শার্লক হোমসের চোখে তিনিই নাকি একমাত্র ‘মহিলা’ পদবাচ্য স্ত্রীলোক। তার মানে এই নয় যে মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা ছিল হোমসের। মন যার ঘড়ির কাটার মতো সুসংযত, কোনো ভাবাবেগ সেখানে ঠাঁই পায় না। হিসেবি মন আর তীক্ষ্ণদৃষ্টির একটা যন্ত্র বললেই চলে তাকে। ভাবালুতার কোনো দামই নেই তার কাছে— বিচারশক্তি নাকি ঘুলিয়ে যায় এসব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে, তা সত্ত্বেও আইরিন অ্যাডলারকে শ্রেষ্ঠ মহিলার সিংহাসনে বসিয়েছিল র্শালক হোমস।
বিয়ের পর থেকেই হোমসের সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছিল আমার। নিজের সংসার আর আলাদা ঘর নিয়েই তখন আমি মশগুল। হোমস সামাজিকতার ধার ধারে না। বেকার স্ট্রিটের ডেরায় রাশি রাশি বই; গোয়েন্দাগিরি আর কোকেনের নেশা নিয়ে সে রইল সম্পূর্ণ আলাদা জগতে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে চোখে পড়ত তার চমকপ্রদ কীর্তিকাহিনির সংবাদ।
নতুন করে ডাক্তারি শুরু করার পর একদিন রাত্রে রুগি দেখে বাড়ি ফিরছি (২০।৩। ১৮৮৮) বেকার স্ট্রিট দিয়ে, এমন সময়ে চোখে পড়ল ওপরের ঘরে দ্রুত পায়চারি করছে হোমস। পর্দার গায়ে দু-বার ছায়া পড়ল তার লম্বা রোগা শরীরের। দেখলাম মাথা বুকের ওপর ঝুঁকে রয়েছে, দু-হাত পেছনে। অর্থাৎ কোকেনের নেশাকাটিয়ে উঠেছে হোমস, কাজের নেশায় বুদ হয়েছে। মাথায় সমস্যার ভূত চেপেছে বলেই এত ছটফট করছে ঘরময়।
উঠে এলাম ওপরকার ঘরে। হোমস আমাকে দেখল, খুশি হল, কিন্তু উচ্ছাস প্রকাশ করল না। চুরুটের বাক্স এগিয়ে দিয়ে সুরাপাত্রের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বসতে বলল চেয়ারে। তারপর তন্ময় চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে।
‘বিয়ে করে সুখী হয়েছ দেখছি। সাড়ে সাত পাউন্ড ওজন বেড়েছে।
‘সাত পাউন্ড।’
‘আবার ডাক্তারি শুরু করেছ?’
‘তুমি জানলে কী করে?
‘দেখে। আরও দেখছি, সম্প্রতি খুব ভিজেছ বৃষ্টিতে, আর একটা অকম্মার ধাড়ি ঝি জুটেছে বাডিতে’।
'ভায়া, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? সেকাল হলে তোমায় নির্ঘাত জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হত। গত বৃহস্পতিবার গাঁয়ে গিয়েছিলাম হেঁটে, ফিরেছি অনেক কষ্টে। কিন্তু জামাকাপড় পাল্টানোর পরেও তুমি জানলে কী করে বল তো? যাচ্ছেতাই ঝি-টাকেও বিদেয় করেছে স্ত্রী। অথচ তুমি—’
হাসল হোমস। দু-হাত ঘষে বললে, “তোমার বাঁ-পায়ের জুতোয় পাশাপাশি দুটো আঁচড় পড়েছে– কাদা তুলতে গিয়েছিল এমন কেউ যে ডাহা আনাড়ি। অর্থাৎ, বাদলার দিনে রাস্তায় বেরিয়েছিলে এবং যে ঝি-টিকে দিয়ে জুতো সাফ করিয়েছিলে, ঝাল ঝেড়েছে সে জুতোর ওপরেই। তোমার গায়ে আয়োডোফর্মের গন্ধ", ডান হাতের বুড়ো আঙুলে সিলভার নাইট্রেটের কালচে দাগ, আর স্টেথিস্কোপ রাখার জন্যে উঁচু টুপি দেখে অনায়াসেই বলা যায় রুগি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে ডাক্তার।’
হেসে ফেললাম। বললাম, ‘এত সহজ করে বললে যে মনে হল আমারও বলা উচিত ছিল।
চেয়ারে বসল হোমস। চুরুট ধরাল। বলল, ‘তুমি দেখ ঠিকই, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখ না— তোমার সঙ্গে আমার তফাত সেইখানেই। যেমন ধর নীচের হল ঘর থেকে এই ঘরে ওঠবার সিঁড়ি তুমি দেখেছ?’
‘নিশ্চয়।”
‘কতবার দেখেছ?’
‘কয়েক-শো বার তো বটেই।’
‘ক-টা ধাপ আছে সিড়িতে?
‘তা তো বলতে পারব না।’
“কিন্তু আমি পারব। কেননা, তুমি শুধু দেখেছ, ঠাহর করনি— আমি করেছি। সতেরোটা ধাপ আছে সিঁড়িতে। আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি লেখালেখি শুরু করেছ বলেই তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি, টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা গোলাপি চিঠি আমার দিকে নিক্ষেপ করল হোমস,
‘জোরে পড়ো।
চিঠির কাগজ বেশ পুরু; কিন্তু তারিখ, সই, ঠিকানা— কিছুই নেই!
চিঠিটা এই : ‘আজ রাত পৌনে আটটায় একটা অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যে মুখোশ পরে এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। ঘরে থাকবেন।
বললাম, রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। তোমার কী মনে হয় ?”
‘সূত্র হাতে না-আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌছোনো মারাত্মক ভুল। চিঠি দেখে তোমার কী মনে হয়?’
চিঠি যিনি লিখেছেন, তিনি বড়োলোক। কাগজটা রীতিমতো শক্ত, মজবুত আর দামি।
“খাটি কথা। এ-কাগজ ইংল্যান্ডে পাওয়া যায় না। আলোর সামনে ধরো।’
ধরলাম। জলছাপটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। g এর পাশে E, একটা P, G-এর সঙ্গে t.
‘কী বুঝলে?’ হোমসের প্রশ্ন।
‘কারিগরের নাম বা মনোগ্রাম।”
‘না। g এর সঙ্গে t থাকার মানে গেসেল শাফট। জার্মান শব্দ। মানে, কোম্পানি। আমরা যেমন কোম্পানিকে কোং লিখি, ওরাও তেমনি গেসেল শাফটকে এইভাবে লেখে। P মানে পেপার। বাকি রইল E আর g এর মানেটা। কন্টিনেন্টাল গেজেটিয়ার" দেখলেই বোঝা যাবে।’
তাক থেকে বাদামি রঙের ইয়া মোটা একখানি বই নামিয়ে পাতা ওল্টাল হোমস।
ইগ্রো, ইগ্রোনিৎস, ইগ্রিয়া”। আর এই হল বোহেমিয়া”। ভাষা জার্মান। কাচ আর কাগজের কারখানার জন্যে বিখ্যাত। বল, কী বুঝলে?
'সতর্কতার সঙ্গে আমি লেখাটা পরীক্ষা করলাম।" সিডনি প্যাগেট, স্ট্রান্ড ম্যাগাজিন, ১৮৯১
‘কাগজটা তৈরি হয়েছে বোহেমিয়ায় ?
এবং পত্ৰলেখক একজন জার্মান। চিঠি লেখার কায়দা দেখেই বোঝা যায়। জার্মানরাই কথার শেষে ক্রিয়া বসায়। ভদ্রলোক কিন্তু এসে গেছেন।"
কথা শেষ হতে-না-হতেই ঘোড়ার পায়ের টগবগ শব্দ, গাড়ির চাকার ঘরঘর আওয়াজ এবং দোরগোড়ার ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল।
শিস দিয়ে উঠল হোমস। বললে, “দু-ঘোড়ায় টানা গাড়ি মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই উকি দিল জানলায়, ‘ঠিক বলেছি। জোড়াঘোড়ায় টানা ব্রুহ্যাম’ গাড়ি। এক-একটা ঘোড়ার দামই কমসেকম দেড়শো গিনি। ওয়াটসন, এ-কেসে টাকা আছে হে।’
‘আমি যাই।’
‘মোটেই না। কেসটা ইন্টারেস্টিং, না-থাকলে আফশোস করতে হবে।’
ধীর স্থির ভারিক্কি পদশব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে স্তব্ধ হল দরজার সামনে। পরক্ষণেই টোকা পড়ল পাল্লায়— বেশ জোরে গাঁট ঠোকার আওয়াজ– যেন কর্তাব্যক্তি কেউ।
‘ভেতরে আসুন, বললে হোমস। ঘরে যিনি ঢুকলেন, মাথায় তিনি রীতিমতো ঢাঙা— সাড়ে ছ-ফুটেরও বেশি। হারকিউলিসের মতো গড়নপেটন। পোশাক দারুণ দামি, কিন্তু ভীষণ জমকালো— ইংল্যান্ডের রুচিতে আটকায়। সারাগায়ে কুবেরের সম্পদ যেন ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মাথায় হ্যাট, আধখানা মুখ কালো মুখোশে ঢাকা। একটা হাত মুখোশ ছুঁয়ে রয়েছে— যেন ঢোকবার আগে এইমাত্র লাগালেন। মুখের নীচের দিকে প্রখর ব্যক্তিত্ব যেন ছিটকে বেরুচ্ছে। মোটা ঠোঁট আর লম্বা থুতনিতে গোঁয়ারতুমি, গাজোয়ারি আর মনের জোর বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। রুক্ষ জার্মান উচ্চারণে বললেন— ‘চিঠি পেয়েছেন?” বলে পর্যায়ক্রমে আমার আর হোমসের দিকে তাকালেন। যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কার সঙ্গে কথা বলবেন।
‘বসুন, বললে হোমস। ‘ইনি আমার বন্ধু এবং সহযোগী ডক্টর ওয়াটসন। কার সঙ্গে কথা বলছি জানতে পারি?
‘আমার নাম কাউন্ট ফন ক্র্যাম— বোহেমিয়ার খানদানি আদমি আমি। একে বিশ্বাস করা চলে তো ?’
উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছি, টেনে বসিয়ে দিল হোমস।
বলল, “হয় দুজনে শুনব, নয় কেউ শুনব না। এর সামনেই বলুন। কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে কাউন্ট বললেন, ‘তাহলে কথা দিন অন্তত দু-বছর এ-ব্যাপার প্রকাশ করবেন না— করলে ইউরোপের ইতিহাস অন্যরকম দাঁড়াতে পারে।
‘কথা দিলাম’, বললাম আমি আর হোমস।
‘আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি চান না আমার পরিচয় ফাঁস হয়ে যাক। মুখোশ লাগিয়েছি সেই কারণে। আমার আসল নামও আপনাকে বলিনি।’
‘জানি, কাঠখোট্টা গলায় বললে হোমস। ‘বোহেমিয়ার আর্মস্টাইন রাজবংশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্য এত সাবধান হতে হচ্ছে জানবেন ?
সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে হোমস বললে, “তাও জানি। অবাক হলেন রহস্যময় মক্কেল। হোমসের নামডাক যে অকারণে হয়নি, তা যেন বুঝতে পারলেন ।
চোখ খুলল হোমস। বললে, “মহারাজ যদি মন খোলসা করে সব বলেন তাহলে আমার দিক দিয়ে পরামর্শ দিতে সুবিধে হয়।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন বিরাটদেহী আগন্তুক। দুমদাম করে ঘরময় কিছুক্ষণ চরকিপাক দিয়ে একটানে মুখোশ খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন মেঝেতে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিই রাজা। অত লুকোছাপা কীসের ?’
‘আমিও তাই বলি। আপনি মুখ খোলার আগেই বুঝেছিলাম আজ আমার ঘরে পায়ের ধুলো দিয়েছেন স্বয়ং ডিউক।’
‘ব্যাপারটা এতই গোপনীয় যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনি— প্রাহা থেকেই ছদ্মবেশ ধরে আসছি।’
‘শুরু করুন, ফের চোখ বন্ধ করে হোমস।
বছর পাঁচেক আগে ওয়ারশ নগরে নামকরা অভিনেত্রী আইরিন অ্যাডলারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। নামটা শুনেছেন নিশ্চয় ?”
নামি ব্যক্তিদের যাবতীয় বৃত্তান্ত লিখে রাখত হোমস। দরকারমতো তা কাজে লাগত। আইরিন অ্যাডলারের নাম পেলাম একজন ইহুদি প্রফেসর আর মিলিটারি অফিসারের নামের মধ্যে।
দাও। হুঁ! নিউজার্সিতে জন্ম ১৮৫৮ সালে।ইম্পিরিয়াল ওয়ারশ রঙ্গমঞ্চের মূল গায়িকা। হুঁ! থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে আছেন। বুঝেছি। একে যেসব চিঠি লিখেছেন, এখন তা ফেরত চাইছেন– এই তো ?’
‘তাই বলতে পারেন।
‘লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন?
‘মোটেই না।’
দলিল-টলিল বা প্রশংসাপত্র জাতীয় কিছু আছে কি?’
‘একদম না ?
‘তাহলে সে-চিঠি যে আসল, তা প্রমাণ করা যাবে কী করে ?
‘আমার হাতের লেখা দেখে।’
“হাতের লেখা জাল করা যায়।’
“প্যাডের কাগজ আমার।’
‘তাও চুরি করা যায়।’
‘সিলমোহরটাও যে আমার।’
‘তাও নকল করা যায়।’
‘আমার ফটো ?”
‘সে আর এমন কী— কিনতে পাওয়া যায়।’
“কিন্তু দুজনে একসঙ্গে আছি যে ফটোতে।
‘সর্বনাশ! খুব কাঁচা কাজ করেছেন।
তখন কি আর কাণ্ডজ্ঞান ছিল আমার? বয়স কম। যুবরাজ ছিলাম। এখনই তো মোটে তিরিশ বছর বয়স আমার।’
‘ফটোটা ওঁর কাছ থেকে সরাতে হবে।’
‘সে-চেষ্টাও হয়েছে। পারিনি।'
‘তাহলে কিনে নিন।’
বেচবে না।’
‘চুরি করান।
‘পাঁচবার চেষ্টা করেছি। দু-বার চোর দিয়ে, একবার দেশ বেড়ানোর সময়ে মালপত্র সরিয়ে, আর দু-বার পথে ঘাপটি মেরে থেকে। একবারও পারিনি।'
“ছবি নিয়ে কী করতে চান উনি?’
‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজকন্যের সঙ্গে শিগগিরই বিয়ে হবে আমার। মেয়েটি যদি জানতে পারে আমার চরিত্র ভালো নয়, বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। আইরিন অ্যাডলার ছবিখানা সেইখানেই পাঠাবে।
‘পাঠিয়ে দেননি তো ?’
‘না। বিয়ের কথা যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে, সেইদিন পাঠাবে। অর্থাৎ সামনের সোমবার।’
হাই তুলল হোমস— ‘তিনটে দিন পাচ্ছি হাতে। আপনি লন্ডনেই আছেন তো?
‘হ্যাঁ। ল্যাংহ্যামে পাবেন আমাকে।’
‘খবর সেইখানেই দেব। দেনাপাওনার ব্যাপারটা কী হবে?’
‘যা বলবেন তাই হবে। রাজ্যের খানিকটা দিয়ে দিতে পারি ফটোর দাম হিসেবে।’
‘হাতখরচ ?’
একটা চামড়ার ব্যাগ বার করে টেবিলে রাখলেন গ্র্যান্ড-ডিউক।
‘এর মধ্যে তিন-শো মোহর আর সাত-শো পাউন্ডের নোট আছে।’
রসিদ লিখে দিল হোমস— ‘আইরিন অ্যাডলারের ঠিকানাটা কী ?
‘ব্রায়োনি লিজ, সাপেন্টাইন অ্যাভিনু, সেন্ট জনস উড।’
‘ফটোটা ক্যাবিনেট সাইজের?’
‘হ্যাঁ।’
‘গুড নাইট। শিগগিরই খবর পাবেন।
গাড়ির আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেল। হোমস বলল, “কাল বিকেল তিনটে নাগাদ চলে এস, এই নিয়ে কথা বলা যাবে’খন।’
পরদিন ঠিক তিনটেয় গেলাম। হোমস সকাল আটটায় বেরিয়েছে, তখনও ফেরেনি। আগুনের চুল্লির ধারে বসে রইলাম ফেরার পথ চেয়ে।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজতেই দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একজন কদাকার সহিস। পোশাক নোংরা, মুখে দাঁড়িগোফ, চোখ রাঙা, ভাবভঙ্গি, মাতালের মতন। তিন-তিনবার আপাদমস্তক চোখ বুলোনোর পর চিনলাম বহুরূপী হোমসকে। শোবার ঘর থেকে পাঁচ মিনিট পরেই বেরিয়ে এল টুইড-সুট পরা ভদ্রলোকের চেহারায়। আগুনের সামনে পা ছড়িয়ে বসে পেটফাটা হাসি হাসল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
‘ব্যাপারটা কী ? শুধোই আমি। ‘দারুণ মজা হয়েছে আজ সকালে |’
‘ঠিক। সহিসের ছদ্মবেশে বেরিয়েছি সকাল আটটায়। গাড়োয়ান আর সহিসে খুব মাখামাখি সম্পর্ক থাকে— খবর পেতে অনেক সুবিধে হয়। ব্রায়োনি লজ বাড়িটা দোতলা, রাস্তার ওপরেই, পেছনে বাগান, ডান দিকে সাজানো বসবার ঘর, বড়ো বড়ো জানলা। বাগানের পাঁচিল বরাবর একটা নোংরা গলি ঢুকেছে ভেতরে। সহিসরা ঘোড়া ডলাইমালাই করছে সেখানে। আমিও হাত লাগালাম। বিনিময়ে পেলাম দুটাে পেনি, আধ বোতল মদ, তামাক আর আইরিন অ্যাডলার সম্পর্কে অনেক খবর। নির্ঝঞ্ঝাট মহিলা। ভোরে বেড়াতে যাওয়া আর কনসার্টে গান গাইতে যাওয়া ছাড়া রাস্তায় বেরোন না। সাতটায় ফিরে ডিনার খান। পুরুষ বন্ধু শুধু একজনই। সুপুরুষ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, গায়ের রং গাঢ়, রোজ আসেন। পেশায় উকিল, নাম গডফ্রে নর্টন। খটকা লাগল। আইরিন অ্যাডলারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা স্রেফ উকিলের সঙ্গে মক্কেলের সম্পর্ক, না ভালোবাসাবাসির ব্যাপারও আছে? প্রথমটা যদি ঠিক হয়, তাহলে ফটো তার হেপাজতেই আছে। অর্থাৎ তদন্তের ক্ষেত্র আরও বাড়ল।
‘ভাবছি কী করব, এমন সময়ে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। লাফিয়ে নামলেন এক ভদ্রলোক। চেহারা দেখেই বুঝলাম ইনিই গডফ্রে নর্টন। ব্যস্তসমস্তভাবে গাড়োয়ানকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ঝি-এর পাশ দিয়ে বো করে ঢুকে গেলেন ভেতরে— যেন হরদম যাতায়াত আছে বাড়িতে।
‘ভেতরে রইলেন আধঘণ্টা। জানালা দিয়ে দেখলাম হন হন করে পায়চারি করছেন আর হাত পা নেড়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। আইরিন অ্যাডলারকে খুব একটা দেখা গেল না। তারপর বেরিয়ে এলেন আগের চেয়েও ব্যস্তভাবে। গাড়োয়ানকে হেঁকে বললেন— ‘বিশ মিনিটের মধ্যে রিজেন্ট স্ট্রিট হয়ে সেন্ট মনিকা চার্চে যেতে হবে, আধ গিনি বকশিশ পাবে।’
‘পেছন নেব কি না ভাবছি, এমন সময়ে একটা ঝকঝকে গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। খুব তাড়াগুড়ো করে ঘোড়া জোতা হয়েছে গাড়িতে, কোর্টের বোতাম লাগানোর সময়ও পায়নি কোচোয়ান। ঝড়ের মতো হল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আইরিন অ্যাডলার, গাড়িতে উঠেই হেঁকে বললেন— ‘‘বিশ মিনিটে সেন্ট মনিকার গিজেয় চল। আধ পাউন্ড বকশিশ দোব।” ‘ঠিক এই সময়ে একটা ছ্যাকরা গাড়ি এসে গেল সামনে। তড়াক করে লাফ মেরে ঢুকে গেলাম গাড়ির ভেতরে। চিৎকার করে বললাম, ‘সেন্ট মনিকার গিজেয় চল— বিশ মিনিটের মধ্যে যেতে পারলে আধ পাউন্ড বকশিশ।”
‘উল্কাবেগে গাড়ি পৌছাল গির্জার সামনে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম আইরিন অ্যাডলার, গডফ্রে নর্টন আর পাদরি ছাড়া কেউ আর নেই– বেদির সামনে দাঁড়িয়ে তিনজনে। আমাকে দেখেই কিন্তু তিনজনেই দৌড়ে এল আমার দিকে। আমি তো অবাক!
‘গডফ্রে নর্টন টানতে টানতে আমাকে বেদির কাছে নিয়ে গেলেন, “চলে এসো! চলে এসো! তোমাকেই দরকার! আর মোটে তিন মিনিট বাকি! সাক্ষী না-থাকলে আইনের ফাঁক থেকে যাবে।”
পরমুহুর্তে শুনলাম বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়া হচ্ছে আমার কানের কাছে এবং আমিও তা দিব্যি আউড়ে যাচ্ছি। যা জানি না, তার সাক্ষী দিচ্ছি। অর্থাৎ গডফ্রে নর্টন আর আইরিন অ্যাডলারের বিয়েতে মধ্যস্থতা করছি। চক্ষের নিমেষে বিয়ে হয়ে গেল। সবাই খুব খুশি। এক পাউন্ড পুরস্কারও পেলাম পাদরির কাছে। ব্যাপারটা বুঝলাম। সাক্ষী ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না— রাস্তা থেকে সাক্ষী আনতে গেলে সময় পেরিয়ে যেত— তাই আমাকে পেয়ে বর্তে গিয়েছে সকলে। এত হাসছিলাম সেই কারণেই।’
‘তারপর ? শুধোই আমি।
‘গির্জের বাইরে এসে দুজনে গেলেন দু-দিকে— যাওয়ার আগে গডফ্রে নর্টন বলে গেলেন, সন্ধে নাগাদ রোজকার মতো আসবেন। কনে ফিরলেন বাড়িতে, আমিও এলাম এখানে— তোড়জোড় করতে।’
‘কীসের তোড়জোড়?’
‘খেয়ে নিয়ে বলব। পেটে আগুন জ্বলছে। বিকেলে তোমাকে দরকার। কাজটা কিন্তু বেআইনি। ধরা পড়ার সম্ভাবনাও আছে। রাজি ?
‘এক-শোবার। উদ্দেশ্য মহৎ হলে সব কিছুতেই রাজি। কিন্তু মতলবটা কী তোমার ? খাবার এসে গেল। খেতে খেতে হোমস বললে, “উদ্দেশ্য সত্যিই মহৎ। এখন পাঁচটা বাজে। দু-ঘণ্টা পরে ব্রায়োনি লজে পৌছোব আমরা— আইরিন অ্যাডলার তখন খেতে ফিরবেন।
‘তারপর?”
‘আমি ভেতরে যাব, তুমি বাইরে থাকবে। বসবার ঘরে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতে এই জিনিসটা রাখবে”— চুরুটের মতো একটা লম্বাটে বস্তু বাড়িয়ে দিল হোমস— ‘সামান্য ধোঁয়া-বোমা। ছুড়ে দিলেই আপনা থেকে জ্বলে ওঠে। চার-পাঁচ মিনিট পরে জানলা খুললে তুমি আমার হাতের দিকে নজর রাখবে। যখন দেখবে এইভাবে হাত মাড়ছি, বিশেষ একটা হস্তভঙ্গি করে হোমস, বোমাটা জানলা গলিয়ে ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে “আগুন আগুন” বলে চেঁচিয়ে উঠবে। ভিড় জমে উঠলেই সরে পড়বে। রাস্তার অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়াবে। দশ মিনিট পরে আমি আসব সেখানে। বুঝেছ? -
‘হ্যা।’ শোবার ঘরে গেল হোমস। ফিরে এল পাদরির ছদ্মবেশেই। শুধু পোশাক নয়, চোখ-মুখের চেহারা পর্যন্ত পালটে গিয়েছে। হোমস অপরাধ তাত্ত্বিক হওয়ায় অভিনয় জগৎ হারিয়েছে একজন কুশলী শিল্পীকে, বিজ্ঞান জগৎ হারিয়েছে একজন চুলচেরা বিশ্লেষককে।
বেকার স্ট্রিট থেকে বেরোলাম ছ-টা বেজে পনেরো মিনিটে— ব্রায়োনি লজের সামনে যখন পৌঁছোলাম তখন ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠেছে।
বাড়ির সামনেটা যত ফাঁকা হবে ভেবেছিলাম, দেখলাম তা নয়। বেশ কিছু লোক এদিকে সেদিকে হয় আড্ডা মারছে, নয় ঘোড়াফেরা করছে।
হোমস বললে, ‘ওয়াটসন, নর্টন-অ্যাডলার বিয়ের ফলে আমাদের কাজ কিন্তু সহজ হয়ে এল। আইরিন অ্যাডলার এখন কখনোই চাইবেন না ছবিটা গডফ্রে নর্টনের চোখে পড়ুক। কিন্তু রেখেছেন কোথায়, সেইটাই এখন সমস্যা।’
‘সঙ্গে যে রাখেননি, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ক্যাবিনেট সাইজের ছবি মেয়েরা পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে না— তা ছাড়া যেকোনো মুহুর্তে গ্র্যান্ড ডিউকের লোক তাঁকে ধরে সার্চ করতেও পারে।’
‘তাহলে ?’ -
‘কারো কাছেও রাখেননি— কেননা ছবিটা কয়েকদিনের মধ্যে দরকার হবে। তা ছাড়া মেয়েরা যখন কিছু লুকোয়— নিজেরাই লুকিয়ে রাখে— কারো সাহায্য নেয় না— বিশেষ করে যাদের আত্মবিশ্বাস আছে। কাজেই ধরে নিচ্ছি ছবি তার নাগালের মধ্যেই আছে। অর্থাৎ, বাড়ির মধ্যে।’
“কিন্তু বাড়ি খোঁজাও তো হয়েছে।’
‘ওকে খোঁজা বলে না।’
‘তুমি কী করে খুঁজবে?
‘আমি তো খুঁজব না।’
‘তবে ?’
‘উনিই দেখিয়ে দেবেন।— এই যে এসে গেছে গাড়ি।’
মোড়ের মাথায় দেখা গেল গাড়ির আলো— এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। সঙ্গেসঙ্গে প্রাপ্তিযোগের আশায় একজন নীচু ক্লাসের লোক দৌড়ে এসে খুলে ধরল দরজা। দৌড়ে এল আরও একজন— প্রথম জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল বকশিশটা নিজেই নেওয়ার আশায়। লেগে গেল ঝগড়া। ছুটে এল আরও অনেকে। দুটাে দল হয়ে যেতেই শুরু হল হাতাহাতি, ঘুসোঘুসি, লাঠালাঠি। হোমস দৌড়ে গেল আইরিন অ্যাডলারকে বাঁচাতে— কিন্তু লাঠি খেয়ে কাতরে উঠে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়— রক্ত ঝরতে লাগল মুখ বেয়ে। দেখেই ফর্সা হয়ে গেল হামলাবাজরা। অন্যদিক থেকে কয়েকজন ছুটে এসে ঘিরে ধরল জখম পাদরিকে। আইরিন অ্যাডলার ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছেন।
সেখান থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘চোটটা কি মারাত্মক?
কেউ বলল, শেষ হয়ে গিয়েছে। কেউ বললে, না, না এখনও মরেনি— নিশ্বাস পড়ছে। তবে হাসপাতাল পর্যন্ত টিকবেন কিনা সন্দেহ। আর একজন বললে— ‘ভেতরে নিয়ে যাব?”
“নিশ্চয়। বসবার ঘরে এনে সোফায় শুইয়ে দাও।”
ধরাধরি করে হোমসকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল সোফায়। আলো জ্বলল বটে, জানলার পর্দা টানা হল না। দেখলাম, ভদ্রমহিলা নিজে শুশ্রূষা করছেন আহত পাদরিকে। ধোঁয়া বোমা হাতে নিয়ে তৈরি হলাম— সংকেত পেলেই ছুড়ব।
কষ্টেসৃষ্টে সোফায় উঠে বসেছে হোমস— বাতাসের অভাবে বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। একজন ঝি গিয়ে খুলে দিল জানলা। সঙ্গেসঙ্গে সেই বিশেষ কায়দায় হাত তুলল হোমস এবং আমিও ধোঁয়া বোমা ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলাম ‘আগুন আগুন করে। একই সঙ্গে সমস্বরে আকাশফটা চিৎকার আরম্ভ করল রাস্তার লোকজন। গলগল করে পুঞ্জীভূত ধোয়া বেরিয়ে এল জানলা দিয়ে। প্রচণ্ড হট্টগোলের মধ্যে কেউ কেউ টেনে লম্বা দিলে সেখান থেকে। তারই মাঝে শুনলাম হোমসের গলা— আগুন-ফাগুন নাকি সব বাজে কথা, নিশ্চয় কেউ ভয় দেখাচ্ছে।
সরে এলাম রাস্তার কোণে। দশ মিনিট দাঁড়ালাম। হোমস এসে আমাকে টেনে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল বাড়ির দিকে।
‘শাবাশ ডাক্তার!’ বললে হোমস |
‘ফটোটা ?”
‘কোথায় আছে জেনে ফেলেছি।’
‘কী করে জানলে ?’
‘উনি দেখিয়ে দিলেন।’
কিছু বুঝলাম না।’
‘রাস্তার লোকগুলো যে আমার ভাড়াটে অভিনেতা”, তা নিশ্চয় বুঝেছ?
“সন্দেহ হয়েছিল।”
‘গোলমালের শুরুতে দৌড়ে গিয়েই দু-হাত মুখে রগড়ে নিয়েছিলাম— আগে থেকেই লাল রং মেখে রেখেছিলাম হাতে। জখম হওয়ার ভান করতেই বৈঠকখানা ঘরে না-ঢুকিয়ে পারলেন না ভদ্রমহিলা। বাড়ির কোন ঘরে ফটাে লুকিয়েছেন সঠিক জানতাম না। বসবার ঘরও হতে পারে, শোবার ঘরও হতে পারে। সেটা জানবার জন্যেই ঘরের মধ্যে ধোঁয়া-বোমা ছোড়ালাম তোমাকে দিয়ে।
বাড়িতে আগুন লাগলে মেয়েরা আগে সবচেয়ে দামি জিনিস বাঁচাতে ছুটে যায়। মায়েরা দৌড়োয় বাচ্চার দিকে, কুমারীরা গয়নার দিকে। আইরিন অ্যাডলার দৌড়োলেন ঘণ্টার দড়ির ওপরকার একটা আলগা তক্তার দিকে— আধখানা টেনে সরাতেই ভেতরকার ফাঁকে দেখলাম ফটোটা। তারপরেই যখন বললাম— আগুন লাগেনি, উনি যেখানকার ফটো সেখানেই রেখে দিয়ে ধোঁয়া-বোমাটার দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সেই ফাঁকেই ছবিটা সরিয়ে নিলে হত, কিন্তু কোচোয়ান লোকটা ঘরে ঢুকে এমন কটমট করে চেয়ে রইল আমার দিকে যে ভরসা হল না। বেশি তাড়াহুড়ো না-করাই ভালো।’
‘এবার কী করবে ?’
‘কাল সকাল আটটায় খোদ মহারাজকে নিয়ে যাব আইরিন অ্যাডলারের বসবার ঘরে। উনি অবশ্য নেমে এসে আমাদের কাউকেই দেখতে পাবেন না— সেইসঙ্গে দেখবেন ফটোও নেই খুপরির মধ্যে। আমি চাই মহারাজ নিজের হাতে ছবি উদ্ধার করুন। আর দেরি নয়, এখুনি লিখে জানাচ্ছি মহারাজকে।”
বেকার স্ট্রিটে পৌছে গেলাম কথা বলতে বলতে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবির জন্যে পকেটে হাত দিল হোমস। আমনি কানের কাছে শুনলাম স্বাগত ভাষণ, ‘গুডনাইট, মি. শালক হোমস!’
রাস্তায় তখন গমগম করছে লোকজন। মনে হল আলস্টারধারী শীর্ণকায় এক ছোকরার দিক থেকে ভেসে এল কথাটা। হনহন করে আমাদের পাশ দিয়ে সে চলে গেল সামনে।
শ্যেনদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বললে হোমস, চেনা গলা! কিন্তু লোকটা কে?
সে-রাতে আর বাড়ি ফিরলাম না— বেকার স্ট্রিটের বাড়িতেই থেকে গেলাম। পরের দিন সকালে হস্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন বোহেমিয়ার গ্র্যান্ড-ডিউক।
ঢুকেই হোমসের কাঁধ খামচে ধরে ব্যগ্রকণ্ঠে বললেন, ‘পেয়েছেন?
‘এখনও পাইনি— কিন্তু এবার পাবেন।
‘তাহলে চলুন, আর দেরি নয়।’
নেমে এলাম নীচে। ব্রুহাম গাড়িতে চেপে রওনা হলাম ব্রায়োনি লজ অভিমুখে। যেতে যেতে হোমস বললে, “আইরিন অ্যাডলারের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’
‘বলেন কী? কবে ?’
‘কালকে।’
‘কার সঙ্গে ?
‘উকিল গডফ্রে নর্টনের সঙ্গে।’
“কিন্তু আইরিন কি তাকে ভালোবাসে?
‘আশা করি বাসেন। আর বাসেন বলেই আপনাকে তিনি ভালোবাসেন না। তাই আপনার ভালোমন্দ নিয়ে তার আর মাথা ব্যথাও থাকবে না।’
বোবা হয়ে গেলেন গ্র্যান্ড-ডিউক। বিষাদাবরণে আবৃত রইলেন পথের বাকিটুকু। উদবেলিত আবেগ প্রকাশ করলেন না বাইরে।
ব্রায়োনি লজের সামনে গিয়ে দেখি দরজা খোলা, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একজন বুড়ি ঝিঁ। আমাদের দেখেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আপনিই কি মিস্টার শালক হোমস ?’
চমকে উঠল হোমস। বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই শালক হোমস।’
দিদিমণি আজ ভোর পাঁচটা পনেরোর ট্রেনে চলে গেছেন। স্বামীকে নিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আপনি আসতে পারেন।’
‘সেকী! ইংল্যান্ড ছেড়ে গেছেন নাকি? ফ্যাকাশে হয়ে গেল হোমস। মনে হল এই বুঝি টলে পড়ে যাবে।
‘হ্যা। আর ফিরবেন না।’
‘কাগজপত্রগুলো ? গলা ভেঙে গেল গ্র্যান্ড-ডিউকের।
খোলা, তাক ফাঁকা। ঘণ্টার দড়ির ওপরের ঢ়িলে তক্তাটা ভেঙে ফেলল হোমস। ভেতর থেকে বার করল একটা ফটো আর একটা চিঠি ।
ফটোটা আইরিন অ্যাডলারের। চিঠিটা শার্লক হোমসের। খামের ওপরে তার নামের তলায় লেখা : শার্লক হোমস না-আসা পর্যন্ত যেন এ-চিঠি এখানেই থাকে।
একটানে খাম ছিড়ে ফেলল হোমস। রাত বারোটার সময়ে লেখা হয়েছে চিঠি। হুমড়ি খেয়ে একই সাথে পড়লাম তিনজনে।
ডিয়ার মিস্টার শার্লক হোমস,
আপনার কাজের ধারাই আলাদা— শতমুখে প্রশংসা করতে হয়। ‘আগুন আগুন চিৎকার শোনার আগে পর্যন্ত বুঝিনি ফাঁদে পড়েছি। বুঝলাম যখন, তখন খটকা লাগল। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম ছবি উদ্ধারের জন্যে আপনার দ্বারস্থ হতে পারেন মহারাজ। তাই কোচোয়ানকে আপনার পাহারায় রেখে ওপরে গিয়ে পুরুষমানুষের ছদ্মবেশ ধরলাম। জানেন তো অভিনয় জিনিসটা আমি ভালোভাবেই রপ্ত করেছি এবং বহুবার দেখেছি পুরুষের ছদ্মবেশেই কাজ হয় বেশি।
আপনার পেছন ধরে বাড়ি পর্যন্ত এসে যখন দেখলাম সত্যিই আপনি শার্লক হোমস, তখন বিবেচকের মতো গুড নাইট জানিয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা হলাম স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্যে।
ঠিক করলাম, এ-রকম দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষর খপ্পর থেকে রেহাই পেতে হলে দেশ ছেড়ে চম্পট দেওয়া ছাড়া আর পথ নেই। তাই কাল সকালে এসে দেখবেন আমি নেই। ফটাে নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না গ্র্যান্ড-ডিউককে। আমাকে ভালোবেসে যিনি বিয়ে করেছেন, তিনি ওঁর চাইতে উঁচু জগতের মানুষ। রাজা হয়ে আমাকে যে-আঘাত উনি দিয়েছেন, তার পালটা আঘাত আমি দেব না। তবে ছবিটাও দেব না। ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ হিসেবে কাছে রাখব। তার বদলে অন্য একটা ছবি রেখে গেলাম, ইচ্ছে হলে উনি রাখতে পারেন।
বিশ্বস্ত
আইরিন নর্টন (অ্যাডলার)
উচ্ছাসে ফেটে পড়লেন গ্র্যান্ড-ডিউক—‘মেয়ের মতো মেয়ে— আমার রানি হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সমশ্রেণির নয়, এই যা দুঃখ।
উচ্ছাস না-দেখিয়ে হোমস বললে, “আমিও তাই দেখছি, উনি আপনার সমান শ্রেণির নন। আফশোস রয়ে গেল কেসটাকে এর চাইতে ভালোভাবে শেষ করা গেল না বলে।
বলেন কী! এর চাইতে ভালো শেষ আর হয় নাকি? আইরিন অ্যাডলার দু-কথা বলে না। ফটোটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও এত নিশ্চিস্ত থাকতাম না। বলুন কী পুরস্কার চান আপনি? এই
আংটিটা যদি দিই–’ বলে আঙুল থেকে মরকত আংটি খুলে নিলেন গ্র্যান্ড-ডিউক।
‘আংটির চেয়েও দামি জিনিস কিন্তু রয়েছে আপনার কাছে ?”
‘কী বলুন তো?
‘এই ফোটোটা।
‘আইরিনের ফটো আপনি রাখবেন? বেশ তো নিন।’
‘হেট হয়ে অভিবাদন জানিয়ে আমাকে নিয়ে বাড়িমুখে রওনা হল হোমস— পেছনও ফিরে দেখল না প্রতি-অভিবাদন জানাচ্ছেন গ্র্যান্ড-ডিউক ।
এই ঘটনার পর থেকেই মেয়েদের বুদ্ধির দৌড় নিয়ে ব্যঙ্গ করা ছেড়ে দেয় হোমস।
0 coment�rios: