমি?
রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টেনিদা। —ব্রাহ্মণকে সক্কিলবেলা দাগ দিলি প্যালা— মরে তুই নরকে যাবি।
—যাই তো যাব। কিন্তু ছোটমামার কানমলা যে নরকের চাইতে ঢের মারাত্মক সেটা জানা আছে আমার। আর, কী আমার ব্ৰাহ্মণ রে! দেলখোসা রেস্তোরাঁয় বসে আস্ত-আস্ত মুরগির ঠ্যাং চিবুতে তোমায় যেন দেখিনি আমি!
—উঃ! সংসারটাই মরীচিকা-ভীমানাগের দোকানের দিকে তাকিয়ে শেষবার দৃষ্টিভোজন করে নিলে টেনিদা; নাঃ, বড়লোক না হলে আর সুখ নেই।
বিকেলে চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে সেই কথাই হচ্ছিল। ক্যাবলা গেছে কাকার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে, হাবুল সেন গেছে দাঁত তুলতে। কাজেই আছি আমরা দুজন। মনের দুঃখে দুঠোঙা তেলেভাজা খেয়ে ফেলেছে টেনিদা। অবশ্য পয়সাটা আমিই দিয়েছি। এবং আধখানা আলুর চাপ ছাড়া আর কিছুই আমার বরাতে জোটেনি।
আমার পাঞ্জাবি আস্তিনটা টেনে নিয়ে টেনিদা মুখটা মুছে ফেলল। তারপর বললে, বুঝলি প্যালা, বড়লোক না হলে সত্যিই আর চলছে না।
—বেশ তো হয়ে যাও-না। বড়লোক— আমি উৎসাহ দিলুম।
—হয়ে যাও-না! —বড়লোক হওয়াটা একেবারে মুখের কথা কিনা! টাকা দেবে কে, শুনি? তুই দিবি?— টেনিদা ভেংচি কাটল। আমি মাথা নেড়ে জানালুম, না আমি দেব না।
—তবে?
—লটারির টিকিট কেনো। — আমি উপদেশ দিলুম।
—ধ্যাত্তোর লটারির টিকিট! কিনে-কিনে হয়রান হয়ে গেলুম, একটা ফুটো পয়সাও যদি জুটত কোনও বার! লাভের মধ্যে টিকিটের জন্যে বাজারের পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লুম, বড়দা দুটো অ্যায়সা থাপ্পড় কষিয়ে দিলে। ওতে হবে না—বুঝলি? বিজনেস করতে হবে।
—বিজনেস!
—আলবাত বিজনেস। —টেনিদার মুখ সংকল্পে কঠোর হয়ে উঠল; ওই যে কী বলে, হিতোপদেশে লেখা আছে না, বাণিজ্যে বসতে ইয়ে— মানে লক্ষ্মী! ব্যবসা ছাড়া পথ নেই— বুঝেছিস?
—তা তো বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তো টাকা চাই।
—এমন বিজনেস করবে। যে নিজের একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব পরস্মৈপদী— মানে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে।
—সে আবার কী বিজনেস?—আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলুম।
—হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি? –চোখ কুঁচকে মিটমিটি হাসতে লাগল টেনিদা; বলতে পারলি না তো? ও—সব কি তোর মতো নিরেট মগজের কাজ? এমনি একটা মাথা চাই, বুঝলি?
সগৌরবে টেনিদা নিজের ব্ৰহ্মতালুতে দুটো টোকা দিলে।
—কেন অযথা ছলনা করছ? বলেই ফেলো না— আমি কাতর হয়ে জানতে চাইলুম।
টেনিদা একবার চারদিকে তাকিয়ে ভালো বরে দেখে নিলে, তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ফিলিম কোম্পানি!
অ্যাঁ! —আমি লাফিয়ে উঠলাম।
—গাধার মতো চ্যাঁচাসনি— টেনিদা ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল; সব প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। তুই গল্প লিখবি— আমি ডাইরেকট —মানে পরিচালনা করব। দেখবি, চারিদিকে হইহই পড়ে যাবে।
—ফিলিমের কী জানো তুমি? আমি জানতে চাইলুম।
—কেইবা জানে? —টেনিদা তাচ্ছিল্যভরা একটা মুখ ভঙ্গি করলে; সবাই সমান— সকলের মগজেই গোবর। তিনটে মারামারি, আটটা গান আর গোটা কতক ঘরবাড়ি দেখালেই ফিলিম হয়ে যায়। টালিগঞ্জে গিয়ে আমি শুটিং দেখে এসেছি তো।
—কিন্তু তবুও—
—ধ্যাৎ, তুই একটা গাড়ল। —টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, সত্যি-সত্যিই কি আর ছবি তুলব আমরা! ও-সব ঝামেলার মধ্যে কে যাবে!
—তা হলে?
—শেয়ার বিক্রি করব। বেশ কিছু শেয়ার বিক্রি করতে পারলে— বুঝলি তো? —টেনিদা চোখ টিপল; দ্বারিক, ভীমনাগ, দেলখোস, কে. সি. দাস—
এইবার আমার নোলায় জল এসে গেল। চুক চুক করে বললুম— থাক, থাক আর বলতে হবে না।
পরদিন গোটা পাড়াটাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল।
“দি ভজহরি ফিলিম কর্পোরেশন”
আসিতেছে-আসিতেছে
রোমাঞ্চকর বাণীচিত্র
“বিভীষিকা”!
পরিচালনা : ভজহরি মুখোপাধ্যায়। (টেনিদা)
কাহিনী : প্যালারাম বন্দ্যোপাধ্যায়
তার নীচে ছোট ছোট হরফে লেখা:
সর্বসাধারণকে কোম্পানির শেয়ার কিনিবার জন্য অনুরোধ জানানো হইতেছে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য মাত্র আট আনা। একত্রে তিনটি শেয়ার কিনিলে মাত্র এক টাকা।
এর পরে একটা হাত এঁকে লিখে দেওয়া হয়েছে; বিশেষ দ্রষ্টব্য— শেয়ার কিনিলে প্রত্যেককেই বইতে অভিনয়ের চান্স দেওয়া হইবে। এমন সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। মাত্ৰ অল্প শেয়ার আছে, এখন না কিনিলে পরে পস্তাইতে হইবে। সন্ধান করুন— ১৮ নং পটলডাঙা স্ট্রিট, কলিকাতা।
আর, বিজ্ঞাপনের ফল যে কত প্ৰত্যক্ষ হতে পারে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতেনাতে তার প্রমাণ মিলে গেল। এমন প্ৰমাণ মিলল যে প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি। অত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা আমরা আশা করিনি। টেনিদাদের এত বড় বাড়িটা। একেবারে খালি, বাড়িসুদ্ধ সবাই গেছে দেওঘরে, হাওয়া বদলাতে। টেনিদার ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে, তাই একা রয়ে গেছে বাড়িতে, আর আছে চাকর বিষ্ট। তাই দিব্যি আরাম করে বসে আমরা তেতলার ঘরে রেডিয়ো শুনছি আর পাঁঠার ঘুগনি খাচ্ছি। এমন সময় বিষ্ট খবর নিয়ে এল মূর্তিমান একটি ভগ্নদূতের মতো।
বিষ্টুর বাড়ি চাটগাঁয়। হাঁইমাই করে নাকি সুরে কী যে বলে ভালো বোঝা যায় না। তবু যেটুকু বোঝা গেল, শুনে আমরা আঁত়্কে উঠলুম। গলায় পাঁঠার ঘুগনি বেঁধে গিয়ে মস্ত একটা বিষম খেল টেনিদা।
বিষ্টু জানাল : আঁড়িত ডাঁহাইত হইড়ছে (বাড়িতে ডাকাত পড়েছে)।
বলে কী ব্যাটা! পাগল না পেট খারাপ! ম্যাড়া না মিরগেল! এই ভর দুপুর বেলায় একেবারে কলকাতার বুকের ভেতরে ডাকাত পড়বে কী রকম।
বিষ্টু বিবৰ্ণ মুখে জানাল : নীচে হাঁসি দেইক্যা যান (নীচে এসে দেখে যান)। —
আমি ভেবেছিলাম খাটের তলাটা নিরাপদ কিনা, কিন্তু টেনিদা এমন এক বাঘা হাঁকার ছাড়লে যে আমার পালাজ্বরের পিলেটা দস্তুর মতো হকচকিয়ে উঠল।
—কাপুরুষ! চলে আয় দেখি— একটা বোম্বাই ঘুষি হাঁকিয়ে ডাকাতের নাক ন্যাবড়া করে দি!— আমি নিতান্ত গোবেচারা প্যালারাম বাড়ুজ্যে, শিংমাছের ঝোল খেয়ে প্ৰাণটাকে কোনওমতে ধরে রেখেছি, ওসব ডাকাত-ফাকাতের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। বেশ তো ছিলাম, এসব ভজঘট ব্যাপার কেন রে বাবা। আমি বলতে চেষ্টা করলুম, এই—এই মানে, আমার কেমন পেট কামড়াচ্ছে—
—পেট কামড়াচ্ছে! টেনিদা গর্জন করে উঠল : পাঁঠার ঘুগনি সাবাড় করার সময় তো সে কথা মনে ছিল না দেখছি। চলে আয় প্যালা, নইলে তোকেই আগে—
কথাটা টেনিদা শেষ করল না, কিন্তু তার বক্তব্য বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। “জয় মা দুর্গা”—কাঁপতে-কাঁপতে আমি টেনিদাকে অনুসরণ করলুম।
কিন্তু না— ডাকাত পড়েনি। পটলডাঙার মুখ থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত “কিউ!”
কে নেই সেই কিউতে? স্কুলের ছেলে, মোড়ের বিড়িওয়ালা, পাড়ার ঠিকে ঝি, উড়ে ঠাকুর, এমন কি যমদূতের মত দেখতে এক জোড়া ভীম-দৰ্শন কাবুলিওয়ালা।
আমরা সামনে এসে দাঁড়াতেই গগনভেদী কোলাহল উঠল।
—আমি শেয়ার কিনব—
—এই নিন মশাই আট আনা পয়সা—
ঝি বলল, ওগো বাছারা, আমি এক ট্যাকা এনেছি। আমাদের তিনখানা শেয়ার দাও— আর একটা হিরোইনের চান্স দিয়ো—
পাশের বোর্ডিংটার উড়ে ঠাকুর বললে, আমিও আষ্টো গণ্ডা পয়সা আনুচি—
সকলের গলা ছাপিয়ে কাবুলিওয়ালা রুদ্র কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়ল : এঃ বাব্বু, এক এক রূপায়া লায়া, হামকো ভি চান্স চাহিয়ে—
তারপরেই সমস্বরে চিৎকার উঠল; চান্স-চান্স। চিৎকারের চোখে আমার মাথা ঘুরে গেল— দুহাতে কান চেপে আমি বসে পড়লুম।
আশ্চৰ্য, টেনিদা দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল একেবারে শান্ত, স্তব্ধ বুদ্ধদেবের মতো। শুধু তাই নয়, এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত একটা দাঁতের ঝলক বয়ে গেল তার— মানে হাসল।
তারপর বললে, হবে, হবে, সকলেরই হবে,—বরাভয়ের মতো একখানা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, প্রত্যেককেই চান্স দেওয়া হবে। এখন চাঁদেরা আগে সুড়সুড়ি করে পয়সা বের করো দেখি। খবরদার, অচল আধুলি চালিয়ো না,—তাহলে কিন্তু—
—জয় হিন্দ--জয় হিন্দ—
ভিড়টা কেটে গেলে টেনিদা দু হাত তুলে নাচতে শুরু করে দিলে। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধই চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল।
আমি বললুম, আহা-হা— কিন্তু টেনিদা উঠে পড়েছে ততক্ষণে। আমার কাঁধের ওপর এমন একটা অতিকায় থাবড়া বসিয়ে দিলে যে, আমি আর্তনাদ করে উঠলুম।
—ওরে প্যালা, আজ দুঃখের দিন নয় রে, বড় আনন্দের দিন। মার দিয়া কেল্লা! ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ, চাচার হােটেল, দেলখোস-আঃ!
যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আমিও বললুম, আঃ!
—মায় গুনে দেখি—এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত আবার হাসির কলকা উলসে রোজগার নেহাত মন্দ হয়নি। গুনে দেখি, ছব্বিশ টাকা বারো আনা।
—বারো আনা? —টেনিদা ভ্রূকুটি করলে, বারো আনা কী করে হয়? আট আনা এক টাকা করে হলে— উহুঁ! নিশ্চয় ডামাডোলের মধ্যে কোনও ব্যাটা চার গণ্ডা পয়সা ফাঁকি দিয়েছে— কী বলিস?
আমি মাথা নেড়ে জানালুম, আমারও তাই মনে হয়। —উঃ—দুনিয়ায় সবই জোচ্চোর। একটাও কি ভালো লোক থাকতে নেইরে? দিলো সক্কালবেলাটায় বামুনের চার চার আনা পয়সা ঠকিয়ে। —টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : যাক, এতেও নেহাত মন্দ হবে না। দেলখোস, ভীমনাগ, দ্বারিক ঘোষ—
আমি তার সঙ্গে জুড়ে দিলুম, চাচার হােটেল, কে সি দাস—
টেনিদা বললে, ইত্যাদি— ইত্যাদি। কিন্তু শোন প্যালা, একটা কথা আগেই বলে রাখি। প্ল্যানটা আগাগোড়াই আমার। অতএব বাবা সোজা হিসেব— চৌদ্দ আনা—দু আনা।
আমি আপত্তি করে বললুম, অ্যাঁ, তা কী করে হয়?
টেনিদা সজোরে টেবিলে একটা কিল মেরে গর্জন করে উঠল, হুঁ, তাই হয়! আর তা যদি না হয়, তাহলে তোকে সোজা দোতালার জানালা গলিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়, সেটাই কি তবে ভালো হয়?
আমি কান চুলকে জানালুম, না সেটা ভালো হয় না!
—তবে চল— গোটা কয়েক মোগলাই পরোটা আর কয়েক ডিশ ফাউল কারি খেয়ে ভজহরি ফিলম কপোরেশনের মহরত করে আসি—
টেনিদা ঘর-ফাটানো একটা পৈশাচিক অট্টহাসি করে উঠল। হাসির শব্দে ভেতর থেকে ছুটে এল বিষ্টু। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললে, ছটো বাবুর মাথা হাঁড়াপ। (খারাপ) অইচে!——
কিন্তু—দিন কয়েক বেশ কেটে গেল। দ্বারিকের রাজভোগ আর চাচার কাটলেট খেয়ে শরীরটাকে দস্তুরমতো ভালো করে ফেলেছি দুজনে। কে. সি. দাসের রসমালাই খেতে খেতে দুজনে ভাবছি— আবার নতুন কোনও একটা প্ল্যান করা যায় কি না, এমন সময়—
দোরগোড়ায় যেন বাজ ডেকে উঠল। সেই যমদূতের মতো একজোড়া কাবুলিওয়ালা। অতিকায় জাব্বা-জোব্বা আর কালো চাপদাড়ির ভেতর দিয়ে যেন জিঘাংসা ফুটে বেরোচ্ছে।
আমরা ফিরে তাকাতেই লাঠি ঠুকল : এঃ বাব্বু— রূপেয়া কাঁহা—হামলোগ গা চান্স কিধর?
—অ্যাঁঃ! —টেনিদার হাত থেকে রসমালাইটা বুক-পকেটের ভেতর পড়ে গেল : প্যালা রে, সেরেছে!
—সারবেই তো! —আমি বললুম, তবে আমার সুবিধে আছে। চৌদ্দ আনা দু আনা। চৌদ্দ আনা ঠ্যাঙনি তোমার, মানে স্রেফ ছাতু করে দেবে। দু, আনা খেয়ে আমি বাঁচলেও বেঁচে যেতে পারি।
কাবুলিওয়ালা আবার হাঁকল :—এঃ ভজহরি বাব্বু— বাহার তো আও— বাহার আও—মানেই নিমতলা যাও! টেনিদা এক লাফে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা আমাকে বগলদাবা করে পাশের দরজা দিয়ে অন্যদিকে।
—ওগো ভালো মানুষের বাছারা, আমার ট্যাকা। কই, চান্স কই? ঝি হাতে আঁশবটি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
—আমারো চান্সো মিলিবো কি না?—উড়ে ঠাকুর ভাত রাঁধবার খুন্তিটাকে হিংস্রভাবে আন্দোলিত করল।
—জোচ্চুরি পেয়েছেন স্যার—আমরা শ্যামবাজারের ছেলে— আস্তিন গুটিয়ে একদল ছেলে তাড়া করে এল।
এক মুহুর্তে আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন ঘুরতে লাগল। তারপরেই —‘করেঙ্গে ইয়া মারেঙ্গে!’ আমাকে কাঁধে তুলে টেনিদা একটা লাফ মারল। তারপর আমার আর ভালো করে জ্ঞান রইল না। শুধু টের পেলুম, চারিদিকে একটা পৈশাচিক কোলাহল; চোট্টা—চোট্টা—ভাগ যাতা—আর বুঝতে পারলুম— যেন পাঞ্জাব মেলে চড়ে উড়ে চলেছি।
ধপাৎ করে মাটিতে পড়তেই আমি হিউমাউ করে উঠলুম। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, হাওড়া স্টেশন। রেলের একটা ইঞ্জিনের মতোই হাঁপাচ্ছে টেনিদা।
বললে, হুঁ হুঁ বাবা, পাঁচশো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন— আমাকে ধরবে ওই ব্যাটারা! যা প্যালা- পকেটে এখনও বারো টাকা চার আনা রয়েছে, ঝট করে দুখানা দেওঘরের টিকিট কিনে আন। দিল্লি এক্সপ্রেস এখুনি ছেড়ে দেবে।
অ- অ+ টেনিদা। অসম্ভব গম্ভীর । আমরা তিনজনও যতটা পারি গভীর হওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাবলার মুখে একটা চুয়িং গাম ছিল, সেটা সে ঠেলে দিয়...
প্রভাতসঙ্গীত - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
টেনিদা। অসম্ভব গম্ভীর । আমরা তিনজনও যতটা পারি গভীর হওয়ার চেষ্টা করছি। ক্যাবলার মুখে একটা চুয়িং গাম ছিল, সেটা সে ঠেলে দিয়েছে গালের একপাশে—যেন একটা মার্বেল গালে পুরে রেখেছে। এই রকম মনে হচ্ছে। পটলডাঙার মোড়ে তেলেভাজার দোকান থেকে আলুর চপ আর বেগুনী ভাজার গন্ধ আসছে, তাইতে মধ্যে-মধ্যে উদাস হয়ে যাচ্ছে হাবুল সেন। কিন্তু আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত সিরিয়াস-তেলেভাজার এমন প্রাণকাড়া গন্ধেও টেনিদা কিছুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না ।
খানিক পরে টেনিদা বলল, পাড়ার লোকগুলো কী—বলদিকি ?
আমি বললুম, অত্যন্ত বোগাস।
খাঁড়ার মতো নাকটাকে আরও খানিক খাড়া করে টেনিদা বললে, পয়সা তো অনেকেরই আছে। মোটরওলা বাবুও তো আছেন ক’জন । তবু আমাদের একসারসাইজ ক্লাবকে চাঁদা দেবে না ?
না—দিব না।—হাবুল সেন মাথা নেড়ে বললে, কয়—একসারসাইজ কইর্যা কী হইব ? গুণ্ডা হইব কেবল !
হ, গুণ্ডা হইব !—টেনিদা হাবুলকে ভেংচে বললে, শরীর ভালো করবার নাম হল গুণ্ডাবাজি ! অথচ বিসর্জনের লরিতে যারা ভুতুড়ে নাচ নাচে, বাঁদরামো করে, তাদের চাঁদা দেবার বেলায় তো পয়সা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসে। প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে—
বাধা দিয়ে বললুম, আবার আমাকে কেন ?
ইউ শাটাপ । —টেনিদা বাঘাটে হুংকার ছাড়ল : ‘আমার কথার ভেতরে কুরুবকের মতো—খুব বিচ্ছিরি একটা বকের মতো বকবক করবি না—সে-কথা বলে দিচ্ছি তোকে । প্যালার মতো রোগা টিকটিকি না হয়ে পাড়ার ছেলেগুলো দুটাে ডাম্বেল-মুগুর ভাঁজুক, ডন দিক—এই তো আমরা চেয়েছিলুম। শরীর ভালো হবে, মনে জোর আসবে, অন্যায়ের সামনে রুখে দাঁড়াবে, বড় কাজ করতে পারবে। তার নাম গুণ্ডাবাজি ! অথচ দ্যাখ—দু-চারজন ছাড়া কেউ একটা পয়সা ঠেকাল না। আমরা নিজেরা চাঁদা-টাদা দিয়ে দু-একটা ডাম্বেল-টাম্বেল কিনেছি, কিন্তু চেস্ট একসপ্যান্ডার, বারবেল—ৎ
ক্যাবলা আবার চুয়িং গামটা চিবােতে আরম্ভ করল। ভরাট মুখে বললে, কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।
হাবুল মাথা নাড়ল : দিব না। ক্লাব তুইলা দাও টেনিদা।
‘তুলে দেব ? কভি নেহি—’ টেনিদার সারা মুখে মোগলাই পরোটার মতো একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরুল : চাঁদা তুলবই । ইউ প্যালা ৷
আঁতকে উঠে বললুম, অ্যাঁ?
আমাদের নিয়ে তো খুব উষ্টুম-ধুষ্টুম গপ্পো বানাতে পারিস, কাগজে ছাপাটাপাও হয়। একটা বুদ্ধি টুদ্ধি বের করতে পারিস নে ?
মাথা চুলকে বললুম, আমি—আমি—
‘হাঁ-হাঁ, তুই-তুই।’—টেনিদা কটাং করে আমার চাঁদিতে এমন গাঁটা মারল যে ঘিলুটিলু সব নড়ে উঠল এক সঙ্গে। আমি কেবল বললুম, ক্যাঁক ৷
ক্যাবলা বললে, ও-রকম গােটা মারলে তো বুদ্ধি বেরুবে না, বরং তালগোল পাকিয়ে যাবে সমস্ত । এখন ক্যাঁক বলছে, এর পরে ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক বলতে থাকবে আর ফস করে কামড়ে দেবে কাউকে ।
গাঁট্টার ব্যথা ভুলে আমি চটে গেলুম।
ঘ্যাঁক করে কামড়াব কেন ? আমি কি কুকুর ?
টেনিদা বললে, ইউ শাটাপ-অকর্মার ধাড়ি ।
হাবুল বললে, চুপ কইর্যা থাক প্যালা—আর একখান গাঁট্টা খাইলে ম্যাও-ম্যাও কইর্যা বিলাইয়ের মতন ডাকতে আরম্ভ করবি । অরে ছাইড়া দাও টেনিদা । আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আসছে।
টেনিদা ভীষণ উৎসাহ পেয়ে ঢাকাই ভাষা নকল করে ফেলল : কইয়্যা ফ্যালাও ৷
গানের পার্টি ? মানে—সেই যে চাঁদা দাও গো পুরবাসী ? আর শালু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব?’—টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, ‘আহা-হা, কী একখানা বুদ্ধিই বের করলেন । লোকে সেয়ানা হয়ে গেছে, ওতে, আর চিড়ে ভেজে ? সারা দিন ঘুরে হয়তো পাওয়া যাবে বত্ৰিশটা নয়া পয়সা আর দু:খানা ছেড়া কাপড়। দুদ্দুর!
ক্যাবলা টকাৎ করে চুয়িং গামটাকে আবার গালের একপাশে ঠেলে দিলে।
টেনিদা—দি আইডিয়া ।
আমরা সবাই একসঙ্গে ক্যাবলার দিকে তাকালুম। আমাদের দলে সেই-ই সব চেয়ে ছোট আর লেখাপড়ায় সবার সেরা— হায়ার সেকেন্ডারিতে ন্যাশনাল স্কলার । খবরের কাগজে কুশলকুমার মিত্রের ছবি বেরিয়েছিল স্ট্যান্ড করবার পরে, তোমরা তো সে-ছবি দেখেছি। সেই ই ক্যাবলা ।
ক্যাবলা ছোট হলেও আমাদের চার মূর্তির দলে সেই-ই সবচেয়ে জ্ঞানী, চশমা নেবার পরে তাকে আরও ভারিক্কি দেখায়। তাই ক্যাবলা কিছু বললে আমরা সবাই-ই মন দিয়ে তার কথা শুনি ।
ক্যাবলা বললে, আমরা শেষ রাত্ৰে-মানে এই ভোরের আগে বেরুতে পারি সবাই।
‘শেষ রাত্তিরে!’—হাবুল হাঁ করে রইল : শেষ রাত্তিরে ক্যান ? চুরি করুম নাকি আমরা ?
‘চুপ কর না হাবলা—’ ক্যাবলা বিরক্ত হয়ে বললে, ‘আগে ফিনিশ করতে দে আমাকে । আমি দেখেছি, ভোরবেলায় ছোট-ছোট দল কীর্তন গাইতে বেরোয় । লোকে রাগ করে না, সকালবেলায় ভগবানের নাম শুনে খুশি হয়। পয়সাটয়সাও দেয় নিশ্চয় ।
টেনিদা বললে, হুঁ, রাত্তিরে ঘুমিয়ে টুমিয়ে ভোরবেলায় লোকের মন খুশিই থাকে। তারপর যেই বাজারে কুমড়ো-কাঁচকলা আর চিংড়ি মাছ কিনতে গেল, অমনি মেজাজ খারাপ । আর অফিস থেকে ফেরবার পরে তো-ইরে বাবাস ।
আমি বললুম, মেজদা যেই হাসপাতাল থেকে আসে—অমনি সক্কলকে ধরে ইনজেকশন দিতে চায় ৷
হাবুল বললে, তর মেজদা যদি পাড়ার বড় লোকগুলারে ধইরা তাগো পুটুস-পুটুস কইর্যা ইনজেকশন দিতে পারত—
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল ; ‘অর্ডার-অর্ডার, ভীষণ গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু ক্যাবলার আইডিয়াটা আমার বেশ মনে ধরেছে—মানে যাকে বলে সাইকোলজিক্যাল। সকালে লোকের মন খুশি থাকে—ইয়ে যাকে বলে বেশ পবিত্র থাকে, তখন এক-আধটা বেশ ভক্তিভরা গান-টান শুনলে কিছু না-কিছু দেবেই। রাইট । লেগে পড়া যাক তা হলে ৷
আমি বললুম, কিন্তু জিমন্যাস্টিক ক্লাবের জন্যে আমরা হরিসংকীর্তন গাইব ?
ক্যাবলা বললে, হরি-সংকীর্তন কেন ? তুই তো একটু-আধটু লিখতে পারিস, একটা গান লিখে ফ্যাল। ভীম, হনুমান—এইসব বীরদের নিয়ে বেশ জোরালো গান।
আমি—
‘হাঁ, তুই, তুই।’ —টেনিদা আবার গাঁট্টা তুলল : মাথার ঘিলুটা আর একবার নড়িয়ে দিই, তা হলেই একেবারে আকাশবাণীর মতো গান বেরুতে থাকবে ।
আমি এক লাফে নেমে পড়লুম। চাটুজ্যেদের রোয়াক থেকে ।
বেশ, লিখব গান। কিন্তু সুর দেবে কে ?
টেনিদা বললে, আরে সুরের ভাবনা কী—একটা কেত্তন-ফেক্তন লাগিয়ে দিলেই হল।
‘আর গাইব কেডা?’ হাবুলের প্রশ্ন শোনা গেল : আমাগো গলায় তো ভাউয়া ব্যাংয়ের মতন আওয়াজ বাইর অইব ।
‘হ্যাং ইয়োর ভাউয়া ব্যাং।’ —টেনিদা বললে, ‘এ-সব গান আবার জানতে হয় নাকি ?’ গাইলেই হল । কেবল আমাদের থান্ডার ক্লাবের গোলকিপার পাঁচুগোপালকে একটু যোগাড় করতে হবে, ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারে—গাইতেও পারে-মানে আমাদের লিড করবে।
হাবুল বললে,“আমাগো বাড়িতে একটা কর্তাল আছে, লইয়া আসুম।
ক্যাবলা বললে, আমাদের ঠাকুর দেশে গেছে, তার একটা ঢোল আছে। সেটা আনতে পারি ।
‘গ্র্যান্ড !’—টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ‘ওটা আমিই বাজাব এখন। দেন এভরিথিং ইজ কমপ্লিট । শুধু গান বাকি। প্যালা-হাফ অ্যান আওয়ার টাইম । দৌড়ে চলে যা—গান লিখে নিয়ে আয় । এর মধ্যে আমরা একটু তেলেভাজা খেয়েনি ৷
মাথা চুলকে আমি বললুম, আমিও দুটাে তেলেভাজা খেয়ে গান লিখতে যাই না কেন? মানে—দু-একটা আলুর চপ-টপ খেলে বেশ ভাব আসত।
আর আলুর চাপ খেয়ে কাজ নেই। যা-বাড়ি যা—কুইক । আধা ঘণ্টার মধ্যে গান লিখে না আনলে ভাব কী করে বেরোয় আমি দেখব। কুইক—কুইক—
টেনিদা রোয়াক থেকে নেমে পড়তে যাচ্ছিল। অগত্যা আমি ছুট লাগালুম। কুইক নয়—কুইকেস্ট যাকে বলে।
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান
করিবেন তোমাদের তিনি বলবান ।
ও গাে—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম
সেই হয় মহাবীর—নানা গুণধাম ।
জাগো রে নগরবাসী—ডন দাও, ভাঁজো রে ডামবেল,
খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেলহ
ও রে সকলে বীর, হও ভীম, হাও হনুমান,
জাগিবে ভারত এতে করি অনুমান।
ক্যাবলা গান শুনে বললে, আবার অনুমান করতে গেলি কেন? লেখ-জাগিবে ভারত এতে পাইবে প্ৰমাণ ।
টেনিদা বললে, রাইট । কারেকটি সাজেসশন ৷
হাবুল বললে, কিন্তু মানুষরে হনুমান হইতে কইবা? চেইত্যা যাইব না ?
টেনিদা বললে, চটবে কেন? পশ্চিমে হনুমানজীর কত কদর। জয় হনুমান বলেই তো কুস্তি করতে নামে। হনুমান সিং—হনুমানপ্ৰসাদ, এ-রকম কত নাম হয় ওদের। হনুমান কি চাড্ডিখানা কথা রে । এক লাফে সাগর পেরুলেন, লঙ্কা পোড়ালেন, গন্ধমাদন টেনে আনলেন, রাবণের রথের চুড়োটা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে দিলেন—এক দাঁতের জোরটাই ভেবে দ্যাখ একবার।
‘তবে কিনা—খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল—’চুয়িং গাম খেতে খেতে ক্যাবলা বললে, এই লাইনটা ঠিক—
আমি বললুম, বারে, গানে রস থাকবে না? কলা-আম-জামে কত রস বল দিকি? আর দুটাে-চারটে ভালো জিনিস খাওয়ার আশা না থাকলে লোকে খামকা ডামবেল-বারবেল ভাঁজতেই বা যাবে কেন ? লোভও তো দেখাতে হয় একটু ৷
‘ইয়া!’—টেনিদা ভীষণ খুশি হল : ‘এতক্ষণে প্যালার মাথা খুলেছে। এই গান গেয়েই আমরা কাল ভোররাত্তিরে পাড়ায় কীর্তন গাইতে বেরুব । ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—
আমরা তিনজন চেচিয়ে উঠলুম। :“ইয়াক—ইয়াক ?
এবং পরদিন ভোরে—
শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে কাক ডাকবার আগে, ঝাড়ুদার বেরুনাের আগে প্রথম ট্রাম দেখা না দিতেই—
জাগো রে নগরবাসী, ভজো হনুমান—
আগে-আগে গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে পাঁচুগোপাল। তার পেছনে ঢোল নিয়ে টেনিদা, টেনিদার পাশে কর্তাল হাতে ক্যাবলা। থার্ড লাইনে আমি আর হাবুল সেন। টেনিদা বলে দিয়েছে, তোদের দুজনের গলা একেবারে দাঁড়কাকের মতো বিচ্ছিরি, কোনও সুর নেই, তোরা থাক ব্যাক-লাইনে ।
আহা—টেনিদা যেন গানের গন্ধৰ্ব্ব । একদিন কী মনে করে যেন সন্ধ্যাবেলায় গড়ের মাঠে সুর ধরেছিল—‘আজি দখিন দুয়ার খোলা এসো হে, এসো হে, এসো হে।’ কিন্তু আসবে কে ? জন তিনেক লোক অন্ধকারে ঘাসের ওপর শুয়েছিল, দু লাইন শুনেই তারা তড়াক তড়াক করে উঠে বসিল, তারপর তৃতীয় লাইন ধরতেই দুড়দুড় করে টেনে দৌড় এসপ্ল্যানেডের দিকে—যেন ভূতে তাড়া করেছে!
আমি বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার গলায় তো মা সরস্বতীর রাজহাঁস ডাকে—
কিন্তু হাবুল আমায় থামিয়ে দিলে বললে, চুপ মাইর্যা থাক। ভালোই হইল, তর আমার গাইতে হইব না। অরা তিনটায় গাঁ-গাঁ কইর্যা চ্যাঁচাইব, তুই আর আমি পিছন থিক্য অ্যাঁ-অ্যাঁ করুম।
সুতরাং রাস্তায় বেরিয়েই পাঁচুর হারমোনিয়ামের প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ, টেনদিার দুমদাম ঢোল আর ক্যাবলার ঝমাঝম কর্তাল। তারপরেই বেরুল সেই বাঘা কীর্তন:
“ওগো—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম—”
পাঁচুর পিনপিনে গলা, টেনিদার গগনভেদী চিৎকার, ক্যাবলার ক্যাঁ-ক্যাঁ আওয়াজ, হাবুলের সর্দি-বসা স্বর আর সেই সঙ্গে আমার কোকিল-খাওয়া রব । কোরাস তো দূরে থাক—পাঁচটা গলা পাঁচটা গোলার মতো দিগ্বিদিকে ছুটিল ;
“জাগো রে নগরবাসী, ডন দাও-ভাঁজো রে ডামবেল—”
ঘোঁয়াক ঘোঁয়াক করে আওয়াজ হলো, দুটো কুকুর সারা রাত চেঁচিয়ে কেবল একটু ঘুমিয়েছে—তারা বাঁইবাঁই করে ছুটল। গড়ের মাঠের লোকগুলো তো তবু এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত দৌড়েছিল, এরা ডায়মন্ড হারবারের আগে গিয়ে থামবে বলে মনে হল না ।
এবং তৎক্ষণাৎ—
দড়াম করে খুলে গেল ঘোষেদের বাড়ির দরজা। বেরুলেন সেই মোটা গিন্নী—যাঁর চিৎকারে পাড়ায় কাক-চিল পড়তে পায় না।
আমাদের কোরাস থেমে গেল তাঁর একটি সিংহগর্জনে ।
কী হচ্ছে অ্যাঁ ! এই লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা টেনি-কী আরম্ভ করেছিস এই মাঝরাত্তিরে ?
অত বড় লিডার টেনিদাও পিছিয়ে গেল তিন পা !
মানে মাসিমা—মানে ইয়ে এই—ইয়ে—একসারসাইজ ক্লাবের জন্য চাঁদা—
চাঁদা ! অমন মড়া-পোড়ানো গান গেয়ে—পাড়াসুদ্ধ লোকের পিলে কাঁপিয়ে মাঝরাত্তিরে চাঁদা? দূর হ এখেন থেকে ভূতের দল, নইলে পুলিশ ডাকব এক্ষুনি ।
দড়াম করে দরজা বন্ধ হল পরক্ষণেই । কীর্তন-পার্টি শোকসভার মতো স্তব্ধ একেবারে ! হাবুল করুণ স্বরে বলল,“হইব না টেনিদা। এই গানে কারও হৃদয় গলব না মনে হইত্যাছে ৷
হবে না মানে ?—টেনিদা পান্তুয়ার মতো মুখ করে বললে, হতেই হবে। লোকের মন নরম করে তবে ছাড়ব ।
কিন্তু ঘোষমসিমা তো আরও শক্ত হয়ে গেলেন —আমাকে জানাতে হল ।
উনি তো কেবল চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে পারেন, জিমন্যাস্টিকের কী বুঝবেন। অলরাইট—নেকসট হাউস। গজকেষ্টবাবুর বাড়ি ।
আবার পদযাত্ৰা । আর সম্মিলিত রাগিণী ;
“খাও রে পরান ভরি ছোলা-কলা-আম-জাম-বেল—
হও রে সকলে বীর, হাও ভীম, হাও হনুমান—”
পাঁচু, টেনিদা, ক্যাবলা তেড়ে কেবল ‘হও হনুমান’ পর্যন্ত গেয়েছে, আমি আর হাবলা ‘আম’ পর্যন্ত বলে সুর মিলিয়েছি, অমনি গজকেষ্ট হালদারের দোতালার ঝুলবারান্দা থেকে—
না, চাঁদ নয় ! প্রথমে একটা ফুলের টব, তার পরেই একটা কুঁজো । মেঘনাদকে দেখা গেল না, কিন্তু টবটা আর একটু হলেই আমার মাথায় পড়ত, আর কুঁজোটা একেবারে টেনিদার মৈনাকের মতো নাকের পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গেল ।
আমি চেঁচিয়ে বললুম, টেনিদা—গাইডেড মিশাইল।
বলতে-বলতেই আকাশ থেকে নেমে এল প্ৰকাণ্ড এক হুলো বেড়াল-পড়ল পাঁচুর হারমোনিয়ামের ওপর। খ্যাঁচ-ম্যাচ করে এক বিকট আওয়াজ— হারমোনিয়ামসুদ্ধ পাঁচু একেবারে চিৎ—আর ক্যাঁচ-ক্যাঁচাঙ বলে বেড়ালটা পাশের গলিতে উধাও !
ততক্ষণে আমরা উর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছি। প্রায় হ্যারিসন রোড পর্যন্ত দৌড়ে থামতে হল আমাদের। পাঁচু কাঁদো-কাঁদো গলায় বললে, টেনিদা, এনাফ। এবার আমি বাড়ি যাব ৷
হাবুল বললে, হ, নাইলে মারা পোড়বা সক্কলে । অখন কুজা ফ্যালাইছে, এইবারে সিন্দুক ফ্যালাইব । অখন বিলাই ছুইর্যা মারছে, এরপর ছাত থিক্য গোরু ফ্যালাইব ।
টেনিদা বললে, শাট আপ—ছাতে কখনও গোরু থাকে না ।
না থাকুক গোরু—ফিক্যা মারতে দোষ কী । আমি অখন যাই গিয়া । হিস্ট্রি পড়তে হইব ।
এঃ—হিস্ট্রি পড়বেন !—টেনিদা বিকট ভেংচি কাটল : ‘ইদিকে তো আটটার আগে কোনওদিন ঘুম ভাঙে না। খবদার হাবলা—পালানো চলবে না। আর একটা চানস নেব । এত ভালো গান লিখেছে প্যালা, এত দরদ দিয়ে গাইছি আমরা—জয় হনুমান আর বীর ভীমসেন মুখ তুলে চাইবেন না ? এবং মহৎ কাজ করতে যাচ্ছি। আমরা—কিছু চাঁদা জুটিয়ে দেবেন না তাঁরা? ট্রাই—ট্রাই এগেন । মন্ত্রের সাধন কিংবা—ধর, পাঁচু—
পাঁচুগোপাল কাঁউমাউ করতে লাগল। : ‘একসকিউজ মি টেনিদা। পেল্লায় হুলো বেড়াল, আর একটু হলেই নাক-ফাক অাঁচড়ে নিত আমার । আমি বাড়ি যাব।
বাড়ি যাবেন?—টেনিদা আবার একটা যাচ্ছেতাই ভেংচি কাটল : ‘মামাবাড়ির আবদার পেয়েছিস, না ? টেক কেয়ার পেঁচো- ঠিক এক মিনিট সময় দিচ্ছি। যদি গান না ধরিস, এক থাপ্পড়ে তোর কান—
ক্যাবলা বললে, কানপুরে চলে যাবে।
আমি হাবুলের কানে-কানে বললুম, লোকে আমাদের এর পরে ঠেঙিয়ে মারবে, হাবলা । কী করা যায় বল তো ?
তুই গান লেইখ্যা ওস্তাদি করতে গেলি ক্যান ?
সংকীর্তন গাইবার বুদ্ধি তো তুই-ই দিয়েছিলি ৷
হাবুল কী বলতে যাচ্ছিল, আবার প্যাঁ-প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বেজে উঠল পাঁচুর । এবং :
“জাগো রে নগরবাসী-ভজো হনুমান—”
ঢোলক-করতালের আওয়াজে আবার চারদিকে ভূমিকম্প শুরু হল। আর পাঁচটি গলার স্বরে সেই অনবদ্য সংগীতচর্চা ;
“করিবেন তোমাদের তিনি বলবান—
কোনও সাড়াশব্দ নেই কোথাও। কুঁজো নয়, বেড়াল নয়, গাল নয়, কিছু নয়। সামনে কন্ট্রাকটার বিধুবাবুর নতুন তেতলা বাড়ি নিথর ।
আমাদের গান চলতে লাগল। :
“ওগো—সকালে বিকালে যেবা করে ভীমনাম—”
‘ডামবেল’ পর্যন্ত যেই এসেছে, দড়াম করে দরজা খুলে গেল আবার । গায়ে একটা কোট চড়িয়ে, একটা সুটকেস হাতে প্রায় নাচতে-নাচতে বেরুলেন বাড়ির মালিক বিধুবাবু।
আমি আর হাবলা টেনে দৌড় লাগাবার তালে আছি, আঁক করে পাঁচুর গান থেমে গেছে, টেনিদার হাত থমকে গেছে ঢোলের ওপর। বিধুবাবু আমাদের মাথায় সুটকেস ছুড়ে মারবেন। কিনা বোঝবার আগেই—
ভদ্রলোক টেনিদাকে এসে জাপটে ধরলেন সুটকেসসুদ্ধ। নাচতে লাগলেন তারপর ।
বাঁচালে টেনিরাম, আমায় বাঁচালে । অ্যালার্ম ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, তোমাদের ডাকাত-পড়া গান কানে না এলে ঘুম ভাঙত না ; পাঁচটা সাতের গাড়ি ধরতে পারতুম না-দেড় লাখ টাকার কন্ট্রাকটিই হাতছাড়া হয়ে যেত। কী চাই তোমাদের বলো । শেষ রাতে তিনশো শেয়ালের কান্না কেন জুড়ে দিয়েছ। বলো—আমি তোমাদের খুশি করে দেব।
‘শেয়ালের কান্না না স্যার—শেয়ালের কান্না না !’—বিধুবাবুর সঙ্গে নাচতে-নাচতে তালে-তালে টেনিদা বলে যেতে লাগল। : ‘একসারসাইজ ক্লাব-ডামবেল-বারবেল কিনব-অন্তত পঞ্চাশটা টাকা দরকার—’
বেলা ন’টা। রবিবারের ছুটির দিন। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আছি আমরা। পাঁচুগোপালও গেস্ট হিসেবে হাজির আছে আজকে ।
মেজাজ আমাদের ভীষণ ভালো । পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছেন বিধুবাবু। সামনের মাসে আরও পঞ্চাশ টাকা দেবেন কথা দিয়েছেন ।
নিজের পয়সা খরচ করে টেনিদা আমাদের আইসক্রিম খাওয়াচ্ছিল। আইসক্রিম শেষ করে, কাগজের গেলাসটাকে চাটতে-চাটিতে বলল, তবে যে বলেছিলি হনুমান আর ভীমের নামে কাজ হয় না ? হুঁ হুঁ—কলিকাল হলে কী হয়, দেবতার একটা মহিমে আছে না ?
পাঁচু বললে, আর হুলো বেড়ালটা যদি আমার ঘাড়ে পড়ত—
আমি বললুম, আর ফুলের টব যদি আমার মাথায় পড়ত—
হাবুল বললে, কুঁজাখান যদি দিমাস কইর্যা তোমার নাকে লাগত—
টেনিদা বললে, হ্যাং ইয়ের হুলো বেড়াল, ফুলের টব, কুঁজো ! ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস—?
আমরা চেঁচিয়ে বললু, ইয়াক ইয়াক।
অ- অ+ আমি সগর্বে ঘোষণা করলাম, জনিস, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে। ক্যাবলা একটা গুলতি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা নেড়ী কুকুরের ল্য...
কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
আমি সগর্বে ঘোষণা করলাম, জনিস, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।
ক্যাবলা একটা গুলতি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা নেড়ী কুকুরের ল্যাজকে তাক করছিল। কুকুরটা বেশ বসে ছিল, হঠাৎ কী মনে করে ঘোঁক শব্দে পিঠের একটা এঁটুলিকে কামড়ে দিলে—তারপর পাঁই-পাঁই করে ছুট লাগল। ক্যাবলা ব্যাজার হয়ে বললে, দ্যুৎ! কতক্ষণ ধরে টার্গেট করছি—ব্যাটা পালিয়ে গেল!—আমার দিকে ফিরে বললে, তোর ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে—এ আর বেশি কথা কী! আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, রাঙা কাকা সবাই দাঁত বাঁধিয়েছে। আচ্ছা, কাকারা সকলে দাঁত বাঁধায় কেন বল তো? এর মানে কী?
হাবুল সেন বললে, হঃ! এইটা বোঝোস নাই। কাকাগো কামই হইল দাঁত খিঁচানি। অত দাঁত খিঁচালে দাঁত খারাপ হইব না তো কী?
টেনিদা বসে বসে এক মনে একটা দেশলাইয়ের কাঠি চিবুচ্ছিল। টেনিদার ওই একটা অভ্যেস—কিছুতেই মুখ বন্ধ রাখতে পারে না। একটা কিছু না-কিছু তার চিবোনো চাই-ই চাই। রসগোল্লা, কাটলেট, ডালমুট, পকৌড়ি, কাজু বাদাম—কোনওটায় অরুচি নেই। যখন কিছু জোটে না, তখন চুয়িংগাম থেকে শুকনো কাঠি—যা পায় তাই চিবোয়। একবার ট্রেনে যেতে যেতে মনের ভুলে পাশের ভদ্রলোকের লম্বা দাড়ির ডগাটা খানিক চিবিয়ে দিয়েছিল—সে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড! ভদ্রলোক রেগে গিয়ে টেনিদাকে ছাগল-টাগল কী সব যেন বলেছিলেন।
হঠাৎ কাঠি চিবুনো বন্ধ করে টেনিদা বললে, দাঁতের কথা কী হচ্ছিল র্যা? কী বলছিলি দাঁত নিয়ে?
আমি বললাম, আমার ছোট কাকা দাঁত বাঁধিয়েছে।
ক্যাবলা বললে, ইস-ভারি একটা খবর শোনাচ্ছেন ঢাকঢোল বাজিয়ে! আমার বড় কাকা, মেজ কাকা, ফুলু মাসি—
টেনিদা বাধা দিয়ে বললে, থাম থাম বেশি ফ্যাচ-ফ্যাচ করিসনি। দাঁত বাঁধানোর কী জানিস তোরা? হুঁঃ! জানে বটে আমার কুট্টিমামা গজগোবিন্দ হালদার। সায়েবরা তাকে আদর করে ডাকে মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে। সে-ও দাঁত বাঁধিয়েছিল। কিন্তু সে-দাঁত এখন আর তার মুখে নেই—আছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে!
—পড়ে গেছে বুঝি?
—পড়েই গেছে বটে!—টেনিদা তার খাঁড়ার মতো নাকটাকে খাড়া করে একটা উঁচুদরের হাসি হাসল—যাকে বাংলায় বলে হাই ক্লাস। তারপর বললে, সে-দাঁত কেড়ে নিয়ে গেছে।
—দাঁত কেড়ে নিয়েছে? সে আবার কী? আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, এত জিনিস থাকতে দাঁত কাড়তে যাবে কেন?
কেন? টেনিদা আবার হাসল: দরকার থাকলেই কাড়ে। কে নিয়েছে বল দেখি?
ক্যাবলা অনেক ভেবে-চিন্তে বললে, যার দাঁত নেই।
—ইঃ, কী পণ্ডিত! টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, দিলে বলে! অত সোজা নয়, বুঝলি? আমার কুট্টিমামার দাঁত যে-সে নয়-সে এক একটা মুলোর মতো। সে-বাঘা দাঁতকে বাগানো যার-তার কাজ নয়।
—তবে বাগাইল কেডা? বাঘে? হাবুলের জিজ্ঞাসা।
—এঃ, বাঘে! বলছি দাঁড়া। ক্যাবলা, তার আগে দু আনার ডালমুট নিয়ে আয়—
হাঁড়ির মতো মুখ করে ক্যাবলা ডালমুট আনতে গেল। মানে, যেতেই হল তাকে।
আমাদের জুলজুলে চোখের সামনে একাই ডালমুটের ঠোঙা সাবাড় করে টেনিদা বললে, আমার কুট্টিমামার কথা মনে আছে তো? সেই যে চা-বাগানে চাকরি করে আর একই দশজনের মতো খেয়ে সাবাড় করে? আরে, সেই লোকটা-যে ভালুকের নাক পুড়িয়ে দিয়েছিল?
আমরা সমস্বরে বললাম, বিলক্ষণ! ‘কুট্টিমামার হাতের কাজ’ কি এত সহজেই ভোলবার?
টেনিদা বললে, সেই কুট্টিমামারই গল্প। জানিস তো—সায়েবরা ডেকে নিয়ে মামাকে চা-বাগানে চাকরি দিয়েছিল? মামা খাসা আছে সেখানে। খায়-দায় কাঁসি বাজায়। কিন্তু বেশি সুখ কি আর কপালে সয় রে? একদিন জুত করে একটা বন-মুরগির রোস্টে যেই কামড় বসিয়েছে—অমনি ঝন-ঝনাৎ! কুট্টিমামার একটা দাঁত পড়ল প্লেটের ওপর খসে আর তিনটে গেল নড়ে।
হয়েছিল কী, জনিস? শিকার করে আনা হয়েছিল তো বন-মুরগি? মাংসের মধ্যে ছিল গোটাচারেক ছররা। বেকায়দায় কামড় পড়তেই অ্যাকসিডেন্ট, দাঁতের বারোটা বেজে গেল।
মাংস রইল মাথায়—ঝাড়া তিন ঘন্টা নাচানাচি করলে কুট্টিমামা। কখনও কেঁদে বললে, পিসিমা গো তুমি কোথায় গেলে? কখনও কঁকিয়ে ককিয়ে বললে, ইঁ-হি-হি-আমি গেলুম! আবার কখনও দাপিয়ে দাপিয়ে বললে, ওরে বনমুরগি রে—তোর মনে এই ছিল রে! শেষকালে তুই আমায় এমন করে পথে বসিয়ে গেলি রে।
পাকা তিন দিন কুট্টিমামা কিচ্ছুটি চিবুতে পারল না। শুধু রোজ সের-পাঁচেক করে খাঁটি দুধ আর ডজন-চারেক কমলালেবুর রস খেয়ে কোনওমতে পিত্তি রক্ষা করতে লাগল।
দাঁতের ব্যথা-ট্যথা একটু কমলে সায়েবরা কুট্টিমামাকে বললে, তোমাকে ডেনটিস্টের ওখানে যেতে হবে।
—অ্যাঁ।
সায়েবরা বললে, দাঁত বাঁধিয়ে আসতে হবে।
ডেনটিস্টের নাম শুনেই তো কুট্টিমামার চোখ তালগাছে চড়ে গেল। কুট্টিমামার দাদু নাকি একবার দাঁত তুলতে গিয়েছিলেন। যে-ডাক্তার দাঁত তুলেছিলেন, তিনি চোখে কম দেখতেন। ডাক্তার করলেন কী—দাঁত ভেবে কুট্টিমামার দাদুর নাকে সাঁড়াশি আটকে দিয়ে সেটাকেই টানতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন : ইস—কী প্ৰকাণ্ড গজদন্ত আর কী ভীষণ শক্ত! কিছুতেই নাড়াতে পারছি না!
কুট্টিমামার দাদু, তো হাঁই-মাই করে বলতে লাগলেন, ওঁটা—ওঁটা আমার আঁক। আঁক!—টানের চোটে নাক বেরুচ্ছিল না—“অাঁক৷ ”
ডাক্তার রেগে বললেন, আর হাঁক-ডাক করতে হবে না—খুব হয়েছে। আরও গোটাকয়েক টান-ফান দিয়ে নাকটাকে যখন কিছুতেই কায়দা করতে পারলেন না—তখন বিরক্ত হয়ে বললেন : নাঃ, হল না। এমন বিচ্ছিরি শক্ত দাঁত আমি কখনও দেখিনি! এ-রকম দাঁত কোনও ভদ্রলোক তুলতে পারে না।
কুট্টিমামার দাদু বাড়ি ফিরে এসে বারো দিন নাকের ব্যথায় বিছানায় শুয়ে রইলেন। তেরো দিনের দিন উকিল ডাকিয়ে উইল করলেন : “আমার পুত্র বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যে-কেহ দাঁত বাঁধাইতে যাইবে, তাহাকে আমার সমস্ত সম্পত্তি হইতে চিরতরে বঞ্চিত করিব। ”
অবশ্যি কুট্টিমামার দাদুর সম্পত্তিতে কুট্টিমামার কোনও রাইট নেই—তবু দাদুর আদেশ তো! কুট্টিমামা গাঁই-ঁগুই করতে লাগলেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ‘মাই নোজ’-টোজও বলবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সায়েবের গোঁ-জনিস তো? ঝড়াং করে বলে দিলে, নো ফোকলা দাঁত উইল ডু! দাঁত বাঁধাতেই হবে।
কুট্টিমামা তো মনে মনে “তনয়ে তারো তারিণী” বলে রামপ্রসাদী গান গাইতে গাইতে, বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে ডেনটিস্টের কাছে হাজির। ডেনটিস্ট প্রথমেই তাঁকে একটা চেয়ারে বসালে। তারপর দাঁতের ওপরে খুর খুর করে একটা ইলেকট্ৰিক বুরুশ বসিয়ে সেগুলোকে অর্ধেক ক্ষয় করে দিলে। একটা ছােট হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে বাকি সবকটা দাঁতকে নড়িয়ে ফেললে। শেষে বেজায় খুশি হয়ে বললে, এর দু-পাটি দাঁতই খারাপ। সব তুলে ফেলতে হবে।
শুনেই কুট্টিমামা প্রায় অজ্ঞান। গোটা-তিনেক খাবি খেয়ে বললেন, নাকটাও?
ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন, চোপরাও!
তারপর আর কী? একটা পোল্লায় সাঁড়াশি নিয়ে ডাক্তার কুরুৎ-কুরুৎ করে কুট্টিমামার সবকটা দাঁত তুলে দিলে। কুট্টিমামা আয়নায় নিজের মূর্তি দেখে কেঁদে ফেললেন। কিছুটি নেই মুখের ভেতর—একদম গাঁয়ের পেছল রাস্তার মতো-মাঝে মাঝে গর্ত। ওঁকে ঠিক বাড়ির বুড়ি ধাই রামধনিয়ার মত দেখাচ্ছিল।
কুট্টিমামা কেঁদে ফ্যাক ফ্যাক করে বললেন, ওগো আমার কী হল গো—
ডাক্তার আবার ধমক দিয়ে বললে, চোপরাও! সাত দিন পরে এসো-বাঁধানো দাঁত পাবে।
বাঁধানো দাঁত নিয়ে কুট্টিমামা ফিরলেন। দেখতে শুনতে দাঁতগুলো নেহাত খারাপ নয়। খাওয়াও যায় একরকম। খালি একটা অসুবিধে হত। খাওয়ার অর্ধেক জিনিস জমে থাকত দাঁতের গোড়ায়। পরে আবার সেগুলোকে জাবর কাটতে হত।
তবু ওই দাঁত নিয়েই দুঃখে সুখে কুট্টিমামার দিন কাটছিল। কিন্তু সায়েবদের কাণ্ড জনিস তো? ওদের সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়—কিছুতেই তিনটে দিন বসে থাকতে পারে না। একদিন বললে, মিস্টার গাঁজা-গাবিণ্ডে, আমরা বাঘ শিকার করতে যাব। তোমাকেও যেতে হবে। আমাদের সঙ্গে।
বাঘ-টাঘের ব্যাপার কুট্টিমামার তেমন পছন্দ হয় না। কারণ বাঘ হরিণ নয়—তাকে খাওয়া যায় না, বরং সে উলটে খেতে আসে। কুট্টিমামা খেতে ভালোবাসে, কিন্তু কুট্টিমামাকেই কেউ খেতে ভালোবাসে—এ-কথা ভাবলে তাঁর মন ব্যাজার হয়ে যায়। বাঘগুলো যেন কী! গায়ে যেমন বিটকেল গন্ধ, স্বভাব-চরিত্তিরও তেমনি যাচ্ছেতাই।
কুট্টিমামা কান চুলকে বললে, বাঘ স্যার—ভেরি ব্যাড স্যার—আই নট লাইক স্যার—
কিন্তু সায়েবরা সে-কথা শুনলে তো! গোঁ যখন ধরেছে তখন গেলই। আর কুট্টিমামাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলে গেল।
গিয়ে ডুয়ার্সের জঙ্গলে এক ফরেস্ট বাংলোয় উঠল।
চারদিকে ধুন্ধুমার বন। দেখলেই পিত্তি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। রাত্তিরে হাতির ডাক শোনা যায়—বাঘ হুম হাম করতে থাকে। গাছের ওপর থেকে টুপটুপ করে জোঁক পড়ে গায়ে। বানর এসে খামোকা ভেংচি কাটে। সকালে কুট্টিমামা দাড়ি কামাচ্ছিলেন। —একটা বানর এসে ‘ইলিক চিলিক’ এইসব বলে তাঁর বুরুশটা নিয়ে গেল! আর সে কী মশা! দিন নেই—রাত্তির নেই-সমানে কামড়াচ্ছে। কামড়ানোও যাকে বলে! দু-তিন ঘন্টার মধ্যেই হাতে পায়ে মুখে যেন চাষ করে ফেললে।
তার মধ্যে আবার সায়েবগুলো মোটর গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকল বাঘ মারতে |
—মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, তুমিও চলো।
কুট্টিমামা তক্ষুনি বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুড়তে আরম্ভ করে দিলে। চােখ দুটােকে আলুর মতো বড় বড় করে, মুখে গ্যাঁজলা তুলে বলতে লাগল : বেলি পেইন স্যা—-পেটে ব্যথা স্যার—অবস্থা সিরিয়াস স্যার—
দেখে সায়েবরা ঘোঁয়া-ঘোঁয়া—ঘ্যাঁয়োৎ-ঘ্যাঁয়োৎ করে বেশ খানিকটা হাসল। —ইউ গাঁজা-গাবিন্ডে, ভেরি নটি—বলে একজন কুট্টিমামার পেটে একটা চিমটি কাটলে—তারপর বন্দুক কাঁধে ফেলে শিকারে চলে গেল।
আর যেই সায়েবরা চলে যাওয়া—অমনি তাড়াক করে উঠে বসলেন কুট্টিমামা। তক্ষুনি এক ডজন কলা, দুটাে পাউরুটি আর এক শিশি পেয়ারার জেলি খেয়ে, শরীর-টরির ভালো করে ফেললেন।
বাংলোর পাশেই একটা ছোট পাহাড়ি ঝরনা। সেখানে একটা শিমুল গাছ। কুট্টিমামা একখানা পেল্লায় কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে সেখানে এসে বসলেন।
চারদিকে পাখি-টাখি ডাকছিল। পেটটা ভরা ছিল, মিঠে মিঠে হাওয়া দিচ্ছিল—কুট্টিমামা খুশি হয়ে মহাভারতের সেই জায়গাটা পড়তে আরম্ভ করলেন—যেখানে ভীম বকরাক্ষসের খাবার-দাবারগুলো সব খেয়ে নিচ্ছে।
পড়তে পড়তে ভাবের আবেগে কুট্টিমামার চোখে জল এসেছে, এমন সময় গর্র—গর্র—
কুট্টিমামা চোখ তুলে তাকাতেই ;
কী সর্বনাশ! ঝরনার ওপারে বাঘ! কী
রূপ বাহার! দেখলেই পিলে-টিলে উলটে যায়। হাঁড়ির মতো প্ৰকাণ্ড মাথা, আগুনের ভাঁটার মতো চোখ, হলদের ওপরে কালো কালো ডোরা, অজগরের মতো বিশাল ল্যাজ। মন্ত হাঁ করে, মুলোর মতো দাঁত বের করে আবার বললে, গর—র—র
একেই বলে বরাত! যে-বাঘের ভয়ে কুট্টিমামা শিকারে গেল না, সে-বাঘ নিজে থেকেই দোরগোড়ায় হাজির। আর কেউ হলে তক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যেত, আর বাঘ তাকে সারিডন ট্যাবলেটের মতো টপং করে গিলে ফেলত। কিন্তু আমারই মামা তো—ভাঙে তবু মাচকায় না। তক্ষুনি মহাভারত বগলদাবা করে এক লাফে একেবারে শিমুল গাছের মগডালে।
বাঘ এসে গাছের নীচে থাবা পেতে বসল। দু-চারবার থাবা দিয়ে গাছের গুড়ি আঁচড়ায়, আর ওপর তাকিয়ে ডাকে : ঘর-র ঘুঁ-ঘুঁ। বোধহয় বলতে চায়—তুমি তো দেখছি পয়লা নম্বরের ঘুঘু!
কিন্তু বাঘটা তখনও ঘুঘুই দেখেছে—ফাঁদ দেখেনি। দেখল একটু পরেই। কিছুক্ষণ পরে বাঘটা রেগে যেই ঝাঁক করে একটা হাঁক দিয়েছে—অমনি দারুণ চমকে উঠেছে কুটিমামা, আর বগল থেকে কালীসিঙ্গির সেই জগঝস্প মহাভারত ধপাস করে নিচে পড়েছে। আর পড়বি তো পড় সোজা বাঘের মুখে। সেই মহাভারতের ওজন কমসে কম পাক্কা বারো সের—তার ঘায়ে মানুষ খুন হয়—বাঘও তার ঘা খেয়ে উলটে পড়ে গেল। তারপর গোঁ-গোঁ-ঘেয়াং ঘেয়াং বলে বার-কয়েক ডেকেই—এক লাফে ঝরনা পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাওয়া!
কুট্টিমামা আরও আধা ঘন্টা গাছের ডালের বসে ঠিক-ঠক করে কাঁপল। তারপর নীচে নেমে দেখল মহাভারত ঠিক তেমনি পড়ে আছে— তার গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। আর তার চারপাশে ছড়ানো আছে। কেবল দাঁত—“বাঘের দাঁত। একেবারে গোনা-গুনতি বত্ৰিশটা দাঁত—মহাভারতের ঘায়ে একটি দাঁতও আর বাঘের থাকেনি। দাঁতগুলো কুড়িয়ে নিয়ে, মহাভারতকে মাথায় ঠেকিয়ে, কুট্টিমামা এক দৌড়ে বাংলোতে। তারপর সায়েবরা ফিরে আসতেই কুটিমামা সেগুলো তাদের দেখিয়ে বললে, টাইগার টুথ।
ব্যাপার দেখে সায়েবরা তো থ!
তাই তো—বাঘের দাঁতই বটে? পেলে কোথায়?
কুট্টিমামা ডাঁট দেখিয়ে বুক চিতিয়ে বললে, আই গো টু ঝরনা। টাইগার কাম। আই ডু বকসিং—মানে ঘুষি মারলাম। অল টুথ ব্রেক। টাইগার কাট ডাউন—মানে বাঘ কেটে পড়ল।
সায়েবরা বিশ্বাস করল কি না কে জানে, কিন্তু কুট্টিমামার ভীষণ খাতির বেড়ে গেল। রিয়্যালি গাঁজা-গাবিন্ডে ইজ এ হিরো! দেখতে কাঁকলাসের মতো হলে কী হয়—হি ইজ এ গ্রেট হিরো! সেদিন খাওয়ার টেবিলে একখানা আস্ত হরিণের ঠ্যাং মেরে দিলেন কুট্টিমামা।
পরদিন আবার সায়েবরা শিকারে যাওয়ার সময় ওকে ধরে টানাটানি ; আজ তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে! ইউ আর এ বিগ পালোয়ান!
মহা ফ্যাসােদ! শেষকালে কুট্টিমামা অনেক করে বোঝালেন, বাঘের সঙ্গে বাকসিং করে ওঁর গায়ে খুব ব্যথা হয়েছে। আজকের দিনটাও থাক।
সায়েবরা শুনে ভেবেচিন্তে বললে, অল রাইট—অল রাইট।
আজকে কুট্টিমামা হুঁশিয়ার হয়ে গেছেন— বাংলোর বাইরে আর বেরুলেনই না। বাংলোর বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে আবার সেই কালীসিঙ্গির মহাভারত নিয়ে বসলেন।
—ঘেঁয়াও-—ঘুঁঙ—
কুট্টিমামািআঁতকে উঠলেন। বাংলোর সামনে তারের বেড়া—তার ওপারে সেই বাঘ। কেমন যেন জোড়হাত করে বসেছে। কুট্টিমামার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বললে, ঘেয়াং—কই! আর হাঁ করে মুখটা দেখল! ঠিক সেই রকম। দাঁতগুলো তোলবার পরে কুট্টিমামার মুখের যে-চেহারা হয়েছিল, অবিকল তা-ই! একেবারে পরিষ্কার—একটা দাঁত নাই! নির্ঘাত রামধনিয়ার মুখ।
বাঘাটা হুবহু কান্নার সুরে বললে—ঘ্যাং-ঘ্যাং—ভ্যাঁও! ভাবটা এই দাঁতগুলো তো সব গেল দাদা! আমার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ! এখন কী করি?
কিন্তু তার আগেই এক লাফে কুট্টিমামা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন। বাঘাটা আরও কিছুক্ষণ ঘ্যাং-ঘ্যাং-ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কেঁদে বনের মধ্যে চলে গেল।
পরদিন সকালে কুট্টিমামা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, বাঁধানো দাঁতের পাটি দুটো খুলে নিয়ে, বেশ করে মাজছিলেন। দিব্যি সকালের রোদ উঠেছে—সায়েবগুলো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে তখনও, আর কুট্টিমামা দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ফ্যাক-ফ্যাক গলায় গান গাইছিলেন : “এমন চাঁদের আলো, মারি যদি সে-ও ভালো—
সকাল বেলায় চাঁদের আলোয় গান গাইতে গাইতে কুট্টিমামার বোধহয় আর কোনও দিকে খেয়ালই ছিল না। ওদিকে সেই ফোকলা বাঘ এসে জানলার বাইরে বসে রয়েছে ঝোপের ভেতরে। কুট্টিমামার দাঁত খোলা-বুরুশ দিয়ে মাজা—সব দেখছে এক মনে। মাজা-টাজা শেষ করে যেই কুট্টিমামা দাঁত দুপাটি মুখে পুরতে যাবেন—অমনি ; ঘোঁয়াৎ ঘালুম!
অর্থাৎ তোফা—এই তো পেলুম!
জানলা দিয়ে এক লাফে বাঘ ঘরের মধ্যে।
—টা-টাইগার—পর্যন্ত বলেই কুট্টিমামা ফ্ল্যাট!
বাঘ কিন্তু কিছুই করল না। টপাৎ করে কুট্টিমামার দাঁত দু-পাটি নিজের মুখে পুরে নিল—কুট্টিমামা তখনও অজ্ঞান হননি—জ্বলজ্বল করে দেখতে লাগলেন, সেই দাঁত বাঘের মুখে বেশ ফিট করেছে। দাঁত পরে বাঘা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ নিঃশব্দে বাঘা হাসি হাসল, তারপর টপ করে টেবিল থেকে টুথব্রাশ আর টুথ-পেস্টের টিউব মুখে তুলে নিয়ে জানলা গলিয়ে আবার—
কুট্টিমামার ভাষায়—একেবারে উইন্ড! মানে হাওয়া হয়ে গেল।
টেনিদা থামল। আমাদের দিকে তাকিয়ে গর্বিতভাবে বললে, তাই বলছিলুম, দাঁত বাঁধানোর গল্প আমার কাছে করিাসনি! হুঃ!
অ- অ+ হাবুল সেন বলে যাচ্ছিল—পোলাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা— উস-উস শব্দে নোলার জল টানল টেনিদা: বলে যা-থামল...
বন-ভোজনের ব্যাপার - নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
হাবুল সেন বলে যাচ্ছিল—পোলাও, ডিমের ডালনা, রুই মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা—
উস-উস শব্দে নোলার জল টানল টেনিদা: বলে যা-থামলি কেন? মুৰ্গ মুসল্লম, বিরিয়ানি পোলাও, মশলদা দোসে, চাউ-চাউ, সামি কাবাব—
এবার আমাকে কিছু বলতে হয়। আমি জুড়ে দিলাম: আলু ভাজা, শুক্তো, বাটিচচ্চড়ি, কুমড়ের ছোকা—
টেনিদা আর বলতে দিলে না! গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল: থাম প্যালা, থাম বলছি। শুক্তো—বাটি-চচ্চড়ি। —দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তার চেয়ে বল না হিঞ্চে সেদ্ধ, গাঁদাল আর শিঙিমাছের ঝোল! পালা-জ্বরে ভুগিস আর বাসক-পাতার রস খাস, এর চাইতে বেশি বুদ্ধি আর কী হবে তোর। দিব্যি অ্যায়সা অ্যায়সা মোগলাই খানার কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে ধাঁ করে নিয়ে এল বাটি-চচ্চড়ি আর বিউলির ডাল! ধ্যাত্তোর!
ক্যাবলা বললে, পশ্চিমে কুঁদরুর তরকারি দিয়ে ঠেকুয়া খায়। বেশ লাগে।
—বেশ লাগে?—টেনিদা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল: কাঁচা লঙ্কা আর ছোলার ছাতু আরও ভালো লাগে না? তবে তাই খা-গে যা। তোদের মতো উলুকের সঙ্গে পিকনিকের আলোচনাও ঝকমারি।
হাবুল সেন বললে, আহা-হা চৈইত্যা যাইত্যাছ কেন? পোলাপানে কয়—
—পোলাপান! এই গাড়লগুলোকে জলপান করলে তবে রাগ যায়! তাও কি খাওয়া যাবে এগুলোকে? নিম-নিসিন্দের চেয়েও অখাদ্য! এই রইল তোদের পিকনিক—আমি চললাম! তোরা ছোলার ছাতু আর কাঁচা লঙ্কার পিণ্ডি গোল গে—আমি ওসবের মধ্যে নেই!
সত্যিই চলে যায় দেখছি! আর দলপতি চলে যাওয়া মানেই আমরা একেবারে অনাথ! আমি টেনিদার হাত চেপে ধরলাম: আহা, বোসো না। একটা প্ল্যান-ট্যান হােক। ঠাট্টাও বোঝা না।
টেনিদা গজগজ করতে লাগল। ঠাট্টা! কুমড়োর ছােক্কা আর কুদরুর তরকারি নিয়ে ওসব বিচ্ছিরি ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।
—না—না, ওসব কথার কথা!—হাবুল সেন ঢাকাই ভাষায় বোঝাতে লাগল। মোগলাই খানা না হইলে আর পিকনিক হইল কী?
—তবে লিস্টি কর—টেনিদা নড়ে-চড়ে বসল।
প্ৰথমে যে লিস্টটা হল তা এইরকম:
বিরিয়ানি পোলাও
কোর্মা
কোপ্তা
কাবার দু-রকম
মাছের চাপ—
মাঝখানে বেরসিকের মতো বাধা দিলে ক্যাবলা ; তাহলে বাবুর্চি চাই, একটা চাকর, একটা মোটর লরি, দুশো টাকা—
—দ্যাখ ক্যাবলা—টেনিদা ঘুষি বাগাতে চাইল।
আমি বললাম, চটলে কী হবে? চারজনে মিলে চাঁদা উঠেছে দশ টাকা ছ-আনা।
টেনিদা নাক চুলকে বললে, তাহলে একটু কম-সম করেই করা যাক। ট্যাক-খালির জমিদার সব—তোদের নিয়ে ভদ্দরলোকে পিকনিক করে!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তুমি দিয়েছ ছ-আনা, বাকি দশ টাকা গেছে আমাদের তিনজনের পকেট থেকে। কিন্তু বললেই গাঁট্টা। আর সে গাঁট্টা ঠাট্টার জিনিস নয়—জুতসই লাগলে স্রেফ গালপাট্টা উড়ে যাবে।
রফা করতে করতে শেষ পর্যন্ত লিস্টটা যা দাঁড়াল তা এই ;
খিচুড়ি (প্যালা রাজহাঁসের ডিম আনিবে বলিয়াছে)
আলু ভাজা (ক্যাবলা ভাঁজিবে)
পোনা মাছের কালিয়া (প্যালা রাঁধিবে)
আমের আচার (হাবুল দিদিমার ঘর হইতে হাত-সাফাই করিবে)
রসগোল্লা, লেডিকেনি (ধারে ‘ম্যানেজ’ করিতে হইবে)
লিস্টি শুনে আমি হাঁড়িমুখ করে বললাম, ওর সঙ্গে আর-একটা আইটেম জুড়ে দে হাবুল। টেনিদা খাবে।
—হেঁ—হেঁ—প্যালার মগজে শুধু গোবর নেই, ছটাকখানেক ঘিলুও আছে দেখছি। বলেই টেনিদা আদর করে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। ‘গেছি গেছি’ বলে লাফিয়ে উঠলাম আমি।
আমরা পটলডাঙার ছেলে—কিছুতেই ঘাবড়াই না। চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে রোজ দু-বেলা আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় হাতি-গণ্ডার সাবাড় করে থাকি। তাই বেশ ডাঁটের মাথায় বলেছিলাম, দূর-দূর। হাঁসের ডিম খায় ভদ্রলোক! খেতে হলে রাজহাঁসের ডিম। রীতিমতো রাজকীয় খাওয়া!
—কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে শুনি? খুব যে চালিয়াতি করছিস, তুই ডিম পাড়বি নাকি?—টেনিদা জানতে চেয়েছিল।
—আমি পাড়তে যাব কোন দুঃখে? কী দায় আমার?—আমি মুখ ব্যাজার করে বলেছিলাম: হাঁসে পাড়বে।
—তা হলে সেই হাঁসের কাছ থেকে ডিম তোকেই আনতে হবে। যদি না আনিস, তা হলে—
তা হলে কী হবে বলবার দরকার ছিল না। কিন্তু কী গেরো বলো দেখি। কাল রবিবার-ভোরের গাড়িতেই আমরা বেরুব পিকনিকে। আজকের মধ্যেই রাজহাঁসের ডিম যোগাড় করতে না পারলে তো গেছি। পাড়ায় ভন্টাদের বাড়ি রাজহাঁস আছে গোটকয়েক। ডিম-টিমও তারা নিশ্চয় পড়ে। আমি ভন্টাকেই পাকড়লাম। কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল!
—ডিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।
—তুই দে না ভাই এনে। একটা আইসক্রিম খাওয়াব। ভন্টা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, নিজেরা পোলাও-মাংস সাঁটবেন। আর আমার বেলায় আইসক্রিম! ওতে চলবে না। ইচ্ছে হয় নিজে বের করে নাও—আমি বাবা ময়লা ঘাঁটতে পারব না। কী করি, রাজি হতে হল।
ভন্টা বললে, দুপুরবেলা আসিস। বাবা মেজদা অফিসে যাওয়ার পরে। মা তখন ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোয়। সেই সময় ডিম বের করে দেব!
গেলাম দুপুরে। উঠোনের একপাশে কাঠের বাক্স—তার ভেতরে সার-সার খুপারি। গোটা-দুই হাঁস ভেতরে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। ভন্টা বললে, যা—নিয়ে আয়।
কিন্তু কাছে যেতেই বিতিকিচ্ছিরিভাবে ফ্যাঁস-ফ্যাঁস করে উঠল হাঁস দুটাে।
ফোঁস-ফোঁস করছে যে!
ভন্টা উৎসাহ দিলে: ডিম নিতে এসেছিস—একটু আপত্তি করবে না? তোর কোন ভয় নেই প্যালা—দে হাত ঢুকিয়ে।
হাত ঢুকিয়ে দেব? কিন্তু কী বিচ্ছিরি ময়লা!—ময়লা আর কী বদখত গন্ধ! একেবারে নাড়ি উলটে আসে। তার ওপরে যে-রকম ঠোঁট ফাঁক করে ভয় দেখাচ্ছে—
ভন্টা বললে, চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যা!
যা থাকে কপালে বলে যেই হাত ঢুকিয়েছি—সঙ্গে সঙ্গে—ওরে বাপরে! খটাং দুইটা হাত কামড়ে ধরল। সে কী কামড়! হাঁই-মই করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
—কী হয়েছে রে ভন্টা, নীচে এত গোলমাল কিসের?—ভন্টার মা’র গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
আমি আর নেই। হ্যাঁচক টানে হাঁসের ঠোঁট থেকে হাত ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড় লাগালাম। দরদর করে রক্ত পড়ছে তখন।
রাজহাঁস এমন রাজকীয় কামড় বসাতে পারে কে জানত। কিন্তু কী ফেরেববাজ ভন্টাটা। জেনে—শুনে ব্ৰাহ্মণের রক্তপাত ঘটাল। আচ্ছা—পিকনিকটা চুকে যাক—দেখে নেব তারপর। ওই পাঁঠার ঘুগনি আর ফুলুরির শোধ তুলে ছাড়ব।
কী করা যায়—গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজী ডিমই কিনতে হল গােটাকয়েক। পরদিন সকালে শ্যামবাজার ইস্টিশানে পৌঁছে দেখি, টেনিদা, ক্যাবলা আর হাবুল এর মধ্যেই মার্টিনের রেলগাড়িতে চেপে বসে আছে। সঙ্গে একরাশ হাঁড়ি-কলসি, চালের পুঁটলি, তেলের ভাঁড়। গাড়িতে গিয়ে উঠতে টেনিদা হাঁক ছাড়ল: এনেছিস রাজহাঁসের ডিম?
দুর্গা-নাম করতে করতে পুঁটলি খুলে দেখলাম।
—এর নাম রাজহাঁসের ডিম! ইয়ার্কি পেয়েছিস?—টেনিদা গাঁট্টা বাগাল।
আমি গাড়ির খােলা দরজার দিকে সরে গেলাম: মানে—ইয়ে, ছোট রাজহাঁস কিনা—
—ছোট রাজহাঁস! কী পেয়েছিস আমাকে শুনি? পাগল না পেটখারাপ?
হাবুল সেন বললে, ছাড়ান দাও—ছাড়ান দাও। ডিম তো আনছে!
টেনিদা গর্জন করে বললে, ডিম এনেছে না কচু। এই তোকে বলে রাখছি প্যালা—ডিমের ডালনা থেকে তোর নাম কেটে দিলাম। এক টুকরো আলু পর্যন্ত নয়, একটু ঝোলাও নয়!
মন খারাপ করে আমি বসে রইলাম। ডিমের ডালনা আমি ভীষণ ভালোবাসি, তাই থেকেই আমাকে বাদ দেওয়া! আচ্ছা বেশ, খেয়ো তোমরা। এমন নজর দেব পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাবে তোমাদের!
পিঁ করে বাঁশি বাজল—নড়ে উঠল মার্টিনের রেল। তারপর ধ্বস—ধ্বস ভোঁস ভোঁস করে এর রান্নাঘর, ওর ভাঁড়ার-ঘরের পাশ দিয়ে গাড়ি চলল।
টেনিদা বললে, বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্ৰায় এক ঘন্টার মামলা। লেডিকেনির হাড়িটা বের কর, ক্যাবলা।
ক্যাবলা বললে, এখুনি! তাহলে পৌছবার আগেই সে সাফ হয়ে যাবে?
টেনিদা বললে, সাফ হবে কেন, দুটাে-একটা চেখে দেখব শুধু। আমার বাবা ট্রেনে চাপলেই খিদে পায়। এই একঘন্টা ধরে শুধু শুধু বসে থাকতে পারব না। বের কর হাঁড়ি—চটপট—
হাঁড়ি চটপটই বেরুল—মানে, বেরুতেই হল তাকে। তারপর মার্টিনের রেলের চলার তালে তালে ঝটপট করে সাবাড় হয়ে চলল। আমি ক্যাবলা আর হাবুল সেন জুল-জুল করে শুধু তাকিয়েই রইলাম। একটা লেডিকেনি চেখে দেখতে আমরাও যে ভালোবাসি, সে-কথা আর মুখ ফুটে বলাই গেল না।
ইস্টিশান থেকে নেমে প্রায় মাইলখানেক হাটবার পরে ক্যাবলার মামার বাড়ি। কাঁচা রাস্তা, এঁটেল মাটি, তার ওপর কাল রাতে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আবার। আগে থেকেই রসগোল্লার হাড়িটা বাগিয়ে নিলে টেনিদা।।
—এটা আমি নিচ্ছি। বাকি মোটঘাটগুলো তোরা নে।
—রসগোল্লা বরং আমি নিচ্ছি, তুমি চালের পোটলাটা নাও টেনিদা। —লেডিকেনির পরিণামটা ভেবে আমি বলতে চেষ্টা করলাম।
টেনিদা চোখ পাকাল ; খবরদার প্যালা, ও-সব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয়? হুঁ-হঁ, বাবা—চালাকি ন চলিষ্যতি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাঁটরি বোঁচকা কাঁধে ফেলে আমরা তিনজনেই এগোলাম। কিন্তু তিন পাও যেতে হল না। তার আগেই ধাই—ধপাস! টেনে একখানা রাম-আছড় খেল হাবুল।
—এই খেয়েছে কচুপোড়া! —টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।
সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুঁটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু— হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।
ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারোটা বেজে গেল।
তা গেল। করুণ চোখে আমরা তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। ইস-এত কষ্টের ডিম! ওরই জন্যে রাজহাঁসের কামড় পর্যন্ত খেতে হয়েছে!
টেনিদা হুঙ্কার দিয়ে উঠল; দিলে সব পণ্ড করে! এই ঢাকাই বাঙালটাকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে! পিটিয়ে ঢাকাই পরোটা করলে তবে রাগ যায়!
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, হাবুল চার টাকা চাঁদা দিয়েছে—তার আগেই কী যেন একটা হয়ে গেল! হঠাৎ মনে হল আমার পা দুটাে মাটি ছেড়ে শোঁ করে শূন্যে উড়ে গেল, আর তারপরেই—
কাদা থেকে যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন আমার মাথা-মুখ বেয়ে আচারের তেল গড়াচ্ছে। ওই অবস্থাতেই চেটে দেখলাম একটুখানি। বেশ ঝাল-ঝাল টক-টক—বেড়ে আচারটা করেছিল হাবুলের দিদিমা!
ক্যাবলা আবার ঘোষণা করলে, আমের আচারের একটা বেজে গেল!
টেনিদা খেপে বললে, চুপ কর বলছি ক্যাবলা—এক চড়ে গালের বোম্বা উড়িয়ে দেব।
কিন্তু তার আগেই টেনিদার বোম্বা উড়ল—মানে স্রেফ লম্বা হল কাদায়। সাত হাত দূরে ছিটকে গেল। রসগোল্লার হাঁড়ি—ধবধবে শাদা রসগোল্লাগুলো পাশের কাদাভরা খানার গিয়ে পড়ে একেবারে নেবুর আচার।
ক্যাবলা বললে, রসগোল্লার দুটাে বেজে গেল!
এবার আর টেনিদা একটা কথাও বললে না। বলবার ছিলই বা কী! রসগোল্লার শোকে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারজনে পথ চলতে লাগলাম আমরা। টেনিদা তবু লেডিকেনিগুলো সাবাড় করেছে, কিন্তু আমাদের সাত্ত্বনা কোথায়! অমন স্পঞ্জ রসগোল্লাগুলো! পাঁচ মিনিট পরে টেনিদাই কথা কইল। —তবু পোনা মাছগুলো আছে—কী বলিস! খিচুড়ির সঙ্গে মাছের কালিয়া আর আলুভাজা—নেহাত মন্দ হবে না—অ্যাঁ?
হাবুল বললে, হ-হ, সেই ভালো। বেশি খাইলে প্যাট গরম হইব। গুরুপাক না খাওয়াই ভালো।
ক্যাবলা মিটমিট করে হাসল: শেয়াল বলছিল, দ্রাক্ষাফল অতিশয় খাট্টা!—ক্যাবলা ছেলেবেলায় পশ্চিমে ছিল, তাই দুই-একটা হিন্দী শব্দ বেরিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে।
টেনিদা বললে, খাট্টা! বেশি পাঁঠামি করবি তো চাঁট্ট বসিয়ে দেব!
ক্যাবলা ভয়ে স্পিকটি নট! আমি তখনও নাকের পাশ দিয়ে বাল-বাল টক-টক তেল চাটছি। হঠাৎ বুক-পকেটটা কেমন ভিজে-ভিজে মনে হল। হাত দিয়ে দেখি, বেশ বড়ো-সড়ো এক-টুকরো আমের আচার তার ভেতরে কায়েমি হয়ে আছে।
—জয়গুরু! এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে সেটা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। সত্যি—হাবুলের দিদিমা বেড়ে আচার করেছিল! আরও গোটাকয়েক যদি ঢুকত!
বাগান-বাড়িতে পৌঁছুলাম আরও পনেরো মিনিট পরে।
চারিদিকে সুপুরি আর নারকেলের বাগান—একটা পানা-ভর্তি পুকুর, মাঝখানে, একতলা বাড়িটা। কিন্তু ঘরে চাবিবন্ধ। মালীটা কোথায় কেটে পড়েছে, কে জানে।
টেনিদা বললে, কুছ্ পরোয়া নেই। চুলোয় যাক মালী। বলং বলং বাহুবলং—নিজেরা উনুন খুঁড়ব—খড়ি কুড়ুব, রান্না করব—মালী ব্যাটা থাকলেই তো ভাগ দিতে হত! যা হাবুল-ইট কুড়িয়ে আন—উনুন করতে হবে। প্যালা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আয়,—ক্যাবলাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যা।
—আর তুমি?—আমি ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
—আমি?—একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে টেনিদা হাই তুলল: আমি এগুলো সব পাহারা দিচ্ছি। সবচাইতে কঠিন কাজটাই নিলাম আমি। শেয়াল কুকুর এলে তাড়াতে হবে তো। —যা তোরা—হাতে-হাতে বাকি কাজগুলো চটপট সেরে আয়।
কঠিন কাজই বটে! ইস্কুলের পরীক্ষার গার্ডদেরও অমনি কঠিন কাজ করতে হয়। ত্রৈরাশিকের অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন ‘ঘোড়া-ঘোড়া ঘাস-ঘাস’ নিয়ে আমাদের দম আটকাবার জো, তখন গার্ড মোহিনীবাবুকে টেবিলে পা তুলে দিয়ে ‘ফোঁরর-ফোঁ’ শব্দে নাক ডাকাতে দেখেছি। .
টেনিদা বললে, যা—যা সব—দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঝাঁ করে রান্নাটা করে ফ্যাল-বড্ড খিদে পেয়েছে।
তা পেয়েছে। বইকি। পুরো এক হাঁড়ি লেডিকেনি এখনও গজগজ করছে পেটের ভেতর। আমাদের বরাতেই শুধু অষ্টরম্ভা। প্যাঁচার মতো মুখ করে আমরা কাঠখড়ি সব কুড়িয়ে আনলাম।
টেনিদা লিস্টি বার করে বললে, মাছের কালিয়া-প্যালা রাঁধিবে।
আমাকে দিয়েই শুরু। আমি মাথা চুলকে বললাম, খিচুড়ি-টিচুড়ি আগে হয়ে যাক— তবে তো?
—খিচুড়ি লাস্ট আইটেম—গরম গরম খেতে হবে। কালিয়া সকলের আগে। নে প্যালা—লেগে যা—
ক্যাবলার মা মাছ কেটে নুন-টুন মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাই রক্ষা। কড়াইতে তেল চাপিয়ে আমি মাছ ঢেলে দিলাম তাতে।
আরে—এ কী কাণ্ড! মাছ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কড়াই-ভর্তি ফেনা। তারপরেই আর কথা নেই—অতগুলো মাছ তালগোল পাকিয়ে গেল একসঙ্গে। মাছের কালিয়া নয়—মাছের হালুয়া।
ক্যাবলা আদালতের পেয়াদার মতো ঘোষণা করল ; মাছের কালিয়ার তিনটে বেজে গেল।
—তবে রে ইস্টুপিড—। টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল: কাঁচা তেলে মাছ দিয়ে তুই কালিয়া রাঁধছিস? এবার তোর পালাজ্বরের পিলেরই একদিন কি আমারই একদিন।
এ তো মার্টিনের রেল নয়—সোজা মাঠের রাস্তা। আমার কান পাকড়াবার জন্যে টেনিদার হাতটা এগিয়ে আসবার আগেই আমি হাওয়া। একেবারে পঞ্জাব মেলের স্পিডে।
টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, খিচুড়ির লিস্ট থেকে প্যালার নাম কাটা গেল।
তা যাক। কপালে আজ হরি-মটর আছে সে তো গোড়াতেই বুঝতে পেরেছি। গোমড়া মুখে একটা আমড়া-গাছতলায় এসে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।
বসে বসে কাঠ-পিঁপড়ে দেখছি, হঠাৎ গুটি গুটি হাবুল আর ক্যাবলা এসে হাজির।
—কী রে, তোরাও?
ক্যাবলা ব্যাজার মুখে বললে, খিচুড়ি টেনিদা নিজেই রাঁধবে। আমাদের আরও খড়ি আনতে পাঠাল।
সেই মুহুর্তেই হাবুল সেনের আবিষ্কার! একেবারে কলম্বাসের আবিষ্কার যাকে বলে!
—এই প্যালা—দ্যাখছস? ওই গাছটায় কীরকম জলপাই পাকছে!
আর বলতে হল না। আমাদের তিনজনের পেটেই তখন খিদেয় ইঁদুর লাফাচ্ছে। জলপাই—জলপাই-ই সই! সঙ্গে সঙ্গে আমরা গাছে উঠে পড়লাম—আহা-টক-টক-মিঠে-মিঠে জলপাই-যেন অমৃত।
হাবুলের খেয়াল হল প্ৰায় ঘন্টাখানেক পরে।
—এই টেনিদার খিচুড়ি কী হইল?
ঠিক কথা—খিচুড়ি তো এতক্ষণে হয়ে যাওয়া উচিত। তড়াক করে গাছ থেকে নেমে পড়ল ওরা। হাতের কাছে পাতাটাতা যা পেলে, তাই নিয়ে ছুটিল উর্ধ্বশ্বাসে। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে, আশায় আশায়। মুখে যাই বলুক—এক হাতা খিচুড়িও কি আমায় দেবে না? প্ৰাণ কি এত পাষাণ হবে টেনিদার?
কিন্তু খানিক দূর এগিয়ে আমরা তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ!
টেনিদা সেই নারকেল গাছটায় হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, দে—দে ক্যাবলা, পিঠটা আর একটু ভাল করে চুলকে দে।
পিঠ চুলকে দিচ্ছে-সন্দেহ কী। কিন্তু সে ক্যাবলা নয়—একটা গোদা বানর।
আর চার-পাঁচটা গোল হয়ে বসেছে টেনিদার চারিদিকে। কয়েকটা তো মুঠো-মুঠো চাল-ডাল মুখে পুরছে, একটা আলুগুলো সাবাড় করছে আর আস্তে আস্তে টেনিদার পিঠ চুলকে দিচ্ছে। আরামে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে টেনিদা, থেকে থেকে বলছে, দে ক্যাবলা, আর একটু ভালো করে চুলকে দে!
এবার আমরা তিনজনে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।: টেনিদা—বাঁদর-বাঁদর!
—কী! আমি বাঁদর!—বলেই টেনিদা হাঁ করে সোজা হয়ে বসল—সঙ্গে সঙ্গেই বাপ বাপ বলে চিৎকার!
—ইঁ-ইঁ—ক্লিচ্-ক্লিচ্! কিচ-কিচ!
চােখের পলকে বানরগুলো কাঁঠাল গাছের মাথায়। চাল-ডাল আলুর পুঁটলিও সেই সঙ্গে। আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তরিবত করে খেতে লাগল—সেই সঙ্গে কী বিচ্ছিরি ভেংচি! ওই ভেংচি দেখেই না লঙ্কার রাক্ষসগুলো ভয় পেয়ে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল!
পুকুরের ঘাটলায় চারজনে আমরা পাশাপাশি চুপ করে বসে রইলাম। যেন শোকসভা! খানিক পরে ক্যাবলাই স্তব্ধতা ভাঙল।
—বন-ভোজনের চারটে বাজল।
—তা বাজল। —টেনিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ; কিন্তু কী করা যায় বল তো প্যালা? সেই লেডিকেনিগুলাে কখন হজম হয়ে গেছে—পেট চুঁই-চুঁই করছে খিদেয়!
অগত্যা আমি বললাম, বাগানে একটা গাছে জলপাই পেকেছে, টেনিদা—
—জলপাই! ইউরেকা! বনে ফল-ভোজন—সেইটেই তো আসল বন-ভোজন! চল চল, শিগগির চল।
লাফিয়ে উঠে টেনিদা বাগানের দিকে ছুটিল।
Follow Us
Were this world an endless plain, and by sailing eastward we could for ever reach new distances