কিছুদিন দুর্গে বিশ্রাম নিল জ্যাক। তারপর আবার একদিন বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
আর্থারের দরবারের এক নাইটের সঙ্গে। নাইট চলেছেন এক শয়তান জাদুকরের কুহক থেকে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করে আনতে। সব শুনে জ্যাক তাকে সাহায্য করার জন্যে সঙ্গে যেতে চাইল ।
কত নগর-জনপদ, মাঠ-প্রান্তর, অরণ্য পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন গভীর রাতে দুজন এক বিরাট পর্বতের পাদদেশে এসে দাঁড়াল। কাছেই একটা ছোট্ট কুটির দেখতে পেয়ে জ্যাক এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক বুড়ো। তার চুল বরফের মতো শাদা ।
দুজন ক্লান্ত পথিকের বিশ্রামের জন্য একটু জায়গা হবে কি তোমার ঘরে?' জ্যাক বলল ।
নিশ্চয়, জবাব দিল বুড়ো, গরীবের ঘরে পা রাখলে ধন্য হব।নাইটকে নিয়ে জ্যাক ভেতরে ঢুকল। বুড়ো তাদের আহার বিশ্রামের ব্যবস্থা করল।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে বুড়ো এসে দাঁড়াল জ্যাকের সামনে। তোমার কোমরবন্ধ দেখে বুঝতে পারছি, তুমিই কর্নওয়ালের সেই দুঃসাহসী যুবক, বলল সে, এ-পর্যন্ত অনেক দৈত্য তুমি বধ করেছ শুনেছি। এখন, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি। এই পর্বতের চুড়োয় একটা দুর্গ আছে—গালিগ্যানচুয়া নামে এক দৈত্যের দুর্গ। এক বুড়ো জাদুকরের সাহায্য নিয়ে দৈত্য রাজপরিবার আর সম্ভ্রান্ত ঘরের অনেক মেয়েকে ওই দুর্গে ধরে নিয়ে গেছে। সেখানে তাদের পশু-পাখি বানিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। কিছুদিন আগে এক ডিউকের সুন্দরী মেয়েকে তার বাবার প্রাসাদের বাগান থেকে ধরে এনেছে ওই জাদুকর। তারপর তাকে একটা শাদা রঙের কুকুর বানিয়ে দৈত্যের দুর্গে বন্দী করে রেখেছে।'
‘ঠিক আছে,’ বুড়োর হাত ছুঁয়ে জ্যাক বলল, ‘সকালে আমি মেয়েটাকে উদ্ধার করে আনতে চেষ্টা করব।"
দুর্গের ফটকের পাশে পাথরের ওপর লেখা আছে কী করে মায়াবল ভেদ করে দুর্গে ঢোকা যাবে, বলল বুড়ো। কিন্তু ফটক পাহারা দেয় দুই ভয়ঙ্কর দানব, তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন—কেউ কাছাকাছি গেলেই ওরা তাকে মেরে খেয়ে ফেলে। এর আগে অনেক নাইট মেয়েটাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ওই দানবদুটোর হাতে মারা পড়েছেন সবাই।’
‘আমি ওদের ভয় পাই না, বলল জ্যাক।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে তার জাদুর কোট আর জুতোজোড়া পরে নিল। তারপর কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে দৈত্যের দুর্গের দিকে রওনা হলো। নাইট সঙ্গে যেতে চাইলে তাকে নিরস্ত করল সে । তার পরামর্শমতো নাইট নিচে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
পর্বতের চূড়ায় উঠে জ্যাক দেখল, দুর্গের ফটকের দু’পাশে অদ্ভুত চেহারার দুই ভয়াল দানব দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। তাদের মাথা ঈগলের মতো, পিঠেও ঈশলের মতো দুটাে করে প্রকাণ্ড পাখা, কিন্তু ধড় অবিকল সিংহের মতো। অদৃশ্য জ্যাক নিঃশব্দে দানবদুটোর মাঝখান দিয়ে হেঁটে পার হয়ে গেল, তারা কিছুই টের পেল না।
ফটকের একেবারে কাছে গিয়ে জ্যাক দেখল রুপোর শেকলের সঙ্গে ঝোলানো রয়েছে একটা সোনার শিঙে । আর ফটকের পাশে পাথরের গায়ে লেখা আছে:
যে-ই তুমি হও, ফু দাও যদি শিঙ্গা তুলে ঠোঁটে,
দৈত্য হবে পরাভূত, মায়া যাবে কেটে ।
কথাগুলো পড়েই জ্যাক চট্ করে শিঙেটা দুহাতে ধরে মুখে তুলে খুব জোরে ফু দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ঘড় শব্দে আপনা-আপনি খুলে গেল ভারী পাথরের দরজা, সমস্ত দুর্গ থরথর করে কেঁপে উঠল।
দুর্গের ভেতর দৈত্য আর জাদুকরও কেঁপে উঠল ভয়ে। তবু দৈত্য ছুটে এল মুগুর উঁচিয়ে, কিন্তু জ্যাক তলোয়ারের এক কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলল। এদিকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দমকা বাতাসের একটা ঘূর্ণি এসে জাদুকরকে চোখের পলকে কোথায় যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল।
কুহক কেটে গেছে। দুর্গের সমস্ত পশু-পাখি আবার পরিণত হয়েছে মানুষে। তাদের বেশির ভাগই মেয়ে। সবাইকে মুক্ত করে এক জায়গায় জড়ো করল জ্যাক। তারপর দল বেঁধে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এল।
হঠাৎ গুড়গুড় করে একটা চাপা আওয়াজ উঠল। পরমুহুর্তে সবাই দেখল, গোটা দুর্গ মিলিয়ে গেছে কালো ধোয়ার মেঘের এক বিশাল আবর্তে ।
সবাইকে নিয়ে জ্যাক পর্বতের শিখর ছেড়ে নিচে নেমে এল । তাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন নাইট । দৈত্যের দুর্গ থেকে যেসব মেয়েকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে তাদের মধ্যেই নাইট খুঁজে পেলেন তার স্ত্রীকে । বহুদিন পর দু'জন দু’জনকে ফিরে পেয়ে স্বামী-স্ত্রীর আনন্দের সীমা রইল না।
এদিকে জ্যাক মেয়েদের ভেতর ডিউক-কন্যার খোঁজ করতেই একটি মেয়ে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল, তাকে ধন্যবাদ জানাল মাথা নুইয়ে। অপূর্ব রূপময়ী সেই তরুণীকে দেখামাত্র জ্যাক তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলল ।
পরদিন ভোরে জ্যাক সদলবলে রাজা আর্থারের দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সেখানে পৌছলে মহাসমারোহে বরণ করে নেয়া হলো তাদের। অত্যাচারী দৈত্যের কবল থেকে মুক্ত করে আনা নারীপুরুষ সবাই যার যার ঘরে ফিরে গেল। ডিউক তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়ে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন জ্যাককে।
জ্যাকের বীরত্ব আর বুদ্ধির কথা শুনে রাজা আর্থার খুশি হয়ে তাকেও তার দরবারের একজন নাইট করে নিলেন। তারপর ডিউককে নির্দেশ দিলেন তার মেয়েকে সৎ আর সাহসী নাইট জ্যাকের সঙ্গে বিয়ে দিতে । সানন্দে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন ডিউক। বিরাট উৎসবের আয়োজন করা হলো। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠল সারা দেশ ।
রাজা আর্থার নবদম্পতিকে চমৎকার একটা প্রাসাদ উপহার দিলেন। সেই প্রাসাদে সুখে-শাভিতে তাদের জীবন কাটতে লাগল।
0 coment�rios: