খেঁকশেয়াল দেখেছ?
কেমন ছাই ছাই বাদামি রঙের একটা লেজ রয়েছে ওদের । চোখ দুটো জুলজুলে, ইতিউতি তাকায়। যেন সব বোঝে। ভারি চালাক ।
কিন্তু খেকশেয়ালের লেজ একসময় বাদামি ছিল না। ছিল একেবারে টকটকে লাল । কী করে লেজের রং পাল্টে গেল সে গল্পটাই শোনাই তোমাদের ।
ছিল একটা গহিন বন । দিনের সূর্যের আলো পৌছায় না সেই বনে। ঘন সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছপালা সেখানে | বাতাস বইলে শিরশির শব্দ শোনা যায় । সেই বনের ধারে থাকত এক বুড়ি । খুনখুনে সত্তুরে বুড়ি । সাত কুলে কেউ নেই তার । কারো সাত-পাঁচে থাকত না সে । তার ছিল সাতটা শুওরছানা আর সাতটা মুরগি । আদর দিয়ে, যত্ন দিয়ে লালন-পালন করত সে তাদের। বুড়ির বয়স যত বাড়ে কাজের শক্তিও তত কমে। শুওরছানা আর মুরগিদের তেমনভাবে লালন-পালনও করতে পারে না ।
লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ি তাই একদিন গেল একজন জোয়ান তাগড়া লোকের কাছে। তাকে বলল, ভাইরে, পোষা মুরগি আর শুওরছানাদের দেখাশোনা করতে পারি না। তুমি কি আমার সাহায্য করবে?লোকটা বলল, কিন্তু আমার হাতে যে একেবারে সময় নেই। অনেক যে কাজ আমার | কী করে তা করব??
বুড়ি মন খারাপ করে গেল আরেক জনের কাছে। সে-ও একই কথা বলল । শেষে কী আর করবে বুড়ি? গেল সে ভালুকভায়ার কাছে। নাদুস-নুদুস বাদামি রঙের ভালুকভায়া। চোখ দুটো পিটপিটে । যেন সে খুবই নিরীহ আর গোবেচারা। বুড়ি বলল, ভালুকভায়া, তুমি কি এদের ভার নেবে?’
ভালুকভায়া তো এক কথাতেই রাজি । শুওর আর মুরগি– দুটোই তার প্রিয় খাবার। মনের আনন্দে সে রাজি। বুড়ি তখন বলল, কিন্তু তুমি কি ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে?
‘কেন করব না? নিশ্চয়ই করব । আমি গরব... গরব... বলে ওদের ডাকব ।’
'নাহে ভাই, তোমার ওই গুরুগম্ভীর ডাক শুনে আমার আদরের ছানারা একেবারে ভড়কে যাবে। তোমার কাছে রাখা যাবে না ওদের ' বলেই বুড়ি কেটে পড়ল ভালুকের কাছে।
এবারে বুড়ি গেল নেকড়ে বাঘের কাছে। প্রস্তাব শুনে নেকড়ের জিব দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। এ তো একেবারে মেঘ না চাইতেই জল ।
লোভে তার চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে লাগল। সে-ও এক কথাতেই রাজি ।
বুড়ি নেকড়ের কাছেও জানতে চাইল, ‘তুমি কীভাবে দেখাশোনা করবে আমার আদরের শুওরছানা আর মুরগিদের?
নেকড়ে বলল, আমি ওদের আদর করব । সময়মতো খাবার দেব। আর ওঁউ ওঁউ ওঁউ বলে ডাকব ।’
নাহে এমনটি করলে চলবে না। তাতে আমার আদরের পশুপাখিরা ভয় পেয়ে যাবে। আর ওরা যদি ভয়ই পেয়ে যায় তবে তোমার কাছে ওদের রেখে যাব কেন?’
বিদায় নিল বুড়ি। এবারে সে গেল খেঁকশেয়ালের কাছে। খেঁকশেয়াল কিন্তু দারুণ বুদ্ধিমান। সে মন দিয়ে বুড়ির সব কথা শুনল। ভালো-মন্দ মন্তব্য করল না কোনো !
বুড়ি শুধাল, ‘তুমি আমার পশুদের আদর-যত্ন করবে তো ভাই?’ নিশ্চয়ই আদর করব।”
কী বলে ডাকবে তুমি ওদের?
খেঁকশেয়াল তখন জানাল, খুবই আদর করে ডাকব । বলব আমার ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা কাছে আস। তোমাদের জন্য অনেক অনেক খাবার এনে রেখেছি।
খেঁকশেয়ালের কথায় ভারি খুশি হল বুড়ি। একেবারে মনের মতো সঙ্গী পাওয়া গেছে। বুড়ি খেঁকশেয়ালকে নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। তার প্রিয় মুরগি আর শুওরছানার দেখাশোনার ভার দিল তাকে ।
দিন যায়। রাত আসে ।
রাত পেরিয়ে আবার আসে দিন ।
খেঁকশেয়াল প্রতিদিন মুরগি আর শুওরছানাদের সময়মতো খাবার দেয়। পানি দেয়। যত্ন-আত্তিরে কোনো ক্রটি করে না। রাতে ঠিকমতো খোয়াড়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে মুরগি আর শুওরছানাদের গায়ে-গতরে চেকনাই বাড়তে লাগল।
বুড়ি তো দারুণ খুশি ।
সত্যি খেঁকশেয়ালের প্রশংসা না করে উপায় নেই ।
একদিন হঠাৎ করেই বুড়ি কালো শুওরছানাটার খোজ করল । না, ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ।
‘ওগো খেঁকশেয়াল, কোথায় গেল আমার কালো শুওরছানাটা?’
‘কোথাও না, বুড়িমা। ছানাটা দূরের বনে ঘুরতে গেছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। খুব তাড়াতাড়ি ও ফিরে আসবে।’
কিন্তু শুওরছানাটা আর ফিরে এল না ।
এইভাবে আরেকদিন । বুড়ির আদরের লাল বুটিঅলা মোরগটাকেও পাওয়া গেল না |
এই কথা খেঁকশেয়ালকে জিগ্যেস করতেই সে চটপট জবাব দিল, “মোরগটা নদীর ওপারে বেড়াতে গেছে। এখুনি ফিরে আসবে।
কিন্তু সেই মোরগটাও ফিরে এল না।
বুড়ি তখন মহা ভাবনায় পড়ে গেল ।
চিন্তায় চিন্তায় তার রাতে আর ঘুম আসে না । সে তাই মুরগির ঘরে গেল রাতদুপুরে। সঙ্গে নিল একবাটি দুধ।
ঘরের পাশে আসতেই বুড়ির চক্ষু চড়কগাছ। মুরগিগুলো চিৎকার, চেঁচামেচি করছে। ঘরের চারদিকে তারা ছটফট করে ছুটে বেড়াচ্ছে। ভয়ানক শব্দ শোনা যাচ্ছে— কোঁকর কোঁ , কোঁকর কোঁ ।
খোয়াড়ের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখে– খেঁকশিয়াল একটা মুরগিকে মুখে পুরে বেশ হেলতে দুলতে হেলতে দুলতে ফিরে আসছে। বুড়ির কাছে তখন সব পরিষ্কার হয়ে গেল— কীভাবে তার শুওরছানা আর মোরগটা হারিয়ে গেছে । রাগে বুড়ির তখন মাথা গরম হয়ে গেল। কি? এত বড় দুঃসাহস!
হাতের গরম দুধের পাত্রটা বুড়ি ছুড়ে মারল খেঁকশেয়ালের দিকে । গরম দুধের ছ্যাকা লেগে খেঁকশেয়াল তখন মুরগি রেখেই দে চম্পট | একদৌড়ে প্রাণের ভয়ে
তারপর শুরু হল লেজের জুলুনি। দুধ গিয়ে পড়েছিল তার লেজে। এতে তার লাল লেজের গোড়াটা ধূসর, ছাই-ছাই রঙা হয়ে গিয়েছিল এরই মধ্যেই।
এই ঘটনার পর থেকে খেঁকশেয়ালের লেজটি হয়ে গেল ছাইরঙা । অন্যেরা তার লেজ দেখিয়ে তখন বলতে শুরু করছে :
"দেখ, দেখ, দুষ্টু খেঁকশেয়ালের কাণ্ড দেখ! লেজের অবস্থা কী হয়েছে। যেমন দুষ্টু ঠিক তেমনই সাজা!"
0 coment�rios: