Home Top Ad

Responsive Ads Here

Search This Blog

    এবার শীতে পুপসিদের মধুপুরের বাড়ি সরগরম। কে না এসেছে! বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মাসতুতো দিদি মুনা, মামাতো বোন কঙ্কা, টুকটুকি, এমনকি চ...

বুড়ির ভূত - সুচিত্রা ভট্টাচার্য

    এবার শীতে পুপসিদের মধুপুরের বাড়ি সরগরম। কে না এসেছে! বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মাসতুতো দিদি মুনা, মামাতো বোন কঙ্কা, টুকটুকি, এমনকি চরম কাজের মানুষ ভানুমামাও। এত লোকজন দেখে বাড়ির কেয়ারটেকার ত্রিভুবনের মুখে হাসি আর ধরে না।
    আসেনি শুধু পুপসির দিদি খুকু। সদ্য খবরের কাগজের অফিসে চাকরি পেয়েছে সে, বেজায় ব্যস্ত থাকে দিনরাত। এই ফিচার, ওই রিপোর্টিং, এখানে যাওয়া, সেখানে ছোটা...। মধুপুর যাওয়ার প্রস্তাব শুনে নাক কুঁচকেছিল খুকু, অফিসের রোমাঞ্চকর কাজকর্ম ছেড়ে পাণ্ডববর্জিত পুরীতে বেড়াতে আসার তার কোনও বাসনাই নেই।
    হ্যাঁ, পাণ্ডববর্জিত পুরীই বটে। পাঁচিলঘেরা পেল্লাই বাড়ি, চতুর্দিকে আম, জাম, বেল, নিম, শাল, মহুয়ার মিনি জঙ্গল। স্টেশন থেকে বাড়িটা বেশ দূর, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আশেপাশে আরও খানকয়েক এরকম পুরোনো পুরোনো বাগানবাড়ি আছে বটে, কোনওটাতেই জনমনিষ্যি নেই। এ বাড়িতেও মানুষ বলতে দুজন। ত্রিভুবন আর তার বউ বাসস্তী। তারা থাকে সেই পাঁচিলের ধারে, আউট হাউসে। মাঝে মাঝে ঝাড়াবুড়ি করা ছাড়া পুপসিদের এই দোতলা বাড়িটা প্রায় খোলাই হয় না।
    পুপসিদের ট্রেন মধুপুর পৌছেছিল বিকেল তিনটেয়। ত্রিভুবনকে আগেই খবর দেওয়া ছিল, সার সার ঘর খুলে রেখেছে সে। স্থানীয় একটা লোককে ধরে গোটা বাড়ি ঝকঝকে তকতকে করে ফেলেছে। ডিসেম্বরের শেষ। দিন এখন খুব ছোট। পৌছে হাত-পা ছড়াতে না ছড়াতেই সন্ধে। উঁহু, হাতপা ছড়ানোর উপায় কোথায়? জব্বর ঠান্ডা এখানে, শাল, সোয়েটার, টুপি, মোজা, গ্লাভস যে যা পারছে গায়ে চাপিয়ে ফেলছে। তবু শীতের হাত থেকে নিস্তার নেই, হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি ধরে যায়। এদিকে বিজলিবাতিও নেই। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে ত্রিভুবন। তবে কেউ এখন নিজের ঘরে নেই, সব্বাই জড়ো হয়েছে দোতলার হলটায়। জোর হৈ-হল্লা চলছে। গল্প-হাসি-গান... বাসস্তী এসে আর এক প্রস্থ চা দিয়ে গেল। ছোটদের জন্য গরম গরম খাঁটি গরুর দুধ। গরুও খাঁটি, দুধও খাঁটি, খাওয়ার পর গোঁফে ইয়া পুরু দুধের সর লেগে থাকে।
    পুপসির দিদা প্রীতিলতা অনেকক্ষণ ধরেই রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য উসখুস করছিলেন। জিগ্যেস করলেন বাসন্তীকে,—হ্যাঁ রে, আজ রাতে কী খাবার?
    লুচি, বেগুনভাজা, আলুচচ্চড়ি আর পেঁড়া।
    ব্যস? মুরগি-টুরগি কিছু হচ্ছে না?
    মেনু ঠিক করার দায়িত্ব ভানুমামার। তাকে এবার টিমের ম্যানেজার করা হয়েছে। এসেই একটা সাইকেল জুটিয়ে সে বাজারে ছুটেছিল, নিয়ে এসেছে গাদাখানেক ময়দা, ঘি, আলু, বেগুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ, আর মধুপুরের বিখ্যাত পেঁড়া। দোকানেই সে খান আষ্টেক পেঁড়া সাটিয়েছে, বাড়ি আসতে আসতে আরও গোটা পাঁচেক।
    ভানু গভীর ভাবে বলল, না মাতাস্ত্রী। আজ সারাদিন প্রচুর উল্টোপাল্টা খাওয়া হয়েছে, রাত্তিরবেলা শুধু লুচি-চচ্চড়িই ভালো।
    প্রীতিলতা ঘোর আমিষাশী। মুখ বাঁকা করে বললেন, আহ, বেড়াতে এসে মুরগি-মাটন ছাড়া মুখে রোচে?
    পুপসি মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার সামনে আমিষ খাওয়ার গল্প করলেও সে আহত হয়। দিদাকে জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলল, দ্যাখো দিদা, প্রাণীহত্যা মহাপাপ। এই যে তোমরা মুরগি-ভেড়া জবাই করো, জানো তাদের আত্মারা তোমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়? তোমাদের অভিশাপ দেয়?
    মুনা খিলখিল হেসে উঠল, মুরগিভূত? ভেড়াভূত?
    ঠাট্টা করো না মুনাদিদি। ভেবো না স্কুলে পড়াচ্ছ বলে সব জেনে গেছ! পুপসি রীতিমতো গোমড়া, মানুষ মরে ভূত হতে পারে, জীবজন্তুরা পারে না?
    কঙ্কা শীতে জড়োসড়ো হয়ে পুপসির মায়ের গা ঘেঁষে বসে। কাঁদো কাঁদো মুখে সে বলে উঠল, আবার ভূত-টুতের কথা বলছ কেন?
    মুনা বলল, ওমা, কী বোকা রে তুই ভূতের ভয় পাচ্ছিস?
    পুপসির দাদু ধীশঙ্কর বললেন, ভূতকে কে না ভয় পায়?
    কেন ভয় পাও? তুমি কি কখনও ভূত দেখেছ?
    দেখেছি বৈকি। ধীশঙ্কর ভালো করে গায়ে শালটা জড়িয়ে নিলেন, জানিস তো, একসময়ে আমার কীরকম ফুটবলের নেশা ছিল। মোহনবাগান ক্লাবে না গিয়ে একদিনও থাকতে পারতাম না। একদিন ক্লাব থেকে বেরিয়ে আমি আর আমার বন্ধু দরবারি ধর্মতলার দিকে যাচ্ছি...ময়দানের মধ্যে দিয়ে গেলে অনেকটা শর্টকাট হয়, ময়দান ধরেই চলেছি..ঘুরঘুট্টে অন্ধকার, বেশ তাড়াতাড়িই মাঠটুকু পার হচ্ছিলাম আমরা, তখনই স্পষ্ট পেছনে একজনের গলা, দাদা, আপনাদের কাছে কালকের মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের টিকিট হবে? চমকে তাকিয়েছি দুজনে। ওমা, দেখি কেউ কোথথাও নেই। ভাবলাম আমাদের শোনার ভুল। আবার দু’পা এগিয়েছি, আবার এক প্রশ্ন! ঘুরলাম, কেউ নেই। তারপর এক পা করে হাঁটছি, আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছি। গলার স্বরটা সঙ্গে সঙ্গে আসছে, কিন্তু ধারেকাছে একটি প্রাণীও নেই। আমরা দুই বন্ধু ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলাম। হাঁটুতে হাঁটু লেগে যাচ্ছে। দরদর ঘামছি..
    মুনা কাঁধ ঝাঁকাল, এতে কী প্রমাণ হয়? তোমরা দেখতে তো কাউকে পাওনি!
    তা পাইনি। কিন্তু...
    কী কিন্তু? আজব এক কাণ্ড হল। আমাদের পকেটে তখন সত্যি সত্যি টিকিট ছিল, আমি আর দরবারি যুক্তি করে একটা টিকিট ঘাসে ফেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে জোর বাতাসের ঝাপটা এল একটা, আর টিকিটটা সে করে উড়ে চলে গেল। ব্যস, তারপর ওই গলাও থেমে গেছে। আর নো প্রশ্ন, নো রিকোয়েস্ট ...এটাকে কি ভূতের এভিডেন্স বলা যায় না?
    টুকটুকি দাদুর হাঁটু চেপে ধরেছে, ভূতের গল্প থাক না দাদু।
    কিন্তু ভূতের গল্প একবার শুরু হলে আর কি থামে? তার ওপর যদি এমন একটা শীতের রাত হয়, যেখানে আলো-আঁধার মিশে একটা আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি করেছে?
    দেখা গেল ঘরের অনেকেই কখনও না কখনও দেখা পেয়েছে ভূত-পেত্নিদের। পুপসির বাবা নাকি একবার এক সাইকেল ভূতের পাল্লায় পড়েছিল। পুপসির ঠাকুমা পড়েছিলেন মেছো ভূতের কবলে। প্রীতিলতাকে নাকি একবার মাদ্রাজি পেত্নি তাড়া করেছিল, প্রাণপণে পো পো করে তিনি তাকে বিদায় করেছিলেন। ভাগ্যিস প্রীতিলতার জানা ছিল তামিলে পো’ মানে যা’। পুপসির মাও বাদ যায়নি, সে নাকি একবার এক ব্রহ্মদত্যির খপ্পরে পড়েছিল। ভারী ছিচকে ছিল ভূতটা। আসানসোলে থাকার সময়ে সুমিত্রা একটু অন্যমনস্ক হলেই নাকি কলাটা মুলোটা হাপিশ করে দিত পাশের বেলগাছের ব্রহ্মদত্যি।
    একমাত্র দেখা গেল পুপসির ঠাকুরদা নিখিলনাথেরই কপাল খারাপ। তার চোখের জ্যোতি বরাবরই ক্ষীণ, সে জন্যই নাকি তার এ জীবনে ভূতের দর্শন পাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই নিয়ে মৃদু আফসোসও আছে তার।
    ভানুমামা আর মুনা ভূতের গল্প শুনতে শুনতে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
    ভানু বলল, আরে ছোঃ। তোমরা কখনও সাহসী লোকদের ভূত দেখতে দেখেছ? সঙ্গে সঙ্গে মুনা সায় দিল, ঠিক ঠিক। ভূত শুধু ভীতু মানুষদেরই দেখা দেয়। ভূত মানুষের মনের ভুল। দুর্বলতা।
    পুপসি চেঁচিয়ে উঠল, মোটেই না। ভূত সব্বাইকে দেখা দেয়। আমার কাছে একদিন একটা হরিণের ভূত এসেছিল। জলে ভরা কী করুণ দুটো চোখ! অবিকল মানুষের গলায় বলল, তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন গো? বিনা কারণে কেন আমাদের মেরে ফেলো?
    পেছন পেছন কোনও বাঘের ভূত আসেনি? হরিণের ভূতটাকে খেতে? ভানু অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, তোদের মতো লেবদুসকে নিয়ে আর পারা যায় না। ভয় পেয়ে পেয়ে তুই যেন কেমন কেবলি হয়ে গেছিস।
    ত্ৰিভুবন দরজায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সে বলে উঠল, অমন কথা বলো না ভানুদাদা, তেনারা শুনলে রাগ করবেন।.জানো, এ বাড়ির বাগানেও তেনারা আছেন!
    তাই নাকি? ক’জন আছে?
    একজন তো প্রায়ই দেখা দেন। এক বুড়ি। ওই কুয়োপাড়ের আমগাছটায় গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেন এখানে এসে মরল কে জানে, হঠাৎ একদিন সকালে কুয়োর জল তুলতে গিয়ে দেখি...
    তুমি কি সেই দশ বছর আগের ঘটনাটা বলছ? পুপসির ঠাকুমা সাত্ত্বনা জিগ্যেস করলেন, সেই বুড়িটা এখানেই কোন গাঁয়ে থাকত না?
    হ্যাঁ মা, ঠিকই ধরেছেন। ছেলেরা দেখত না মাকে, বড় দুঃখী ছিল বুড়িটা। সে যে ভূত হয়ে এখানে আছে আগে বলোনি তো? আপনারা ভয় পাবেন বলে বলিনি। দেখেননি, আপনারা এখানে এলে আমি আপনাদের সন্ধের পর কুয়োতলায় যেতে বারণ করি? সে তো ওই বুড়ির জন্যই। ছেলে দুটো গিয়ে যদি গয়ায় পিণ্ডি চড়িয়ে আসত, তাহলে হয়তো বুড়ি শান্ত হত। এখন তো ফি পূর্ণিমা-অমাবস্যাতেই আসছে।
    এসে কী করে? ভানু চোখ ঘোরাল, হাঁউমাউখাঁউ মানুষের গন্ধ পাউ বলে?
    না গো দাদা, খালি কাঁদে। ছেলেপিলেরা অবহেলা করলে মায়ের মরে গিয়েও যে দুঃখ যায় না গো ...মাঝে মাঝে অবশ্য ডাকেও যেন কাকে। মনে হয় ছেলেদেরই।
    বেশ জম্পেশ গপ্লোটা ফেঁদেছ তো? ভানু খ্যাক খ্যাক হাসছে, তা অমাবস্যাটা কবে? তেনাকে কি দেখা যাবে?
    যেতেই পারে। কালই তো অমাবস্যা। না না, আজই তো পড়ে গেছে। বাহ। তা এলে আজ একবার ডেকো। বুড়ির সঙ্গে একটু গপ্পোসপ্পো করা যাবে। চাই কি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি ওকে স্বর্গের রাস্তাটাও দেখিয়ে দিতে পারি।
    গল্পে গল্পে রাত বাড়ছে। পথশ্রমে সকলেই আজ অল্পবিস্তর ক্লান্ত, খাওয়ার ডাক পড়তেই সবাই মিলে ছুটেছে একতলায়। আহারপর্ব চুকিয়েই যে যার মতো কাঁপতে কাঁপতে ঢুকে পড়েছে লেপ-কম্বলে ।
    দোতলার একটা ঘরে মুনা-পুপসি শুয়েছে। পাশের ঘরে ভানুমামা। কঙ্কা-টুকটুকি ভয়ে বেজায় কাতর, তাদের মা-বাবা সঙ্গে আসেনি বলে কোথাও তারা ভরসা পাচ্ছে না। দুজনে গুটিসুটি আশ্রয় নিয়েছে দাদু-ঠাকুমার খাটে।
    গভীর রাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল পুপসির। কেমন যেন একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে! কান পাতল। শব্দ কোথায়? এ তো গলার আওয়াজ! কে যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে না?
    মুনাকে ঠেলল পুপসি, এই মুনাদি, ওঠ।...শোন...শুনতে পাচ্ছিস?
    মুনা অতি কষ্টে লেপ থেকে মুখ বার করল, কী শুনব?
    কে যেন... !
    আর বলতে হল না, গলার আওয়াজটা মুনার কানেও পৌছে গেছে। মিহি স্বরে কে যেন আবার ডাকল, মুনা...পুপসি...?
    মুনা পুপসির হাত খামচে ধরল, উরি বাবারে! উরি বাবারে!
    পুপসি ডুকরে উঠল, তখনই বলেছিলাম আত্মা নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করিস না! এখন কী হবে?
    কী করি বল তো?
    রাম নাম কর। রাম নাম কর।
    ঠান্ডা-ফান্ডা সব উবে গেছে। রাম নাম জপ করছে দু'বোন। আশ্চর্য, আওয়াজটাও থেমে গেল!
    একটু বুঝি ধাতস্থ হয়েছে দুজনে, হঠাৎই একটা ধুপ করে শব্দ! মুনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ওটা কী হল রে? বুড়িটা বোধহয় গাছ থেকে নেমে এল। আর কোনও কথা নেই, দুই বোন হুড়মুড়িয়ে ছুটছে পাশের ঘরে, ভানুমামা..ভানুমামা...? ভানুর দরজা ভেজানোই ছিল। আলগা ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে লেপের ভেতর থেকে ভানুর আর্ত চিৎকার, ওরে বাবা রে! এসে গেছে রে! ছেড়ে দাও রে! আর কিছু বলব না রে!
    দুই বোন কোরাসে ডেকে উঠল, ভানুমামা, আমরা। মুনা-পুপসি। তুমিও কি আমাদের মতো ভয় পেয়ে গেছ?
    ও, তোরা। ওমনি তড়াক করে উঠে বসেছে ভানু, দেখলি তো, কেমন ভয় পাওয়ার অ্যাক্টিংটা করলাম!
    ঘরে মৃদু হ্যারিকেনের আলো। মুনা-পুপসি মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
    পুপসি বলল, তুমি কিছু শোননি?
    কী শুনব?..যত্ত সব ভীতুর ডিম!  যা যা, শুয়ে পড় গিয়ে।
    বলেই আবার শোয়ার তোড়জোড় করছে ভানু! কিন্তু লেপে আর মাথা ঢোকাতে হল না। ফের শুরু হয়েছে মিহি স্বরের আহ্বান। এবার রীতিমতো কাছ থেকে। একেবারে স্পষ্ট গলা, ওরে, আমি এসেছি, দরজা খোল। ওরে মুনা-পুপসি.ভানুমামা-আ-আ..
    শেষ সম্বোধনটার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে যেন প্রলয় ঘটে গেল। লেপ-মশারিসুন্ধু হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ে গেছে ভানু। লেপের ভেতর থেকে অবিকল একটা ম্যান-রোল হয়ে চিঁ চিঁ করছে, ওরে, ভানুমামা বলে ডাকে কেন রে? আমি কোন সুবাদে ও বুড়ির মামা হলাম রে?
    মিহি স্বর আর হাঁকাহাঁকিতে থেমে নেই, দুমদাম ধাক্কা দিচ্ছে নীচতলার দরজায়, কী হল, দরজা খোল। আমি আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?
    ভানুর দাঁতকপাটি লেগে গেছে। ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে বলে চলেছে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চলে যা না।
    কী গো, দরজা খুলবে না? আমি কি দরজা ভেঙে ফেলব? এবার রীতিমতো শাসনি, একবার ভেতরে ঢুকি, তোমাদের সবার আমি মজা দেখাচ্ছি।
    সর্বনাশ করেছে। ওরে মুনা, ওরে পুপসি, আর বুঝি রক্ষা নেই। বুড়ি আমার মুন্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলবে!
    বাড়ির সকলেই প্রায় জেগে গেছে। থম মেরে আছে সকলে। যেন কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে চলেছে আন্দাজ করার চেষ্টা করছে। কঙ্কা-টুকটুকি উচ্চৈঃস্বরে কান্না জুড়ে দিল।
    ক্রুদ্ধ মিহি গলা এবার ক্রমশ করুণ, খুলবে না কেউ? আমি যে ঠান্ডায় জমে গেলাম। অনেক তো হল, আর কেন শাস্তি দিচ্ছ?
    আঁইই, এ যে আবার সুর বদলালো! নরম করে ডাকছে! ওরে খুলিসনি, খুলিসনি…
    তবু কে যেন খুলে দিল দরজা। মিহি গলা হাউমাউ করতে করতে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। তীর বেগে উঠে আসছে।
    ভানু অজ্ঞান হয়ে গেল।
    সকলে মিলে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরাল ভানুর। চোখ খুলেই ভানুর প্রথম বুলি, বুড়িটা কোথায়? গেছে?
    খুকু ঝুঁকল মুখের ওপর, আমি বুড়ি কেন হব? আমি খুকু। খুকু। বুড়ি তো তোমার দিদির নাম। সে তো এখন কলকাতায়।
    ভানু চোখ পিটপিট করল, খুকু তুই? তুই কোত্থেকে এলি?
    কলকাতা থেকে। ভাবলাম পেছন পেছন চলে এসে তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিই। মধুপুরে ট্রেন ঢোকার কথা সাড়ে আটটায়, এল সাড়ে বারোটায়। আসানসোলে একটা মালগাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে... !
    খুকু সোজা হয়ে দাঁড়াল। পরনে জিনস, পুলওভার, মাথায় ব্রিটিশ হাট। দেখে কে বলবে এ ছেলে নয়, মেয়ে!
    ঘরভর্তি লোকজনকে ঝাঁঝাল গলায় বলল খুকু, কখন থেকে গেটে এসে চিল্লাচ্ছি..কত কষ্ট করে একটা রিক্সাঅলাকে পটিয়ে-পাটিয়ে স্টেশন থেকে এলাম...কী তোমাদের মরণঘুম, কিছুতেই সাড়া পাওয়া যায় না! শেষে উপায় না দেখে পাঁচিল টপকালাম...জোর জোর দরজা ধাক্কাচ্ছি, তাও তোমরা...
    বলতে বলতে খুকু ফের ভানুর দিকে ঝুঁকেছে, কী ভানুমামা, ভূত ভেবে বসলে? ইশ, তোমাকে আমি এতদিন সাহসী বলে জানতাম...
    ভানু আবার অজ্ঞান। তবে এবার ভয়ে নয়, লজ্জায়।

আশ্বিন ১৪০৭

0 coment�rios: