একবার হুগলি জেলার মৌবাসিয়া গ্রামের হরিপদ কী একটা কাজে কলকাতা গিয়েছিল। ট্রেনের গোলমালে ফিরতে রাত হয়ে গেল। তখন তো এখনকার মতো এমন ইলেকট্রিক ট্রেন ছিল না। কয়লার ইঞ্জিন দেওয়া কাঠের বগি গাড়ি দু ঘন্টার পথ পাঁচ ঘণ্টায় যেত। একে অবেলার ট্রেন। তার ওপর ইঞ্জিনটা কামারকুণ্ডুতে বিগড়ে যাওয়ায় নতুন ইঞ্জিন জুড়ে ট্রেন যখন গুরোপ স্টেশনে এল, রাত্রি তখন দশটা। যাই হোক, হরিপদ যখন ট্রেন থেকে নামল তখন গোরুর গাড়ি, পালকি কিছুই নেই। অগত্যা স্টেশনেই রাতটা কাটিয়ে দেবে ঠিক করে প্ল্যাটফর্মে কাঠের বেঞ্চিতে আরাম করে বসল।
ট্রেন থেকে আরও দু-চারজন যাত্রী নামল। তবে তারা সব কাছাকাছিই থাকে। বীরপুর কোটালপুর, বালিদহ এইসব গ্রামে। তাই তারা যে যার পায়ে হেঁটেই চলে গেল। গেল না শুধু হরিপদ এবং এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধ হরিপদর কাছে এসে বললেন, “আপনি কোন গ্রামে থাকেন ভাই?”
হরিপদ বলল, “আমি থাকি মৌবেসেয়। এখান থেকে চার-পাঁচ মাইল দুর। আপনি?”
“আমি এখানে থাকি না। আমার মেয়ের বাড়ি চোপায়। সেখানেই যাব বলে এসেছিলাম। কিন্তু কপালের ফের।”
‘চোপা’ নাম শুনেই উৎসুক হয়ে হরিপদ বলল, “চোপা! ও তো আমাদের পাশের গ্রাম। ও গ্রামে কোথায় আপনার মেয়ের বাড়ি? জামাইয়ের নাম কী?”
“তুমি কি চিনবে? আমার জামাইয়ের নাম লালমোহন দাশ।”
“লালমোহনকে চিনব না? ওর বিয়েতে, বউভাতে দমভর খেয়েছিলাম। তা আপনি লালমোহনের শ্বশুর যখন, তখন আমার সঙ্গেই যাবেন। কিন্তু মুশকিল হল এই রাতে আরও দু-একজন সঙ্গী থাকলে ভাল হত। মাত্র দুজনে কী করে যাই?” “তা হলে কি সারারাত এখানেই পড়ে থাকতে হবে?”
“তা ছাড়া? তা আপনি বুড়োমানুষ, একা-একা এলেন যখন, সকালের গাড়িতে কেন এলেন না?”
“আমার আজকে আসার কোনও ঠিক ছিল না। অনেকদিন মেয়েটাকে দেখিনি তাই ওর জন্য মনটা খুব ছটফট করছিল।”
“সেইজন্যই হঠাৎই বেরিয়ে পড়লেন, এই তো?”
“হ্যাঁ। ঠিক ধরেছ ভায়া। তা চলো না একটু সাহস করে এগোনো যাক।”
হরিপদ বললে, “সাহস করে না হয় এগোলাম। কিন্তু অত পথ আপনি হেঁটে যেতে পারবেন?”
“কী যে বলো? জানো না মরা হাতি লাখ টাকা। বিশ মন পঁচিশ মন ঘি খাওয়া হাড় আমার। হাঁটাকে আমি ভয় করি না। তবে অন্য কিছুর ভয় করি। তাই একা হেঁটে যেতে সাহস হচ্ছে না।”
হরিপদ বলল, “ওই একই কারণে আমিও তো যেতে চাইছি না। তবে অন্য কিছু বলতে কাছে বড় ভয় কেননা ভূতের চেয়ে মানুষ আরও বেশি ভয়ঙ্কর। ভূত আছে কি নেই তা জানি না। কিন্তু মানুষ আছে জানি। আর মানুষ পারে না এমন কোনও কাজ নেই।”
“সে কী হে ছোকরা! তুমি শুধু মানুষকেই ভয় করো, ভূতকে ভয় করো না?”
“না।”
“ভাল, ভাল। ভূতের ভয় না করাটাই ভাল। আমি কিন্তু ভূতের ভয়েই একা যেতে সাহস যেতে সাহস রছি না।”
ওঁরা যখন এইভাবে কথা বলছিলেন তেমন সময় হঠাৎ দূরের একটি চালাঘরে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলতে দেখা গেল।
হরিপদ বলল, “চলুন তো! মনে হচ্ছে বালিদহের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। গিয়ে দেখি এক-আধকাপ চা পাই কি না।”
এই বলে বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে হরিপদ দোকানের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু বিধি বাম। গিয়ে দেখল দোকানের ছেলেটি সবকিছু গুছিয়ে গাছিয়ে চলে যাওয়ার জন্য দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করছে।
হরিপদ বলল, “আচ্ছা মুশকিল তো! সারারাত পড়ে থাকতে হবে এখানে, অথচ একটু চা-ও পাওয়া যাবে না?”
বৃদ্ধ বললেন, “শোনো ভাই, যা বলি। যা আছে কপালে, হাঁটতে তো শুরু করি।”
হরিপদ বলল, “হাঁটতে আমি পিছপাও নই। তবে আপনি তো জানেন না এখানকার ব্যাপারস্যাপার। ওই ঘিয়ারপুল জায়গাটা ভাল নয়। এখানকার নামকরা ঠ্যাঙাড়েদের আড্ডা ওখানে!”
“হোক। কথা না বলে চুপিচুপি হাঁটা শুরু করি চলো।”
“চলুন তবে৷”
বলে আর কোনওরকম কথাবার্তা না বলে সেই অন্ধকারে নিঃশব্দে বৃদ্ধকে নিয়ে হাঁটা শুরু করল হরিপদ। বৃদ্ধ সত্যিই হাঁটতে পারেন। এত বয়সেও বেশ শক্তসমর্থ কর্মঠ। হাঁটতে যেন একটুও ক্লান্তি নেই। মাঝে মাঝে হাঁটাতে তিনি হরিপদকেও ছাড়িয়ে যান।
এইভাবে হেঁটে হেঁটে কত পথ গেছেন দু’জনে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ স্টেশনের দিক থেকে একটি মোটরের জোরালো আলো ওদের গায়ে এসে পড়ল। ওরা দু’জনেই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াল রাস্তার পাশে। দেখা গেল একটি হুড খোলা মোটরগাড়ি হর্ন বাজিয়ে তীরবেগে ছুটে আসছে ওদের দিকে।
বৃদ্ধ বললেন, “গাড়িটাকে কোনওরকমে থামানো যায় না? দেখো না একটু চেষ্টা করে।”
হরিপদ বলল, “না। দিনকাল খারাপ তো। ইচ্ছে থাকলেও ভয়ে কেউ গাড়ি থামাবে না। কার মনে কী আছে কে জানে?”
বলতে বলতেই মোটরটা সজোরে এসে ব্রেক কষল ওদের সামনে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকানি খেয়ে থেমে গেল গাড়িটা। গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষেই ওদের দু'জনের দিকে বড় বড় চোখ করে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল।
গাড়ির পেছন দিকের সিটে বেশ জাঁদরেল চেহারার একজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। ওদের দেখে এ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনার?"
ট্রেনের গোলমানের জন্য ফিরতে রাত হয়ে গেছে। তাই হেঁটে বাড়ি ফিরছি।
“অ ! কোন গ্রামে যাবেন আপনারা?”
হরিপদ বলল, “আমি যাব মৌবাসিয়া, উনি যাবেন চৌপায়।
“তা হলে আমার গাড়িতে আপনার উঠে আসতে পারেন। আমি যাব মহিন্দর। আপনার গ্রাম ছাড়িয়ে জোগ্রামের দিকে।”
হরিপদ এবং বৃদ্ধ দুজনেই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠল। ভদ্রলোকের চেহারায় আভিজাত্য আছে। দেখে বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি বলেই মনে হয়। হরিপদ বলল, “আপনি কি মহিন্দরে থাকেন? আমি কিন্তু এর আগে দেখিনি আপনাকে?”
ভদ্রলোক বললেন, “আমি এখানকার লোকই নই তো আমাকে দেখবেন কী করে? আমি থাকি টুচুড়াতে। একজন মরণাপন্ন রোগীর কল পেয়ে তাকে দেখতে যাচ্ছি।”
“আপনি তা হলে ডাক্তারবাবু। মাহিন্দরে কাদের বাড়ি যাচ্ছেন?”
ডাক্তারবাবু এবার একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “অত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে পারব না মশাই। যেমন বসে আছেন তেমনই চুপচাপ বসে থাকুন।”
এর ওপর আর কথা চলে না । হরিপদ চুপ হয়ে গেল। গাড়ি তখন ঝড়ের গতিতে ছুটছে। এত বেশি স্পিড়ে যে, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এখনই বুঝি ছিটকে পড়ে যাবে রাস্তা থেকে। কিন্তু সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হল, এমন তীব্র গতি সত্ত্বেও পথের আর শেষ হচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, যে পথ একবার পার হয়ে এসেছে আবার সেই পথেই ছুটছে গাড়িটা।
তাই না দেখে বৃদ্ধ একটু রাগত স্বরে বললেন, “ডাক্তারবাবু, আপনার ড্রাইভারকে বলুন গাড়িটা একটু আস্তে চালাতে। না হলে যে কোনও মুহুর্তে উলটে যেতে পারে।”
ডাক্তারবাবু বললেন, “ওলটালেই হল? গাড়িটা কতক্ষণ ছুটছে তার খেয়াল আছে? ওলটাবার হলে এতক্ষণে উলটেই যেত।”
“কিন্তু কী অসম্ভব রকমের লাফাচ্ছে। মাথায় ঝাঁকনি লাগছে না? তার ওপর বুড়ো মানুষ আমি। এত কষ্ট সহ্য হয়?”
ডাক্তারবাবু বললেন, “বুঝলাম। তবে একটু কষ্ট সহ্য করতে হবে বইকী! বহুদিনের পুরনো গাড়ি। তার ওপর একটিও চাকা নেই। রাস্তার ধারে ভাঙা-চোরা অবস্থায় পড়ে ছিল বলে মাথার হুডটাকেও কারা যেন খুলে নিয়ে বেচে দিয়েছে। ইঞ্জিনও লোপাট। না আছে তেল, না আছে জল। এই গাড়ি যে ছুটছে এটাই আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি? আমার ড্রাইভার খুব পাকা তাই, না হলে—”
হরিপদর তো চোখ কপাালে উঠে গেছে। সে বেশ বুঝতে পারল কাদের পাল্লায় পড়ে গেছে।
বৃদ্ধ কিন্তু ভয় পেলেন না। বেশ গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, “চোপা কতদূর?”
ড্রাইভার এতক্ষণে কথা বলল, “এই তো এসে গেছি।”
“আমাকে আমার মেয়ের কাছে আজ যেতেই হবে। অতএব বেশি কেরামতি না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি পৌছে দাও। না পারো গাড়ি থামাও, নেমে যাচ্ছি।”
বৃদ্ধর কথা শুনে ডাক্তারবাবু হো হো করে হাসতে লাগলেন। ড্রাইভারও আমনই তার বড় বড় চোখ দুটো ঠেলে বার করে খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগল।
হরিপদর হাত-পা কাঁপছে তখন।
বৃদ্ধ বললেন, “ভয় নেই। আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি ব্যবস্থা করছি।” বলেই ডাক্তারবাবু হাসতে হাসতে বললেন, “এ গাড়ি থামতে জানে না মশাই ভোর না হওয়া পর্যন্ত এ গাড়ি থামবে না।”
বৃদ্ধ বললেন, “থামতে জানে না যদি তো আমাদের গাড়িতে ওঠাবার সময় এটা থেমেছিল কী করে?”
“তখনকার কথা আলাদা। এখন আর থামবে না। যদি পারেন তো চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামুন। একবার লাফ দিলেই আপনারাও আমাদের মতো হয়ে যাবেন।”
“আপনাদের মতন?”
“হ্যাঁ দেখুন, একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখুন। আমরা কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই।”
"সত্যিই তো! ওরা আর আগের মতো নেই। হরিপদ তাকিয়ে দেখল ডাক্তারবাবু এবং ড্রাইভারের আসনে দুটো আস্ত কঙ্কাল বসে আছে।
সেই দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ তো ভয় পাওয়ার জায়গায় রেগে গেলেন খুব। বললেন, “তবে রে। পাজি নচ্ছারগুলো, আমিও খেল দেখাচ্ছি দাঁড়া। আজ সকালে ভাত খাওয়ার সময় মাছের কাটা গলায় আটকে মরে গেছি আমি। মেয়েটার জন্য খুব মন কেমন করছিল ক'দিন ধরে, তাই মেয়েটাকে একবার দেখতে যাচ্ছিলুম। ভেবেছিলুম আজ প্রথম দিনটা অন্তত একটু ভাল হয়ে থাকব। এসব কিছু করব না। তা কিছুতেই ঠিক থাকতে দিলি না তোরা। নিজমূর্তি ধরিয়েই ছাড়লি। এবার দ্যাখ তবে আমার দৌড়টা। আমি যদি সত্যি-সত্যিই মরে ভূত হয়ে থাকি তবে এ গাড়ি আমি থামাবই।” বলেই ইয়া বড় বড় দুটো হাত বার করে একটা বটগাছের ডাল শক্ত করে ধরে ফেললেন বৃদ্ধ। আর অসম্ভব রকমের লম্বা ঠাং দিয়ে টিপে ধরলেন স্টিয়ারিংসুদ্ধ ড্রাইভারকে। অতএব গাড়িটা প্রচণ্ড গতিবেগ থাকা সত্ত্বেও বেকায়দায় পড়ে আটকে গেল।
বৃদ্ধ ওই অবস্থাতেই চেঁচাতে লাগলেন, “নামো নামো। শিগগির নেমে পড়ো। আর দেরি কোরো না হরিপদ। আমি বেশিক্ষণ গাড়িটাকে এইভাবে ধরে রাখতে পারব না। তবে লক্ষ্মী ভাই আমার, মনে করে আমার দুঃসংবাদটা আমার মেয়ের বাড়িতে একটু পৌছে দিয়ো। জানাজানি যখন হয়েই গেল তখন আর তো সেখানে আমার যাওয়া উচিত হবে না।”
হরিপদ তখন একলাফে নেমে এল গাড়ি থেকে। হরিপদ নেমে যেতেই বৃদ্ধ গাছের ডাল ছেড়ে দিলেন। আটকে থাকা গাড়িটা মুক্তি পেয়ে ই ই শব্দে ছুটে চলল। হরিপদ অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখল, সেই অন্ধকারে মাঠের ওপর দিয়ে এমন একটা গাড়ি ছুটে চলেছে, যে গাড়ির একটিও চাকা নেই।
যাই হোক, হরিপদ সে রাতে চোপায় ওর বন্ধু লালমোহনের বাড়িতে দুঃসংবাদটা পৌছে দিয়ে মৌবেসেয় নিজ গ্রামে ফিরে এসেছিল। ভাগ্য ভাল যে, গাড়িটা চোপার মোড়েই থেমেছিল। না হলে কী হত কে জানে!
0 coment�rios: