এক সময় দুই ভাই ছিল। একজন ধনী, একজন গরিব। ধনী ভাই স্যাকরা। লোকটাও পাজি। গরিব ভাই ঝাঁটা বানিয়ে সংসার চালায়। লোকটা ভালো আর সৎ। গরিব ভাইয়ের দুই ছেলে। তারা যমজ। চেহারা হুবহু এক—যেন দু ফোটা জল। মাঝে মাঝে ধনী স্যাকরার বাড়ি যায়, এঁটোকাঁটা কুড়িয়ে আনে। এখন হল কি, গরিব লোকটি একদিন বনে গেছে কাঠকুটো কুড়-তে। সেখানে দেখে সোনার একটা পাখি। জীবনে অমন সুন্দর পাখি সে দেখে নি। একটা ছোটো পাথর তুলে পাখিটার দিকে সে ছুড়ল আর অবাক হয়ে দেখল পাখির গায়ে সেটা লেগেছে। পাথর লাগতে সোনার একটা পালক পড়ল আর পাখিটা গেল উড়ে। সোনার পালকটা কুড়িয়ে নিয়ে সে গেল তার স্যাকরা ভাইয়ের কাছে। ভাই তাকে দিল অনেক টাকাকড়ি। কারণ পালকটা ছিল খাটি সোনার। পরদিন ডালপালা কাটার জন্য লোকটি উঠল এক বার্চগাছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই পাখিটাই গেল উড়ে। এদিকওদিক তাকাতে তার চোখে পড়ল পাখির বাসায় রয়েছে সোনার একটা ডিম। স্যাকরা-ভাইয়ের কাছে ডিমটা নিয়ে যেতে তাকে সে বলল, “এটা খাঁটি সোনা।” তার পর ডিমের বদলে তাকে দিল অনেক টাকাকড়ি। তার পর স্যাকরা বলল, “এবার কিন্তু আসল পাখিটা চাই।” গরিব লোকটি তৃতীয়বার বনে গিয়ে দেখে একটা ডালে বসে আছে পাখিটা। পাথর ছুড়তেই পাখিটা মরে পড়ে গেল। স্যাকরার কাছে সেটা নিয়ে যেতে গরিব ভাইকে সে দিল অনেক-অনেক টাকাকড়ি। গরিব ভাই ভাবল, “যাক, এবার আমার দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে।” খুব -খুশি হয়ে সে বাড়ি ফিরল।
স্যাকরা ছিল খুব চালাক আর ধূর্ত। বউকে ডেকে সে বলল, “পাখিটাকে আগুনে ঝলসে আমায় খেতে দাও। এটার কোনো-কিছু যেন বাদ না পড়ে। একলা বসে আমি এটা খাব। এটা সাধারণ পাখি নয়। এটার কলজে আর মেটুলি যে খাবে প্রতিদিন সকালে বালিশের নীচে সে পাবে একটা করে মোহর। পাখিটার পালক ছাড়িয়ে শিকে বেঁধে ঝলসাবার জন্য তার বউ সেটা উনুনে চড়াল। তার পর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তাকে যেতে হল অন্য কাজে। আর ঠিক সেই সময় রান্নাঘরে হাজির হল ঝাঁটাওয়ালার যমজ ছেলেরা। শিকটার দু পাশে .দাঁড়িয়ে বার দুই সেটা তারা ঘোরাল।
শিকের তলার চাটুতে পাখির ছোট্টো দুটো টুকরো পড়তে একজন অন্য জনকে বলল, “এই ছোট্টো দুটো টুকরো খেলে কেউ টের পাবে না। আমার ভারি ক্ষিদে পেয়েছে। আয়, খেয়ে নি।”
এই-না বলে সেই ছোট্টো টুকরো দুটো তারা খেয়ে ফেলল। এমন সময় স্যাকরা-বউ রান্নাঘরে এসে দেখে কী যেন তারা চিবুচ্ছে। সে প্রশ্ন করল, “কী তোরা নিয়েছিস?”
তারা বলল, “ছোটো দুটো টুকরো—পাখিটার গা থেকে পড়ে গিয়েছিল। তাই-না শুনে স্যাকরা বউ চেঁচিয়ে উঠল, “কী সর্বনাশ! তোরা দেখছি কলজে আর মেটুলি খেয়ে ফেলেছিস।” তার পর স্যাকরা যাতে টের না পায় তার জন্য একটা মোরগ মেরে সেটার কলজে আর মেটুলি সে ভরে দিল সোনার পাখির মধ্যে। ভালো করে ঝলসাবার পর পাখিটা সে নিয়ে গেল স্যাকরার কাছে। চেটেপুটে সবটা একাই খেল স্যাকরা, প্লেটে ছোট্টো একটি টুকরোও পড়ে রইল না। পরদিন সকালে কিন্তু মোহরের জন্য বালিশের তলা হাতড়ে কিছুই সে পেল না।
নিজেদের সৌভাগ্যের কথা যমজ ছেলে দুটি জানত না। পরদিন সকালে বিছানা থেকে ওঠার পর মেঝেয় ঠং করে শব্দ শুনে ঝুঁকে তারা দেখে সোনার দুটো মোহর পড়ে রয়েছে। মোহর দুটো তাদের বাবার কাছে নিয়ে যেতে সে ভীষণ অবাক হল। ভেবে পেল না সেগুলো কোথা থেকে এসেছে। পরদিন সকালে আবার একই ঘটনা ঘটতে দেখে সে হলে আরো অবাক। তার পর থেকে প্রতি সকালেই আসতে লাগল দুটো করে মোহর। শেষটায় ঝাঁটাওয়ালা তার ভাইয়ের কাছে গিয়ে এই অদ্ভুত ঘটনার সব কথা জানাল।
স্যাকরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝল ছেলেরা তার সোনার পাখির কলজে আর মেটুলি খেয়েছে। লোকটা ছিল ভারি পাজি আর হিংসুটে প্রতিহিংসা নেবার জন্য ভাইকে সে বলল, “শয়তানের সঙ্গে তোমার ছেলেরা ষড়, করেছে। মোহরগুল নিয়ো না। ছেলেদেরও বাড়িতে রেখো না। রাখলে তোমার সর্বনাশ হবে।”
ধনী লোককে গরিব ভাই খুব ভয় করত। বিষণ্ণ মনে ছেলেদের সে বনে ছেড়ে দিয়ে এল। পাগলের মতো ছেলেরা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে না পেয়ে বেজায় ঘাবড়ে পড়ল। এমন সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক শিকারীর। সে জিজ্ঞেস করল, কার ছেলে তারা।
তারা বলল, “আমাদের বাবা গরিব ঝাঁটাওয়ালা।” তার পর একে একে জানাল সব কথা। বলল, রোজ সকালে তাদের বালিশের তলায় মোহর পাওয়া যায় বলে বাবা তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
শিকারী বলল, “রোজ-রোজ মোহর পাওয়া তো খুবই ভালো কথা। আর তোমরাও দেখছি কুড়ে নও।”
ছেলে দুটিকে শিকারীর খুব ভালো লাগল। তার কোনো ছেলেপুলেও ছিল না। তাই তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলল, “আজ থেকে আমিই তোমাদের বাবা হলাম। তোমাদের আমি মানুষ করব।”
তাদের সে বনরক্ষীর কাজ শেখাল। প্রতিদিন সকালে তাদের বালিশের তলায় যে মোহরগুলো পাওয়া যেত, সেগুলো সে জমিয়ে রাখল ছেলেদের ভবিষ্যতের জন্য।
তারা বড়ো হয়ে ওঠার পর শিকারী একদিন তাদের বনে নিয়ে গিয়ে বলল, “এবার তোমাদের বন্দুক ছোড়ার পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেই বলব তোমরা দক্ষ শিকারী হয়েছ।”
বনের মধ্যে তারা অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অনেকক্ষণ শিকারের কোনো জীবজন্তর দেখা পাওয়া গেল না। শিকারী এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল একদল তুষার-ধবল, হাঁস ত্রিভুজের আকারে আসছে উড়ে। শিকারী তখন এক ভাইকে বলল, “প্রত্যেক কোণের একটা করে হাঁসকে গুলি করো।” সেই ভাই শিকারীর কথামতো গুলি ছুড়ে বন্দুক চালানোর পরীক্ষায় পাশ করল। খানিক পরে আর-এক দল হাঁস উড়ে আসতে অন্য ভাইকেও শিকারী বলল, প্রত্যেক কোণের একটা করে হাঁসকে গুলি করতে। বন্দুক চালানোর পরীক্ষায় সেই ভাইও পাশ করল।
তাদের পালক-পিতা তখন বলল, “তোমরা দুজনেই ভালো করে সব-কিছু শিখেছ। তোমরা দুজনেই দক্ষ শিকারী হয়েছ বলে স্বীকার করলাম।”
তার পর দুভাই বনের মধ্যে আরো খানিকটা গিয়ে পরামর্শ করে নিল আর সন্ধেয় পালক-পিতার সঙ্গে খেতে বসে তাকে তারা বলল, "আপনার কাছে আমাদের একটা অনুরোধ আছে। সেটা রক্ষা না করলে আমরা খাব না।”
শিকারী প্রশ্ন করল, “কী তোমাদের অনুরোধ?”
তারা বলল, “আমরা সব-কিছু শিখেছি। দেশ-বিদেশ তাই ঘুরে আসতে চাই। আমাদের যেতে অনুমতি দিন।”
বুড়ো শিকারী বলল, “আনন্দের সঙ্গেই তোমাদের অনুমতি দিলাম। সাহসী লোকের মতোই তোমরা অনুরোধ করেছ। তোমরা যে দেশভ্রমণে বেরোও—আমিও সেটা চাই। তোমরা বেরিয়ে পড়। তোমাদের মনে-প্রাণে আশীর্বাদ করছি।”
তার পর হাসিখুশি গল্প-গুজবের মধ্যে তারা রাতের খাওয়া শেষ করল। যাত্রার দিন শিকারী তাদের প্রত্যেককে দিল একটা করে বন্দুক আর কুকুর আর বলল তাদের জমানো মোহর যত খুশি নিতে। পালকপিতা খানিকটা পথ তাদের সঙ্গে গেল। বিদায় নেবার সময় প্রত্যেককে একটা করে ধারাল ছুরি দিয়ে বলল, “কখনো তোমাদের ছাড়াছাড়ি হলে ছুরিটা গাছে গেঁথে দিয়ো। তা হলে অন্যজন জানতে পারবে অনুপস্থিত ভাই কেমন আছে। ছুরির খোলা দিকে মর্চে পড়লে বুঝবে, সে মরে গেছে। কিন্তু ধারাল আর চকচকে থাকলে বুঝবে, সে আছে বেঁচে।”
যেতে যেতে যেতে যেতে দু ভাই পৌছল প্রকাণ্ড এক বনে। সেটা এমনই বিরাট যে এক দিনে পার হওয়া অসম্ভব। তাই তারা নিজেদের থলি থেকে খাবার বার করে খেয়ে সেখানে রাত কাটাল। দ্বিতীয় দিনেও কিন্তু বন থেকে তারা বেরুতে পারল না। এদিকে খাবারও গিয়েছিল ফুরিয়ে। তাই এক ভাই অন্য ভাইকে বলল, “কোনো-কিছু শিকার করতে না পারলে আমাদের উপোস করতে হবে।” এই-না বলে বন্দুকে গুলি ভরে চার দিকে সে লাগল তাকাতে।
এমন সময় সামনের একটা ঝোপ থেকে বেরুল বুড়ো একটা খরগোশ। তার দিকে বন্দুক টিপ করতেই খরগোশ চেঁচিয়ে উঠল, “শিকারী-ভায়া, আমাকে মেরো না। আমার বাচ্চাদের দিচ্ছি।” এই— না বলে ঝোপের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে বুড়ো খরগোশ নিয়ে এল তার ছোটো বাচ্চাকে। বাচ্চাদুটো এমন খুশি হয়ে লুটোপুটি করে খেলতে লাগল যে, ভাইরা প্রাণ ধরে তাদের গুলি করতে পারল না।
খরগোশের বাচ্চাদুটো তাদের পিছন-পিছন চলল। খানিক পরে এক শেয়ালকে দেখে তারা বন্দুক তুলল। কিন্তু শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল, ” “শিকারী ভায়া আমাকে মেরো না। আমার বাচ্চাদের দিচ্ছি।” এই-না বলে শেয়াল তার দুটো ছানাকে এনে তাদের পায়ের কাছে রাখল। সে দুটোকেও তারা মারল না। খরগোশ বাচ্চাদের সঙ্গী হিসাবে তাদের তারা নিল।
খানিক পরে ঝোপ থেকে বেরুল এক নেকড়ে। তারা বন্দুক তুলতেই নেকড়ে চেঁচিয়ে উঠল, “শিকারী ভায়া, আমাকে মেরো না। আমার বাচ্চাদের দিচ্ছি।” নেকড়ে তার ছানাদুটাকে তাদের পায়ের কাছে রাখল। তারাও অন্য বাচ্চাদের সঙ্গী হল।
তার পর এল এক ভালুক। সেও বলল, “শিকারী ভায়া আমাকে মেরো না। আমার বাচ্চাদের দিচ্ছি।” ভালুক ছানারাও অন্যদের সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলতে লাগল। তার পর ভাব দিকিনি কোন জন্তু এল?—এল কেশর নাড়িয়ে এক সিংহ।
শিকারীরা কিন্তু ভয় না পেয়ে বন্দুক তুলতেই অন্যদের মতো সিংহও বলে উঠল, “শিকারী-ভায়া, আমাকে মেরো না। আমার বাচ্চাদের দিচ্ছি।” এই-না বলে বাচ্চাদের সে এনে দিল। শিকারীদের সঙ্গে তখন রইল দুটো সিংহ, দুটো ভালুক, দুটো নেকড়ে, দুটো শেয়াল আর দুটো খরগোশ। তারা চলল তাদের পিছন-পিছন।
এদিকে ভাইদের তখন ক্ষিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে। তাই শেয়ালছানাদের তারা বলল, “শেয়ালরা তো ভারি ধূর্ত হয়। আমাদের জন্যে কিছু খাবার এনে দে। খাবার কোথায় পাওয়া যায় নিশ্চয়ই তোদের জানা অাছে।”
শেয়াল-ছানারা বলল, “কাছেই একটা গ্রাম আছে। সেখান থেকে অনেক মোরগ আমরা এনেছিলাম। সেই গ্রামের পথ তোমাদের দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
গ্রামটায় পৌছে নিজেদের আর তাদের জন্তু-জানোয়ারদের জন্যে খাবার কিনে তারা চলল এগিয়ে। কাছেপিঠের সব গোলাবাড়ির খবর জানত শেয়ালরা। শিকারী যমজ-ভাইদের সব-কিছু খবরাখবর তারা দিতে লাগল।
কিছুদিন এইভাবে তারা চলল। কিন্তু একসঙ্গে থেকে তারা দেখল, কোনোরকম কাজকর্ম পাচ্ছে না। শেষটায় তাই এ ওকে বলল, “এভাবে আর চলে না। আমাদের আলাদা আলাদা পথে এবার থেকে যেতে হয়।” জন্তুগুলোকে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিল। প্রত্যেকেই তারা নিল একটা করে সিংহ, ভালুক, নেকড়ে, শেয়াল আর খরগোশ। তার পর বিদায় নেবার সময় তারা বলল, চিরকাল পরস্পরকে তারা ভালোবাসবে। পালক-পিতা যে-ছুরি তাদের দিয়েছিল সেটা গাছে গেঁথে একজন গেল পুবে, অন্যজন পশ্চিমে।
জন্তুদের নিয়ে এক ভাই পৌছল এক শহরে। আগাগোড়া শহরটা পাতলা কালো রেশমী শোকের কাপড়ে মোড়া। এক সরাইখানায় গিয়ে সরাইখানার মালিককে সে বলল, তার জন্তু-জানোয়ারদের আস্তাবলে রাখতে। মালিক তাকে দিল একটা আস্তাবল। সেটায় ছিল একটা গর্ত ৷ সেই গর্ত দিয়ে গিয়ে তার জন্য খরগোশ নিয়ে এল একটা বাঁধাকপি। শেয়াল নিয়ে এল একটা মুরগি। আর তার পর একটা মোরগ। সেগুলো সব রান্নাবান্না করে সে খেল। কিন্তু গর্তটা এতই ছোটো যে, সেটার ভিতর দিয়ে গলতে পারল না নেকড়ে, ভালুক আর সিংহ। সরাইখানার মালিক তাই তাদের নিয়ে গেল একটা মাঠে। সেখানে একটা গোরু শুয়েছিল ৷ পেট ভরে খেল তারা গোরুটার মাংস। জন্তু-জানোয়ারদের খাবার দাবার খাইয়ে সরাইখানার মালিককে সে প্রশ্ন করল,—“শহর আর সরাইখানার সবাই শোকে মুষড়ে পড়েছে एदछन्?”
সরাইখানার মালিক বলল, “কারণ কাল আমাদের রাজার একমাত্র মেয়েকে মরতে হবে।”
সে প্রশ্ন করল, “রাজকন্যের কি খুব অসুখ?”
সরাইখানার মালিক বলল, “না, না। রাজকন্যের স্বাস্থ্য খুব ভালোই। কিন্তু তা হলেও তাকে মরতে হবে।”
“কেন মরতে হবে।”
“শহরের বাইরেকার উঁচু পাহাড়ে একটা ড্রাগন থাকে। প্রতি বছরেই তার দরকার একটি করে কুমারী মেয়ের। তা না হলে সমস্ত রাজ্য সে ধ্বংস করে ফেলবে। এখন এখানে আর কোনো কুমারী নেই। বাকি শুধু রাজকন্যে। কাল তাই রাজকন্যেকে যেতে হবে ড্রাগনের কাছে।”
শিকারী-ভাই জানতে চাইল, ড্রাগনটাকে কেন মেরে ফেলা হয় নি। সরাইখানার মালিক বলল, “অনেক রাজপুত্তুর তাকে মারতে গিয়ে মরেছে। রাজা ঘোষণা করেছেন ড্রাগনটাকে যে মারতে পারবে তার সঙ্গে রাজকন্যের বিয়ে দেবেন আর তাঁর মৃত্যুর পর সেই বসবে সিংহাসনে।
সেই শিকারী-ভাই তখন আর কিছু বলল না। কিন্তু পরদিন সকালে নিজের জন্তুদের নিয়ে সে গিয়ে উঠল ড্রাগনের পাহাড়ে। পাহাড়ের চুড়োয় ছিল ছোট্টো একটি গির্জে আর তার বেদীর উপর কানায় কানায় ভরা তিনটি গবলেট। সেগুলোয় লেখা ছিল: যে কেউ এই পানপাত্রগুলো নিঃশেষ করতে পারবে সে-ই হবে পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে শক্তিশালি লোক। দরজার চৌকাঠের নীচে যে তরোয়াল পোঁতা আছে দক্ষতার সঙ্গে সেটা সে পারবে চালনা করতে।”
গবলেটগুলো থেকে পান না করে শিকারী গেল তরোয়ালটার খোঁজে। কিন্তু সেটাকে নাড়াতে না পেরে আবার গিজের মধ্যে সে ফিরে গবলেটগুলো নিঃশেষ করল। সঙ্গে সঙ্গে সহজেই তরোয়ালটা ঘোরাবার শক্তি তার দেহে এল। তার পর নির্দিষ্ট সময়ে রাজকন্যেকে নিয়ে এলেন রাজা আর সভাসদৃবৰ্গ। দূর থেকে ড্রাগনের পাহাড়ে শিকারীকে দেখতে পেয়ে রাজকন্যের মনে হল, স্বয়ং ড্রাগন বুঝি তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। ভয় পেয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সে না গেলে সমস্ত শহর ছারখার হয়ে যাবে জানত বলে ধীরে-ধীরে সেই বিপজ্জনক পথ দিয়ে রাজকন্যে উঠে গেল। রাজা আর তার সভা সদবঙ্গ বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু কী ঘটে দেখার জন্য দুরে দাঁড়িয়ে রইল রাজার মারশাল’। পাহাড়ে উঠে ড্রাগনের বদলে রাজকন্যে দেখল সেই শিকারীকে। রাজকন্যেকে সান্তনা দিয়ে সে বলল, নিশ্চিত সে তার জীবন রক্ষা করবে। আর তার পর রাজকন্যেকে সেই গির্জের মধ্যে নিয়ে গিয়ে সে কুলুপ দিয়ে রাখল বন্ধ করে।
কয়েক মুহূর্ত পরে সাত-মাথাওয়ালা ড্রাগন ভয়ংকর হুংকার করতে করতে এসে প্রশ্ন করল, “এখানে কী তোমার দরকার?”
শিকারী বলল, “আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই।”
ড্রাগন বলল, “তাই নাকি। আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসে অনেক নাইই- এইখানে মরেছে।” এই-না বলে চোদ্দোটা নাক দিয়ে সে আগুন ছিটোতে লাগল। ড্রাগনের উদ্দেশ্য ছিল শুকনো ঘাসে আগুন ধরিয়ে ধোয়া উড়িয়ে শিকারীকে দম বন্ধ করে মারার। কিন্তু তার বিশ্বস্ত জন্তুর দল পড়িমরি করে ছুটে এসে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিল সেই আগুন। ড্রাগন তখন শিকারীর দিকে ছুটে গেল, আর শিকারী তরোয়ালটা ঘুরিয়ে কেটে ফেলল তার তিনটে মাথা। এইবার সত্যি-সত্যি ক্ষেপে গিয়ে লাফ দিয়ে উঠে শিকারীর উপর সে ছড়াতে লাগল আগুনের স্রোত। কিন্তু শিকারী আবার তরোয়াল ঘুরিয়ে কেটে ফেলল তার আরো তিনটে মাথা। রক্তপাতের ফলে একেবারে কাবু হয়ে ড্রাগন তখন পৃথিবীতে আছড়ে পড়ল। তার পর যেই-না উঠে শিকারীকে সে আক্রমণ করতে যাবে, শিকারী তার তরোয়ালের প্রচণ্ড এক কোপে কেটে ফেলল তার শেষ মাথা আর লেজটা ৷ সঙ্গে সঙ্গে শিকারীর বিশ্বম্ভ জন্তুর দল ছুটে এসে টুকরো টুকরো করে ফেলল ড্রাগনের মৃতদেহটা ৷
যুদ্ধ শেষ হবার পর শিকারী গির্জের দরজা খুলে দেখে ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় রাজকন্যে মেঝের উপর অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। তাকে সে কোলে করে খোলা বাতাসের মধ্যে নিয়ে এল আর তার জ্ঞান হতে ড্রাগনের কাটা-ছেড়া মৃতদেহ তাকে দেখিয়ে বলল—আর তার ভয় নেই।
রাজকন্যের তখন আনন্দ আর ধরে না। শিকারীকে সে বললম,“আমার বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ড্রাগনকে যে মারবে তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। তাই এবার তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে।” এই না বলে তার প্রবালের হার খূলে সেই বিশ্বস্তজন্তুদের সে ভাগ করে দিল দশটা গুটি। সিংহকে দিল ছোট্ট বক্লস্টা। শিকারীকে রাজকন্যে দিল সুতোয় তার নাম লেখা পকেট রুমাল। আর শিকারী শিকারী গিয়ে ড্রাগনের সাতটা মাথা থেকে সাতটা জিভ কেটে সেই রুমালে জড়িয়ে নিয়ে কাছে রেখে দিল।
সেই আগুনের হলকায় আর যুদ্ধের পরিশ্রমে ভঅরি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল শিকারী। রাজকন্যেকে তাই সে বলল- খানিক ঘুমিয়ে নেবে।
রাজকন্যে রাতি হতে তারা দুজন মাটির উপর শুয়ে পড়ল। সিংহকে শিকারী বলল, “তুমি পাহারা দিয়ো।” এই না বলে শিকারী আর রাজকেন্য গভীর ঘূমে তলিয়ে গেল।
তাদের পাশে শূয়ে সিংহ পাহারা দিতে লাগল। কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমে সেও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ভালুককে সে বলল,“আমার পাশে শূয়ে পড়ো আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি। কেউ এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো।
সিংহের পাশে ভালুক শুয়ে পড়ল। কিন্তু সে-ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বলে নেকড়েকে ডেকে বলল, “আমার পাশে শুয়ে পড়ো। আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি। কেউ এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো।
নেকড়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সেও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বলে শেয়ালকে বলল, “আমার পাশে শুয়ো পড়ো। আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি কেউ এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো।
শেয়াল শুয়ে পড়ল। কিন্তু সেও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বলে খরগোশকে বলল, “আমার পাশে শুয়ো পড়ো। আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি কেউ এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো।
খরগোশ তার পাশে দিয়ে বসল। কিন্তু সে বেচারার ফরমাশ করার কেউ ছিল না। আর সেও পড়েছিল ক্লান্ত হয়ে। তাই সেও পড়ল ঘুমিয়ে। এইভাবে সবাই তারা ঘুমিয়ে পড়ল-- শিকারী, রাজকেন্য, সিংহ, ভালুক, নেকড়ে, শেয়াল ও খরগোশ।
মারশাল সর্বক্ষণ ছিল কাছেই দাঁড়িয়ে। সে দেখেছিল রাজকেন্যকে ড্রাগন নিয়ে যায় নি। পাহাড়ের মধ্যে সব-কিছু চুপচাপ দেখে এবার সে সাহস করে সেখানে উঠল। উঠে দেখে ড্রাগনের কাটাছেঁড়া শরীর আর তার কিছুদূরে শিকারী আর রাজকন্যে আর সব জন্তুদের ঘুমিয়ে থাকতে। লোকটা ছিল পাজি আর শয়তান। তাই সে শিকারীর মুণ্ড কেটে, রাজকন্যেকে কোলে তুলে পাহাড় থেকে নামতে লাগল। রাজকন্যের ঘুম তখন গেল ভেঙে। ভয়ে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
মারশাল তাকে বলল, “তুমি এখন আমার কবলে। আমরা বাড়ি ফেরার পর বলবে--ড্রাগনটাকে মেরেছি আমি।”
রাজকন্যে বলল, “সে কথা বলতে আমি পারব না। কারণ ড্রাগনকে মেরেছে শিকারী আর তার জন্তুরা।”
মারশাল তখন খাপ থেকে তার তরোয়াল বার করে শাসিয়ে বলল—তার কথামতো কাজ না করলে রাজকন্যেকে মেরে ফেলবে। রাজকন্যে তখন ভয় পেয়ে বাধ্য হল তার কথায় সায় দিতে।
তার পর রাজকন্যেকে সে নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজা ভেবেছিলেন তার মেয়েকে ড্রাগন কেটে ছিড়ে মেরে ফেলেছে। তাই অক্ষত শরীরে মেয়েকে ফিরতে দেখে তার আনন্দ আর ধরে না। মারশাল বলল—দ্রাগনকে সে মেরে রাজ্যের সবাইকে সে উদ্ধার করেছে , তাই রাজকন্যের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে হবে।
রাজকন্যেকে রাজা প্রশ্ন করলেন, “মারশাল-এর কথাটা কি সত্যি?”
রাজকন্যে বলল, “মনে হয় কথাটা সত্যি ৷ কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ—আজ থেকে এক বছর বিয়েটা মুলতুবি থাক।” সে আশা করেছিল এক বছরের মধ্যে সেই সাহসী শিকারীর খবর পাওয়া যাবে। ড্রাগন-পাহাড়ের মৃত-প্রভুর পাশে তখনো ঘুমিয়েছিল জস্তুরা। একটা বড়োসড়ো ভোমরা উড়ে এসে বসল খরগোশের নাকে ৷ থাবা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে খরগোশ ঘুমিয়ে চলল। দ্বিতীয়বার ভোমরা ফিরে এসে খরগোশের নাকে হুল ফোটাতে তার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই খরগোশ জাগাল শেয়ালকে, শেয়াল নেকড়েকে, নেকড়ে ভালুককে আর ভালুক সিংহকে।
সিংহ জেগে উঠে যখন দেখল রাজকন্যে নেই আর তার প্রভু মরে পড়ে আছে তখন ভয়ংকর গর্জন করে সে চেঁচিয়ে উঠল, “কে এ-কাজ করল? ভালুক, আমাকে জাগাও নি, কেন?” ভালুক প্রশ্ন করল, “নেকড়ে, আমাকে জাগাও নি কেন?” নেকড়ে প্রশ্ন করল, “শেয়াল, আমাকে জাগাও নি কেন?” আর শেয়াল প্রশ্ন করল, “খরগোশ, অামাকে জাগাও নি কেন?”
খরগোশ বেচারা কোনো অজুহাত খুঁজে পেল না। সব দোষ তাকে ঘাড় পেতে নিতে হল। অন্যরা তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে ফেলত ৷ কিন্তু অনুনয় করে সে বলল, “আমাকে মেরো না। কারণ প্রভুকে আবার আমি বাঁচাতে পারি। আমি একটা পাহাড় জানি , সেখানে এমন লতা জন্মায় যেটা মুখে ঠেকালে সব অসুখ সারে, সব ক্ষত জোড়া লাগে ৷ কিন্তু সেখানে যেতে আমার দুশো ঘণ্টা লাগবে।
সিংহ বলল, “চৰিবশ ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে সেই লতা তোমায় আনতে হবে।”
প্রাণপণে ছুটল খরগোশ। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই নিয়ে এল সেই আশ্চর্য লতা। শিকারীর কাটা মুণ্ড সিংহ জোড়া দিল আর খরগোশ সেই লতা ঠেকাল তার মুখে। আর সঙ্গে সঙ্গে শিকারীর বুকের ম্পন্দন ফিরে এল। আর সে বেঁচে উঠল।
জেগে উঠে রাজকন্যেকে দেখতে না পেয়ে শিকারী দারুণ ঘাবড়ে গেল। তার পর ভাবল, “হয়তো আমাকে সে আর দেখতে চায় নি। তাই যখন ঘুমিয়ে ছিলাম সম্ভবত তখন সে চুপি চুপি চলে গেছে।’
তাড়াহুড়ো করে সিংহ তার প্রভুর মাথা উলটো করে জুড়েছিল। কিন্তু রাজকন্যের কথা ভাবতে ভাবতে শিকারী এমনই হয়ে পড়েছিল যে, দুপুরের আগে এই ভুলটা সে ধরতে পারে নি। দুপুরে খেতে শুরু করে ঘুমন্ত অবস্থায় কী-কী ঘটেছে প্রশ্ন করার সময় ভুলটা সে টের পায়। সিংহ তখন বলে যায়—কী ভাবে ক্লান্ত হয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল, জেগে উঠে কী ভাবে দেখে মুণ্ড কাটা, কী ভাবে খরগোশ নিয়ে আসে সেই আশ্চর্য লতা আর কী ভাবে তাড়াহুড়োর মাথায় তার প্রভুর মুণ্ড, উলটো দিকে সে বসায়। সিংহ বলল—ভুলটা এক্ষুনি শুধরে নিচ্ছে। এই-না বলে এক থাবায় প্রভুর মুণ্ডু ছিড়ে নিয়ে সোজা করে সিংহ বসাল আর সঙ্গে সঙ্গে খরগোশ সেই আশ্চর্য লতা ছুঁইয়ে সেটা আবার জোড়া দিয়ে দিল।
শিকারী তার পর খুবই মনমরা হয়ে পড়ল। দেশে-দেশে এলোমেলো সে ঘুরে বেড়ায়। পথে-পথে তার জন্তুদের নাচিয়ে পয়সাকড়ি নেয়। এখন হল কি—যে শহরে রাজকন্যেকে সে ড্রাগনের কবল থেকে বঁচিয়েছিল, তার ঠিক এক বছর পূর্ণ হবার দিন সে পৌছল সেই শহরে। শহরে তখন উড়ছে উৎসবের নানা রঙের পতাকা। সরাইথানার মালিককে শিকারী প্রশ্ন করল, “মশাই, এই-সব লাল পতাকার মানে কী? গতবার এখানে যখন আসি তখন তো শহর মোড়া ছিল পাতলা কালো রেশমী কাপড়ে।
সরাইখানার মালিক বলল, “এক বছর আগে রাজকন্যেকে বলি দেবার কথা ছিল ড্রাগনের কাছে। কিন্তু রাজার মারশাল যুদ্ধ করে ড্রাগনটাকে মেরেছে। মারশাল-এর সঙ্গে আজ তাই রাজকন্যের বিয়ে। আজ আর শহরটা তাই শোকের পাতলা কালো রেশমী কাপড়ে মোড়া নয় তার বদলে চারি দিকে ওড়ানো হয়েছে উৎসবের লাল পতাকা।”
পরের দিন বিয়ের দিন। শিকারী সরাইখানার মালিককে বলল, “কর্তা, আমার সঙ্গে একটা বাজি ধরবে? আমি বলছি, রাজার জন্যে তৈরি রুটি এই টেবিলে খাব ৷ কী কত্তা, বাজি ধরবে?”
সরাইখানার মালিক বলল, “অসম্ভব। একশো মোহর বাজি ধরলাম –তোমার কথা সত্যি হতেই পারে না।”
খরগোশকে শিকারী বলল, “খরগোশভায়া, তুমি তো সেরাদৌড়বাজ। রাজা যে-ধরনের রুটি খান ছুটে গিয়ে সেরকম রুটি নিয়ে এসো।”
সব চেয়ে ছোটো বলে খরগোশ জানত তাকেই যেতে হবে। কাজটা করার ফরমাশ অন্য কাউকে সে করতে পারবে না। সে ভাবল, ‘পথ দিয়ে একা লাফাতে-লাফাতে গেলে কসাই-এর কুকুরগুলো নিশ্চয়ই আমাকে ধরবে।’ আর সত্যি-সত্যি হলও ঠিক তাই। কসাই-এর কুকুরগুলো বেরিয়ে এসে তেড়ে গেল তাকে থাবা মারতে। খরগোশ কিন্তু এক লাফে প্রহরীর ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। প্রহরী টের পেল না। কুকুরগুলো ছুটে এসে চেষ্টা করল সেখান থেকে খরগোশকে বার করতে। কিন্তু প্রহরী তাদের এমন মুগুরপেটা করল যে, কেউ-কেউ করতে করতে কুকুরগুলো ছুটে পালাল। খরগোশ তখন লাফাতে লাফাতে রাজপ্রাসাদের মধ্যে সেঁধিয়ে সোজা রাজ কন্যের কাছে গিয়ে তার চেয়ারের তলায় বসে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল রাজকন্যের পায়ে।
রাজকন্যে ভাবল তার পোষা কুকুরটা বুঝি পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তাই চেঁচিয়ে উঠল, “ষা যা, বিরক্ত করিস না।”
দ্বিতীয়বার খরগোশ তার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে রাজকন্যে আবার ধমকে বলল, “তুই যাবি, না যাবি না?” তখনো তার ধারণা কুকুরটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
তৃতীয়বার খরগোশ সুড়সুড়ি দিতে রাজকন্যে তাকাল চেয়ারের তলায় আর খরগোশের গলার হার দেখে চিনতে পারল তাকে।
তখন তাকে কোলে তুলে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যে বলল, “কি চাস রে, খরগোশ?”
খরগোশ বলল, “আমার প্রভু, ড্রাগনকে যিনি মেরেছিলেন, এখানে এসেছেন ৷ বলেছেন, রাজা যে-রুটি খান তার একটা নিয়ে আসতে ৷”
খবর শুনে রাজকন্যে খুব খুশি হল। তার পর রুটিওয়ালাকে ডেকে বলল, রাজা যে রুটি খান তার একটা নিয়ে আসতে ৷
খরগোশ তখন বলল, “কসাই-এর কুকুরগুলো আমায় ধরতে পারে। তাই রুটিটা নিয়ে যেতে হবে রুটিওয়ালাকে।” রুটিটা নিয়ে রুটিওয়ালাকে তাই যেতে হল সরাইখানায়। সরাইখানার বসার ঘরের দোরগোড়ায় রুটিটা সে রাখল। সেখানে বসে ছিল খরগোশ। সামনেকার থাবাদুটো দিয়ে রুটিটা ধরে সেটা সে নিয়ে গেল তার প্রভুর কাছে।
শিকারী তখন সরাইখানার মালিককে বলল, “এই দেখো, রাজার রুটি ৷ এবার তোমাকে সেই একশো মোহর দিতে হয়।”
রুটি দেখে তো সরাইখানার মালিক তাজ্জব। শিকারী তখন বলে চলল, “শুধু এই রুটিই নয়। রাজার টেবিলের মাংসর রোস্টও আনাচ্ছি।” সরাইখানার মালিক বলল, “না দেখলে বিশ্বাস হচ্ছে না।” কিন্তু বাজি ধরতে আর ভরসা পেল না।
শেয়ালকে ডেকে শিকারী বলল, “শেয়ালভায়া, রাজার জন্যে যে মাংস রান্না হয়েছে সেটা নিয়ে এসো ৷”
শেয়াল ছিল ভারি ধূর্ত। খরগোশের চেয়ে পথ তার অনেক ভালো চেনা। সদর রাস্তা দিয়ে না গিয়ে সে চুপি চুপি গেল অলিগলি দিয়ে। তাই কোনো কুকুর তার দেখা পেল না। নিরাপদে রাজকন্যের চেয়ারের তলায় বসে রাজকন্যের পা সে চুলকে দিল। চেয়ারের তলায় তাকিয়ে কলারটা দেখে শেয়ালকে সে চিনতে পারল।
নিজের ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যে প্রশ্ন করল, “কী চাস রে শেয়াল?
শেয়াল বলল, “আমার প্রভু, ড্রাগনকে যিনি মেরেছিলেন, এখানে এসেছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন, রাজার জন্যে রান্না মাংসর রোস্ট তাকে পাঠাতে ৷”
রাঁধুনিকে ডেকে রাজকন্যে আদেশ দিল, রাজার জন্য রান্না মাংসর থানিকটা সরাইখানায় পৌছে দিতে। মাংসর রোস্ট পৌছতে পাত্রের ঢাকনা খুলে লেজ দিয়ে মাছি তাড়িয়ে শেয়াল সেটা নিয়ে গেল তার প্রভুর কাছে।
শিকারী তখন সরাইখানার মালিককে বলল, “এই দেখো, রুটি আর মাংস ৷ এবার রাজার জন্যে রান্না তরিতরকারিও অানাচ্ছি।” নেকড়েকে ডেকে সে আদেশ দিল তরিতরকারি নিয়ে আসতে ৷
নেকড়ে সোজা গেল রাজপ্রাসাদে। কারণ কাউকেই তার ভয় ডর নেই। তার পর রাজকন্যের কাছে গিয়ে পিছন থেকে টান দিল তার গাউনে। ফিরে তাকিয়ে তারও কলার দেখে চিনতে পেরে নিজের ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যে প্রশ্ন করল, “কী চাস রে, নেকড়ে?”
নেকড়ে বলল, “আমার প্রভু, ড্রাগনকে যিনি মেরেছিলেন, এখানে এসেছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন রাজার জন্যে রান্না তরিতরকারি তাকে পাঠাতে।”
রাঁধুনিকে ডেকে রাজকন্যে আদেশ দিল রাজার জন্য রান্না তরিতরকারির খানিকটা সরাইখানায় পৌছে দিতে। তরিতরকারি পৌছতে পাত্রের ঢাকনা খুলে নেকড়ে সেটা নিয়ে গেল তার প্রভুর কাছে।
শিকারী তখন সরাইখানার মালিককে বলল, “এই দেখো—রুটি, মাংস আর তরিতরকারি। এবার রাজা যে মিষ্টি খান সেটা আনাচ্ছি।” ভালুককে ডেকে শিকারী বলল, “ভালুক ভায়া, রাজা যে মিষ্টি, ভালোবাসেন আমার জন্যে তার খানকয়েক নিয়ে এসে।”
হেলে দুলে ভালুক পৌছল রাজপ্রাসাদে। তাকে আসতে দেখে সবাই ভয় পেয়ে পালাল ছুটে। কিন্তু প্রহরীর ঘরের কাছে পৌছতে সে ভালুকের মাথা টিপ করে বন্দুক তুলে চেষ্টা করল তার পথ আগলাতে। ভালুক তখন লাফিয়ে উঠে থাবা দিয়ে এমন জোরে প্রহরীর কান মলে দিল যে, সে হয়ে গেল দারুণ হতভম্ব। ফলে ভালুককে আর বাধা দিল না।
ভালুক তখন সোজা রাজকন্যের কাছে গিয়ে, তার পিছনে দাড়িয়ে ঘোৎ ঘোৎ করতে লাগল। ঘাড় ফিরে তাকিয়ে, ভালুককে চিনতে পেরে, নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাজকন্যে প্রশ্ন করল, “কী তোর চাই রে?”
ভালুক বলল, “আমার প্রভু, ড্রাগনকে যিনি মেরেছিলেন, এখানে এসেছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন, রাজা যে মিষ্টি খান সেগুলো আনতে।”
মিষ্টি যে বানায় তাকে ডেকে রাজকন্যে আদেশ দিল এক প্লেট মিষ্টি সরাইখানায় নিয়ে যেতে। ভালুক তখন ঢেকে মিষ্টি নিয়ে গেল তার প্রভুর কাছে।
শিকারী তখন সরাইখানার মালিককে বলল, “এই দেখো—রুটি, মাংস, তরিতরকারি আর মিষ্টি। কিন্তু রাজা যে আঙুরের রস পান করেন, সেটা আমি চাখতে চাই।”
সিংহ তাই ভয়ংকর গর্জন করতে করতে ছুটল আঙুরের রস আনতে। সিংহের গর্জন শুনে পড়িমরি করে ছুটে পালাল প্রহরীর দল। রাজপ্রাসাদের ঘরে গিয়ে সিংহ তার লেজ দিয়ে সজোরে টোকা দিল।
রাজকন্যে দরজাটা খুলল। সিংহকে দেখে প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। তার পর তার গলায় নিজের সেই সোনার বকলস হার দেখে, চিনতে পেরে, নিয়ে গেল তাকে নিজের ঘরে।
রাজকন্যে প্রশ্ন করল, “কী তোর চাই রে, সিংহ?”
সিংহ, বলল, “আমার প্রভু, ড্রাগনকে যিনি মেরেছিলেন, এখানে এসেছেন। রাজা যে আঙুরের রস থান, সেটার খানিকটা তিনি চান।” রাজকন্যে চাকরকে বলল, মাটির তলার ঘর থেকে আঙুর-রস সিংহকে দিতে।
সিংহ বলল, “লোকটার সঙ্গে গিয়ে দেখছি সত্যিকারের ভালো আঙুর-রস পাই কি না।” চাকরের সঙ্গে সেই মাটির তলার ঘরে গিয়ে হাজির হল সিংহ। চাকরটা চাকরদের জন্য রাখা বাজে পিপের কল খুলতে গেছে—সিংহমশাই তখন হুঙ্কার ছেড়ে বলল, “দাঁড়া, আগে আমি চেখে দেখি।”
চেখে সিংহ বলল, “এককেবারে বাজে।” আড়চোখে তাকিয়ে চাকর গেল—যে-পিপে থেকে মারশাল-এর জন্য আঙুর-রস থাকে, সেই পিপের কাছে।
হুংকার ছেড়ে আবার সিংহ বলল, “দাঁড়া, আগে চেখে দেখি।”
চেখে সিংহ বলল, “আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু আসল জিনিস নয়।”
চাকর তখন ভীষণ চটে বলল, “তুই তো একটা জন্তু। আসল জিনিসের কী বুঝিস্ রে?”
তাই-না শুনে সিংহ লোকটার মাথায় এমন থাবা কষাল যে, অজ্ঞানঅচৈতন্য হয়ে সে পড়ে গেল মেঝেয়। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সিংহকে সেই চাকর নিয়ে গেল মাটির তলার বিশেষ একটা ছোটো ঘরে। সেখানে ছিল এমন একটা পিপে আঙুর-রস, রাজা ছাড়া যেটা কেউই খেতে পেত না। সেই পিপে থেকে খানিকটা আঙুর-রস খেয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে-চাটতে সিংহ বলল, “মনে হচ্ছে এটাই আসল আঙুর-রস।” তার পর চাকরকে বলল সেই আঙুর-রস ছটা বোতলে ভরতে।
সিঁড়ি দিয়ে সবাই উঠল উপরে। কিন্তু খোলা বাতাসে পৌছে সিংহর মাথা ঘুরতে আর পা টলতে লাগল। তাই সিংহের বদলে চাকরকেই সরাইখানায় নিয়ে যেতে হল আঙুর-রসের বোতলগুলো। তার পর সিংহ সেগুলো নিয়ে গেল তার প্রভুর কাছে।
শিকারী তখন সরাইখানার মালিককে বলল, “এই দেখো। রাজা যে রুটি, মাংস, তরিতরকারি, মিষ্টি আর আঙুর-রস খান—তার সবগুলোই আমার রয়েছে। এবার তাই আমার প্রিয় জন্তুদের সঙ্গে ডিনারে বসি।” এই-না বলে খাবার টেবিলের সামনে গিয়ে বসল। খরগোশ, শেয়াল, নেকড়ে, ভালুক আর সিংহর সঙ্গে। পেট ভরে খাওয়া-দাওয়া তারা করল। শিকারীর মন-মেজাজ তখন খুব ভালো। কারণ তার মনে হল—রাজকন্যে তাকেই তখনো ভালোবাসে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সরাইখানার মালিককে শিকারী বলল, “রাজা যা খান সেই—সব খাবার-দাবার খেলাম। এবার রাজসভায় গিয়ে রাজকন্যেকে বিয়ে করব।”
সরাইখানার মালিক বলল, “তা কী করে সম্ভব। রাজকন্যে নিজেই তো তার বর ঠিক করে রেখেছে।”
ড্রাগন-পাহাড়ে রাজকন্যে যে-রুমাল তাকে দিয়েছিল তাতে জড়ানো ছিল ড্রাগনের সাতটা জিভ। সেটা তখন বার করে শিকারী বলল, “এটাতেই কাজ হবে।”
রুমালটা দেখে সরাইখানার মালিক বলল, “আর যাই বিশ্বাস করি-না-কেন, তোমার এ কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। উঠোন সমেত আমার বাড়ি বাজি ধরছি।”
শিকারী তখন হাজার মোহর-ভরা একটা থলি বার করে বলল, “যা বললাম তাই করব। এই মোহরগুলো বাজি ধরলাম।”
এদিকে খাবার টেবিলের সামনে খেতে বসে মেয়েকে রাজা প্রশ্ন করলেন, “যে-বুনো-জানোয়ারগুলো আমার প্রাসাদে আনাগোনা করেছিল, তোমার সঙ্গে তাদের কী দরকার ছিল?”
রাজকন্যে বলল, “সে কথা তোমাকে বলতে পারব না। কিন্তু জন্তুদের প্রভুকে তুমি ডেকে পাঠাও। তাকে দেখলে তুমি খুশিই হবে।” সেই বিদেশী লোকটিকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাজা তাঁর ভৃত্যকে পাঠালেন সরাইখানায়।
সরাইখানার মালিককে শিকারী বলল, “দেখছ তো, ভোজসভায় নেমন্তন্ন করে রাজা তার চাকরকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বিনা জাকজমকে আমি যাচ্ছি না।” তার পর ভূত্যের দিকে ফিরে সে বলল, “রাজাকে বোলো আমার জন্যে রাজপোশাক ছ-ঘোড়ায়-টানা একটা জুড়িগাড়ি আর সাজপোশাক পরাবার এক চাকরকে পাঠাতে।”
কথাটা শুনে মেয়েকে রাজা প্রশ্ন করলেন, “কী করব?”
রাজকন্যে বলল, “সে যা বলছে তাই কর। রাজমর্যাদায় সে আসুক। তাতে তুমি খুশিই হবে।”
রাজকন্যের কথামতো রাজা পাঠালেন রাজপোশাক, ছ-ঘোড়ায়টানা একটা জুড়িগাড়ি আর সাজপোশাক পরাবার এক ভূত্যকে।
তাদের আসতে দেখে সরাইখানার মালিককে শিকারী বলল, “এই দেখো—যেরকম চেয়েছিলাম সেইরকম জাকজমক করেই আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।” এই-না বলে রাজপোশাক পরে, ড্রাগনের কাটাজিভ-জড়ানো রুমালটা নিয়ে জুড়িগাড়ি চেপে শিকারী গেল রাজার সঙ্গে দেখা করতে।
তাকে আসতে দেখে রাজা তার মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, “ওকে কী ভাবে অভ্যর্থনা করব?”
রাজকন্যে বলল, “তুমি নিজে গিয়ে ওকে নিয়ে এসো। তাতে তুমি খুশিই হবে।”
রাজকন্যের কথামতো নিজে গিয়ে রাজা তাকে আদর-আপ্যায়ন করে রাজপ্রাসাদের মধ্যে নিয়ে এলেন। শিকারীর পিছন-পিছন এল তার জন্তরা।
খাবার টেবিলের সামনে রাজা আর রাজকন্যের মাঝখানে সে বসল। উলটো দিকে ভাবী বরের আসনে বসল মারশাল।
তার পর আনা হল ড্রাগনের সাতটা মুণ্ড। সেগুলো দেখিয়ে রাজা বললেন, “আমার মারশাল ড্রাগনের এই সাতটা মাথা কেটেছে। তাই আজ আমার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিচ্ছি।”
শিকারী তখন দাঁড়িয়ে উঠে সেই সাতটা মুণ্ড-র মুখ খুলে প্রশ্ন করল, “ড্রাগনের সাতটা জিভ কোথায় গেল?”
কথাটা শুনে মারশাল-এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভেবে পেল না কী উত্তর দেবে? শেষটায় তোৎলাতে-তোৎলাতে সে বলল, “ড্রাগনের জিভ থাকে না।”
শিকারী বলল, “তাই নাকি! মিথ্যুকদের জিভ থাকা উচিত নয়। কিন্তু ড্রাগনের জিভ হচ্ছে বিজয়ীর প্রতীকচিহ্ন।” এই-না বলে রুমাল থেকে সেই সাতটা জিভ বার করে ড্রাগনের কাটা-মুণ্ডুগুলোর মুখের মধ্যে সে দিল বসিয়ে। তার পর রুমালে ছুঁচের কাজ-করা রাজকন্যের নাম দেখিয়ে সে প্রশ্ন করল, “রুমালটা কার?” রাজকন্যে বলল, “ড্রাগনকে যে মেরেছে তার।”
তার পর শিকারী তার জন্তুদের ডেকে তাদের কাছ থেকে নিল প্রবালের গুটিগুলো আর সিংহের গলা থেকে খুলল সোনার বকলস্টা। রাজকন্যেকে সেগুলো দেখিয়ে সে প্রশ্ন করল, “এগুলো কার?”
রাজকন্যে বলল, “হার আর সোনার বকলস্টা আমার। কিন্তু সেসব জন্তু ড্রাগনটাকে মারতে সাহায্য করেছিল তাদের আমি এগুলো দিয়ে দিয়েছিলাম।”
শিকারী বলল, “লড়াই করার পর আমি যখন ঘুমিয়ে পড়ি মার্শাল তখন এসে আমার মুণ্ড কেটে ফেলে। তার পর রাজকন্যেকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে বলে—ড্রাগনকে মেরেছে সে। সে যে মিথ্যে কথা বলেছিল সেটা আমি প্রমাণ করতে পারি এই রুমাল, হার আর জিভগুলো দিয়ে।” তার পর সে জানাল কেমন করে খরগোশ সেই আশ্চর্ষ লতা দিয়ে তাকে বাঁচায়, কেমন করে এক বছর ধরে সে ঘুরে বেড়ায় আর তার পর কেমন করে শহরে ফিরে সরাইখানার মালিকের কাছে সে শোনে মার্শাল-এর ছলনার কথা ৷
রাজা তার মেয়েকে প্রশ্ন করলেন, “এ-সব কথা কি সত্যি? সত্যই ; কি এ ড্রাগনকে মেরেছিল?”
রাজকন্যে বলল, “হ্যাঁ, অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এখন আমি মারশাল-এর বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলতে পারি। কারণ তার মুখোশ খোলার ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই। আর আমি যে কথা দিয়েছিলাম এক বছর চুপচাপ থাকব—সে-প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করি নি। এ-কারণেই বলেছিলাম এক বছর আমার বিয়ে পিছিয়ে দিতে।”
সঙ্গে সঙ্গে রাজা তার বারোজন মন্ত্রীকে ডেকে বললেন মারশাল-এর বিচার করতে। বিচার করে তারা শাস্তি দিল—বুনো ষাঁড় দিয়ে মারশালুকে টুকরো-টুকরো করে ফেলার। তার পর রাজা তার মেয়ের বিয়ে দিলেন শিকারীর সঙ্গে আর তাকে করলেন গোটা রাজ্যের শাসক। খুব ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। নতুন তরুণ রাজা তখন তার বাবা অার পালক-বাবাকে আমন্ত্রণ করে দিল অনেক ধনদৌলত। তার: বন্ধু, সেই সরাইখানার মালিকের কথাও সে ভুলল না। তাকে সে বলল:
“দেখলে তো, বন্ধু, যা-যা বলেছিলাম সব ফলে গেছে। রাজকন্যেকে আমি বিয়ে করেছি আর রাজা তার রাজত্ব দিয়ে দিয়েছেন আমাকে। তুমিও বাজি হেরেছ ৷ উঠোন সমেত তোমার বাড়িটা এবার আমায় দিয়ে দিতে হয়।”
সরাইখানার মালিক বলল, “হ্যাঁ, ন্যায্যত সেগুলো তুমি দাবি করতে পারো।”
কিন্তু তরুণ রাজা বলল, “তোমার বাড়ি আর তোমার উঠোন তোমারই থাকুক। তার ওপর তোমায় উপহার দিলাম হাজার মোহর।”
তরুণ রাজা আর তরুণী রানী মহানন্দে দিন কাটাতে লাগল। তরুণ রাজা প্রায়ই শিকারে বেরুত তার বিশ্বস্ত জন্তুদের নিয়ে। কারণ: শিকার করাই ছিল তার প্রধান আনন্দ। কাছেই ছিল একটা বন। একবার সেই বনে শিকারে যেতে তার ইচ্ছে হল। কারণ সেই বনের পথ গোলক ধাঁধার মতো বলে কেউ সেখানে শিকার করতে যেত না। অনেক অনুরোধ-উপরোধ করতে শেষটায় সেখানে শিকারে যাবার অনুমতি বুড়ো রাজা দিলেন। আর এক সকালে অনেক লোক-লশকর নিয়ে, সে ঘাল্লা করল। বনে পৌছে সে দেখে দুধের মতো ধবধবে ভারি সুন্দর এক হরিণী। সেখানে তার অনুচরবগকে অপেক্ষা করতে বলে সেই হরিণীর পিছু সে নিল। সঙ্গে চলল শুধু তার জন্তুর দল। সন্ধে পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করলে তার লোকজন। কিন্তু তখনো সে না ফেরায় তার লোকজন বাড়ি ফিরে তরুণী রানীকে জানাল—এক জাদুর বনে এক সাদা হরিণীর পিছু নিয়েছে তরুণ রাজা। তার পর আর ফেরে নি। খবর শুনে তার জন্য তরুণী রানীর ভীষণ ভাবনা হল। এদিকে তরুণ রাজা তাড়া করে যাচ্ছিল সেই সুন্দর হরিণীকে। আর যেই সে নাগালের মধ্যে আসে আর গুলি ছোড়ার জন্য তরুণ রাজা বন্দুক তোলে অমনি হরিণী দূরে হয়ে যায় অদৃশ্য। এইভাবে যেতে যেতে শেষটায় হরিণী একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তখন তরুণ রাজা দেখে সে চলে এসেছে গভীর বনে। তাই অনুচরবগকে ডাকার জন্য সে তার শিঙা বাজাল। কিন্তু তারা কেউ শুনতে পেল না। তখন রাত হয়ে গেছে। তাই সে এক গাছতলায় আগুন জ্বেলে স্থির করল সেখানেই রাত কাটাবে। আগুনের পাশে সে বসে আর চার পাশে তার জন্তুরা শুয়ে—এমন সময় তার মনে হল যেন মানুষের স্বর শুনতে পাচ্ছে। উপর দিকে তাকিয়ে সে দেখে গাছে এক বুড়ি বসে। বুড়ি ক্ৰমাগত কাতরাচ্ছিল:
“হি-হি-হি। কী ঠাণ্ডা। জমে গেলাম। জমে গেলাম।”
তরুণ রাজা বলল, “শীত করছে তো নেমে এসে আগুন-তাতে বোসো।”
বুড়ি বলল, “না-না। নামলে তোমার জন্তুরা আমায় কামড়াবে।”
“না বুড়িমা! ওরা কামড়াবে না। নেমে এসো।” বুড়িটা আসলে শয়তান ডাইনি। সে বলল, “গাছের সরু একটা ডাল ফেলছি। সেটা দিয়ে জন্তুগুলোর পিঠে মারলে ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।” এই-না বলে গাছের সরু একটা ডাল বুড়ি ফেলল আর সেটা জন্তুদের পিঠে তরুণ রাজা ঠেকাতেই তারা হয়ে গেল পাথর। বুড়ি যখন দেখল জন্তুরা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না তখন সে গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে সেই ডাল দিয়ে তরুণ রাজাকে মেরে তাকেও পাথর করে দিল। আর তার পর খিলখিল করে হেসে উঠে তাকে আর তার জন্তুদের টেনে নিয়ে গিয়ে সে ফেলল একটা গর্তে। সেই গর্তে ছিল আরো অনেক পাথর।
রাজা না ফেরায় রানীর দুর্ভাবনা আরো বেড়ে গেল। এখন হল কি, ছাড়াছাড়ি হবার সময় অন্য যে ভাই পশ্চিম দিকে গিয়েছিল—সে পৌছল সেই রাজ্যে। সে চাকরির খোঁজে ছিল। কিন্তু কোনো চাকরি পায় নি। পথে-পথে জন্তুদের নাচিয়ে নানা দেশে সে ঘুরে বেড়ায়। একদিন তার ইচ্ছে হল ছাড়াছাড়ি হবার সময় যে-ছুরিটা তারা গাছে গেঁথেছিল সে-ছুরিটা দেখে জানা—তার ভাই কেমন আছে। গাছটার কাছে গিয়ে সে দেখে ছুরিটায় তার ভাইয়ের দিকের আধখানায় মর্চে ধরেছে, আর আধখানা রয়েছে চকচকে। দেখে ভয় পেয়ে আপন মনে সে বলে উঠল, “ভাই নিশ্চয়ই খুব বিপদে পড়েছে। এখনো হয়তো তাকে আমি সাহায্য করতে পারি—কারণ ছুরির অর্ধেকটা চকচকে রয়েছে।” জন্তুদের নিয়ে যেতে-যেতে সে পৌছল সেই শহরের সিংহদ্বারে। তাকে দেখে প্রহরী জানতে চাইল—তার আসার কথা রানীকে জানাবে কি না। কারণ এতদিন না ফেরায় রানী খুব উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। ভেবেছেন জাদুর বনে তার মৃত্যু ঘটেছে। প্রহরী ভেবেছিল সে-ই তাদের
তরুণ রাজা। কারণ তার চেহারা হুবহু তরুণ রাজার মতো। তার সঙ্গের জন্তুরও হুবহু এক। সে বুঝল প্রহরী নিশ্চয়ই তার ভাইয়ের কথা বলছে। তাই ভাবল, ‘এখন এদের ভুল না ভাঙাই ভালো। তাতে আমার ভাইকে বাঁচানো অনেক সহজ হবে। এই-না ভেবে প্রহরীর পিছন-পিছন সে গেল রাজপ্রাসাদে। তাকে দেখে সবাই খুশি। তরুণী রানী ভাবল, সে-ই তার বর। তাকে প্রশ্ন করল, “ফিরতে এত দেরি হবার কারণ কী।” সে বলল, “বনে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হয়েছিল বুঝি কোনোদিনই বেরুতে পারব না।” রাতে সে গেল শোবার ঘরে। কিন্তু তরুণী রানী আর তার নিজের মাঝখানে রাখল একটা তরেয়াল। সেটা দেখে রানী তো অবাক। কিন্তু কারণটা জিগগেস করতে তার ইচ্ছে হল না। এইভাবে দিন কয়েক কাটল আর সেই সময়ের মধ্যে জাদুর বন সম্বন্ধে সে নিল নানা খোঁজ-খবর। শেষটায় একদিন সে বলল, “ঐ বনে আবার আমি শিকার করতে যাব।” বুড়ো রাজা আর তরুণী রানী তাকে অনেক করে বারণ করল। কিন্তু কারুর কথাই সে শুনল না। লোক-লশকর নিয়ে সে পড়ল বেরিয়ে।
বনে পৌছতে তার বেলাতেও ঘটল একই ঘটনা। সে-ও দেখতে পেল সেই সাদা হরিণীকে। না ফেরা পর্যন্ত লোক-লশকরদের সেখানে থাকতে বলে হরিণীকে সে তাড়া করে চলল। জন্তরা ছুটল তার পিছনপিছন। কিন্তু কিছুতেই হরিণীর নাগাল সে পেল না। আর শেষটায় গভীর বনে পথ হারিয়ে বাধ্য হল সেখানে রাত কাটাতে। আবার সেই -বুড়ি ডাইনি গাছে বসে কাতরাতে লাগল:
“হি-হি-হি কী ঠাণ্ডা। জমে গেলাম। জমে গেলাম।”
সে বলল, “শীত করছে তো নেমে এসে আগুন-তাতে বোসো।”
বুড়ি বলল, “না-না। নামলে তোমার জন্তরা আমায় কামড়াবে।”
সে বলল, “না বুড়িমা! ওরা কামড়াবে না। নেমে এসো।”
কিন্তু আগের বারের মতোই বুড়ি বলল, “গাছের সরু একটা ডাল ফেলছি। সেটা দিয়ে জন্তুদের পিঠে মারলে ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
বুড়ি ডাইনির কথা শুনে শিকারীর সন্দেহ হল। সে বলল, “আমার জন্তুদের পিঠে মারব না। নেমে এসো, নইলে জোর করে তোমায় নামাব।”
বুড়ি বলল, “ইচ্ছে হলে আমাকে গুলি করতে পার। তোমার বুলেটে আমার কিছুই হবে না।”
টিপ করে সে বুড়িকে গুলি করল। কিন্তু সাঁসের বুলেটে ডাইনির গায়ে আঁচড়টি লাগল না।
কান ফাটিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে সে বলল, “আমাকে মারতে -পারবে না। আবার চেষ্টা করে দেখো।”
শিকারীর মাথায় তখন একটা ফন্দি এল। একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে কোটের রুপোর বোতামগুলো ছিড়ে সে ভরল তার বন্দুকে। তার পর গুলি চালাল বুড়ি ডাইনির উপর। রুপোর গুলি থেকে বাঁচবার তুকতাক ডাইনি জানত না। চেঁচাতে-চেঁচাতে গাছ থেকে সে পড়ল হড়মুড়িয়ে। ডাইনিকে পা দিয়ে চেপে শিকারী বলল, “আমার ভাইয়ের কী করেছিস বল। না বললে দু হাতে তোকে ধরে আগুনে ছুঁড়ে ফেলব।”
ভীষণ ভয় পেয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ভাইনি বলল, “একটা গর্তেরমধ্যে জম্ভদের সঙ্গে পাথর হয়ে সে পড়ে আছে।”
বুড়িকে সে বাধ্য করল সেই গর্তটার কাছে তাকে নিয়ে যেতে। তার পর বলল, “শয়তানী! এক্ষুনি আমার ভাই, সব লোকজন আর জন্তুদের রক্ত-মাংসের শরীর ফিরিয়ে দে। নইলে তোকে আগুনে পুড়িয়ে মারব।”
একটা ডাল নিয়ে বুড়ি ডাইনি ছোয়াল পাথরগুলোয়। আর সঙ্গে সঙ্গে তার ভাই, জন্তুগুলো আর সব লোকেরা ফিরে পেল নিজেদের দেহ। অন্য সব লোকজনের মধ্যে ছিল বণিক, রাখাল আর নানা শিক্ষানবিশ ৷ প্রাণকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খুশি মনে যে যার পথে চলে গেল।
যমজ ভাইরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে আনন্দে উঠল চেঁচিয়ে। তার পর বুড়ি ডাইনির হাত-পা বেঁধে তাকে তারা ফেলল আগুনে। ডাইনি যখন পুড়ে মরছে তখন সমস্ত বন আলোয় আলো হয়ে গেল আর মাইল কুড়ি দুরে তারা দেখতে পেল রাজপ্রাসাদ। সেই আলোয় পথ চিনে তারা ফিরে চলল বাড়ির দিকে। আর যেতে-যেতে তারা বলল নিজেদের এ্যাডভেঞ্চারের কথা। রাজা-ভাই জানাল, সে হয়েছে বুড়ো রাজার গোটা রাজ্যের শাসক। ভবঘুরে-ভাই বলল, “আমারও তাই মনে হয়েছিল। কারণ শহরে পৌছবার পর আমাকে তুমি বলে লোকে ভুল করে রাজার মতো খাতির করে। তরুণী রানী আমাকে মনে করে তার বর। আমি বাধ্য হই তার পাশে বসে খেতে আর তোমার বিছানায় শুতে।”
এই-না শুনে রাজা-ভাই হিংসের জ্বলে উঠে তরোয়াল খাপ থেকে বার করে কেটে ফেলল ভবঘুরে-ভাইয়ের মুণ্ডু। কিন্তু তাকে রক্তে ভেসে মরে পড়ে থাকতে দেখে দুঃখে-শোকে পাগলের মতো চীৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে সে বলতে লাগল, “হায় হায়। এ কি করলাম। ভাই আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে, আর আমি কিনা তার প্রতিদান দিলাম তাকে খুন করে।” তখন খরগোশ এসে বলল, সেই আশ্চর্য লতা সে নিয়ে আসবে যেটা ছোঁয়ালে সব ক্ষত জোড়া লেগে লোকে বেঁচে ওঠে। এই— না বলে খরগোশ দৌড়ে গিয়ে ঠিক সময়ে নিয়ে এল সেই লতা আর বেঁচে উঠল ভবঘুরে-ভাই। ক্ষতের কোনো চিহ্ন তার শরীরে রইল না। তার পর আবার তারা যেতে শুরু করল। যেতে-যেতে রাজা-ভাই বলল, “তোমাকে দেখতে ঠিক আমার মতো। তোমার গায়েও রয়েছে রাজপোশাক। জন্তরা যেমন আমার পেছনে পেছনে আসে, তোমার পেছন পেছনেও তেমনি যায়। রাজপ্রাসাদের দুই ফটক দিয়ে দুজনে যাওয়া যাক ৷”
এই-না বলে আলাদা হয়ে তারা যেতে শুরু করল। আর তার পর উত্তর আর দক্ষিণের সিংহদ্বারের দুই প্রহরী একই সঙ্গে বুড়ো রাজাকে গিয়ে জানাল তরুণ রাজা শিকার থেকে ফিরেছে তার জন্তুদের নিয়ে।
রাজা বললেন, “তা কী করে সম্ভব? ফটক দুটো তো অনেক মাইল দূরে-দূরে ”
আর সেই মুহুর্তে দুই ভাই রাজপ্রাসাদের আঙিনায় পৌছে একই সঙ্গে লাগল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে।
মেয়েকে বুড়ো রাজা বললেন, “তোর কে বর চিনতে পারিস? দুজনকেই হুবহু একরকম দেখতে। আমি তো চিনতে পারছি না।”
তরুণী রানী তখন পড়ল, মহা ফ্যাসাদে। কারণ সে-ও তার বরকে চিনতে পারল না। শেষটায় তার মনে পড়ল প্রবালের যে-গুটিগুলো জন্তুদের দিয়েছিল সেগুলোর কথা। আর সিংহের কেশর হাতড়ে সে খুঁজে পেল সোনার সেই বকলস্। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, “এই সিংহ যার পেছনে পেছনে যাবে সে-ই আমার বর।”
রাজা-ভাই হেসে উঠে বলল, “রানী ঠিকই চিনেছে।” আর তার পর সবাই একসঙ্গে আবার টেবিলের সামনে বসে মনের আনন্দে করল খাওয়া-দাওয়া।
রাতে তরুণ রাজা বিছানায় শোবার পর তার বউ প্রশ্ন করল, গতবার শোবার সময় আমাদের মাঝখানে একটা খোলা তরোয়াল রাখতে কেন? ভেবেছিলাম তুমি আমাকে খুন করতে চাও।”
তরুণী রানীর কথা শুনে তরুণ রাজা তখন বুঝল তার ভবঘুরেভাই কত বিশ্বস্ত আর কত ভালো।
0 coment�rios: